আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তামুক পুরান (ঈষৎ পরিমার্জিত)

জিনাতকে মনে আছে?লিডো রুমের প্রশস্ত ক্যাবার মঞ্চে পঞ্চমের সুরে নৃত্যরতা, উঞ্চ কবুতর বক্ষ-বিভাজিকায় লজ্জা-চৌচির স্বল্পবসনা জিনাত? অথবা, সত্তর দশকের বলিউডে ‘হরে রাম হরে কৃঞ্চ’ ছবির রোদ চশমায় চোখ ঢাকা জিনাতের সেই সস্বপ্নদৃশ্যটির কথা স্মরণ করুন! আপামর শুখা সেবনকারির মতো এই দৃশ্যটি আমারও খুব প্রয়ি। দ্বিধা-জর্জর জীবন ভেঙ্গে যখনই কোনও বন্ধুকে দেখেছি মারিজুয়ানার ছিলিম সুড়ঙ্গে লালি আঁচ তুলতে,কানে ভেসে আসে সেই হিসহিসানো মুখড়া, ‘দম মারো দম/ মিট যায়ে গম’। ছিলিম ধরানোর আগে কলকে সাজানোর যেমন ঝিলমিলে একটি গাল-গন্ধ থাকে,ঢাকার চলতি হাওয়া এখন মৌ মৌ সেই গন্ধে। নিজের গল্প, হালফিলের পট মানে গাঁজা বা মারিজুয়ানার নেশার আগে শুখা পর্বের হাতেখড়ি হয়েছিল একেবারে সহজপাঠের বয়সে,সে আমার পিতৃ-পুরুষের গ্রামে। হয়তো এমন করেই হয় সবার প্রথম নেশাপাঠ।

তো কেমন সেই হাতে-খড়ির গল্প ? স্কুল-ছুটির দুপুর গড়িয়ে ফিরতি পথে খেঁজুর গাছ ও বন-বাদাড় থেকে সংগ্রহ করতাম মাকড়সার জালের মতো সাদা এক ধরণের আঠা। তারপর বসে কিছুটা সংগ্রহ হয়ে গেলে, হাতের তালুতে ফেলে মেখে নিতাম খৈনির মতো। কোনও বন্ধু এই অবসরে তালপাতা পাকিয়ে সযত্নে একটি কলকে বানিয়ে দিত। তার মাথায় একটি বাবলার কাঁটা লাগানো থাকত,যেন কলকের পাক খুলে না যায়। এরপর সেই আঠার মশলা তালপাতার কলকের মধ্যে ঠেসে দিয়ে নিরিবিলিতে সুখটান চলত মাঠরে আলে বসে।

শেষ বিকেলের নিভূতিতে এটাই ছিল আমার প্রথম শুকনো নেশাপাঠের হাতেখড়ি। চোরা সৌর্ন্দর্যের স্রোতে গা ভাসানো এঁদো গ্রামের আলপথ থেকে ঢাকার রাজপথ- এই দুরুত্বটুকু পার হতে গিয়ে ছাব্বিশর্ধ বয়সে কত নেশা আর তার পূজারীদের সঙ্গেই তো আলাপ হল। মহাকাব্যের মধুমাধবী না হোক, ‘ছটাক সোডার জলে পাকি তিনপো্য়া হুইস্কি' সেবন করা এন্তার গুণিজনের বাক-বাকুমও তো শুনলাম। কিন্তু পাতার ছিলিমে মুখ ডুবিয়ে মাঠের আলে বসে সেই বৈকালিক আখড়ায় নেশার ধূমকিতে সহজিয়া মানুষের যে গহন কথায় মাতন,তেমন নেশায় আর ভজেনা এই শেষ বিকেলের যৌবন ! ঢাকার নেশার আঁটি ভেঙ্গে শাঁস খুলে দেখি,এখানে ছিলিম সেবনের সিলসিলা বেশ পুরোনো। সম্ভবত লোকগান নিয়ে মাতামাতি শুরুর সময় থেকে গ্রাম্য-গঞ্জিকার গায়ে শহুরে হাওয়া লাগে।

মহাকালের স্রোতে ভেসে এখন সেই ছিলিমের আসন ফুটপাত থেকে গুলশানের সুখ নিকুঞ্জে। সুখদার এই শুখা মশলার কথা এদেশের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চিকিঃসাশাস্ত্রে থাকলেও এ কথা সবার জানা, মারিজুয়ানার অত্যধিক সেবনে স্মরণশক্তি হ্রাস হয়। তথাপি এটাও সুবিদিত তাবৎ দুনিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিলোত্তমার বুকের খোন্দলে আড্ডা জমাতে জুড়ি মেলা ভার হজম-ফ্রন্ডেলি এই পাচকরাজার। উইকির পাতা বলছে, গঞ্জিকার রমরমা পৃথীবির নানা দেশে,বিচিত্র নামে। তার দেহ-পল্লব উপমহাদেশে গাঁজা নামে পরিচিত হলেও, একই জিনিষ পশ্চিমারা চেনে মারিজুয়ানা বা মারিহুয়ানা নামে।

আবার একই গাছের পাতা বা ডালের আঠালো রস-কষ দিয়ে তৈরি বস্তুটির নাম চরস। পশ্চিমের কোথাও কোথাও তার আদুরে নাম ‘হাশিশ’ । আবার সেখান থেকেই উৎপত্তি ‘হ্যাশ অয়েলের’। এসবের বাইরে রয়েছে গাঁজার বিচিত্র সব নাম ;পাট্টি, সব্জি, গ্রাস, মাজুন, পট, রকেট, শুকনা,ছিলিম,শালটু,জয়েন্ট ইত্যাদি। অধুনা নিষিদ্ধ হলেও, নওঁগায় সমবায় সমিতির মাধ্যমে গাঁজার চাষ হতো একসময়।

তাও সরকারি নিয়ন্ত্রনে ! ১৯৮৬ সালের আগ র্পযন্ত গুলিস্তানে মুড়ি-মুড়কির টংয়ের মতো বসতো এইসব সবুজ পাতার দোকান। আমার জন্মের বছর সামরিক উর্দি পরা এক রাবনের গ্রাসে হারিয়ে যায় এইসব সুখপাতা-বিষপাতার বহর। শুধু রবীঠাকুরের ঠেক নয়,আবার মুজতবা আলীর ঠোঁটও নয়,বরং চিত্রা নদীর সুলতানের শিষ্য বাঁটুলের তালু থেকে লালনের কাটনা পর্যন্ত বিস্তার করেছে গঞ্জিকা। তেঁতুলিয়ার টিলা থেকে টেকনাফের প্রবাল খূঁড়লেও বেরিয়ে পড়বে পটের নেশার ভস্ম। শুধু কি তাই, চট জলদি নেশা জমাতে ছিলিম ছেড়ে শুকনো মশলা শুয়েছে সফেদ স্বপ্ন সিগারেট সুড়ঙ্গে।

বিড়ি বা সিগারেটের টানেলে সবুজ সুখের অষ্টপ্রহর নিৎশ্বাসে এখন হরহামশোই ডুবে যায় প্রাচ্যের অক্সর্ফোড। তাই সেখানে বিরাজ করছে ধোঁয়াটে স্বাধীনতা। যার অপর নাম অস্থিরতা। ফ্রান্সের বায়োমেডিকেল ইনষ্টিটিউট- এর জ্ঞানকীটেরা ব্যথানাশক হিসেবে গাঁজা বা মারিজুয়ানাকে পাশ্ব-প্রতিক্রিয়াহীন ওষুধের সীলমোহর দিলেও এখনও বেশিরভাগ দেশেই এর হাত-বদল নিষিদ্ধ । কেন না, গাঁজার মূল নেশা উদ্রেককারী উপাদান ডেটা-৯-ট্রট্রোহাইড্রোক্যানাবনিলে ক্ষতির দিকটাই প্রধান হিসেবে দেখছেন অধিকাংশ জ্ঞানকীট।

উপাদানটির পরিমানই নাকি নেশার অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রন করে। গুণগত মানের নিরিখে এবং মশলার সাকিন বিচারে নঁওগার হারাগাছা এবং কুষ্টিয়ার বাগচীপাড়ার ‘তামুক’ই নমস্যস্থানীয় । বনখেকোদের চোখে উৎকোচের র্পদা ফেলে সুন্দরবন অঞ্চলেও চাষ হয় কিছু। তবে গঞ্জিকার তীর্থস্থানের কথা উঠল,সবার আগে আসবে লালনরে ছেঁউড়িয়া। নাকের সুড়ঙ্গে কালীগঙ্গার বিবাগী বাতাস,আর ছেঁউড়িয়ার সহজিয়া সাধকদের শুখাশলাকার ধোঁয়া-আহ ! এ যেন রবিশঙ্করের রাগ ভৈরবী ! আবার সোহরাওর্য়াদীর বুকে বাঁসা বাঁধা হাড্ডিসবর্স্ব মুখগুলোয় তাকালে সেই ধোঁয়াই পরিণত হবে বিষাদ-সিন্ধুতে।

সমঝদার শ্রোতা যেমন কালোয়াতি গানের কদর বোছেন অনায়াসে, সুখদার একটি সুখটানে মহতী নেশাখোরও সমঝে যান মারিজুয়ানার দ্রব্যগুণ। রসকি জনের কেউ কেউ আছেন,স্রেফ গন্ধ বিচারেই বলে দিতে পারেন গঞ্জিকার ঔরসজাত সাকিন-হারাগাছা নাকি বাগচীপাড়া ? নাকি ইট-কাঁঠের ঢাকার ঘুমের ঔষধ মেশানো বিষপাতা ! কেউ আবার শুখা পল্লবের যৌন-জড়ি প্যাঁচ দেখে দিব্যি বলে দেন বুকের হাঁপড়ে পাতার দম ! উইকি জানাচ্ছে, মারিজুয়ানার মধ্যে মাদক উপাদান টিএডিএসচির পরিমাণ গড়ে শতকরা ০.১ থাকলেও ৫.০ ভাগ, হাশিশে বা চরসে ০.২ থাকে ১০.০ ভাগ। তবে অভিজ্ঞতা বলছে এর সবটা সঠিক নয়। রাতের আখড়ায় বসে হাতবদল হতে থাকা ছিলিমের নেশায় দম কথাটাই আপেক্ষিক। কখনও তা ধুমকি জাগায় সঙ্গচারি মন।

ে আবার, কখনো তা শিশির ঝড়ায় নিঃসঙ্গ চোখ থেকে ! আমার নিজের বিশ্বাস, মারিজুয়ানা বা গাঁজার নেশার চড়তি বেশিরভাগই নির্ভর করে কাড়িগরের দুই হাতে। এখন বহুজনকে দেখি মারিজুয়ানা বানানোর সরঞ্জামের সঙ্গে একটি পৃথক ডিব্বাও রাখতে। সরঞ্জাম বলতে,একটি বড় টিফিন কৌটোর মধ্যে একটি ছোট কাঁচি, একটি ছোট্ট ছাঁকনি আর রান্না-বাটনার মতো বেশ কয়েকটি ছোট ছোট কৌটো। তার মধ্যে থাকে গাঁজার সঙ্গে মেশানোর জন্য নানা ধরনের পচ্ছন্দসই ‘ইনগ্রডেয়িন্টেস’। মানে মশলা- দোকতা পাতা, তামাক, বিড়ি বা সিগারেটের মশলা,পিপার অয়েল, দু-তিন ধরনের সুগন্ধি তেল, র্দীর্ঘ সময় সাদা মদে ভেজানো জটামাংসীর শিকড়ের রস, কিমাম দানা, সুগন্ধি র্জদাগুঁড়ো, জায়ফল অথবা মধু।

শেষের বস্তুটি ‘দোকলা’ মানুষেরা বেশি ব্যবহার করে থাকেন। তাতে নাকি রাতে সুখ হয় ! তবে সবগুলো মশলার মিশ্রনে নিত্য-নতুন রাগ চড়ে নেশার স্বরবিতানে। ইঁদুর (মাউস) প্রজন্মের অনকেই দেখি বাহারি ছিলিম সংগ্রহ করতে। তবে সেই যুগের মানুষদের চোখের মণি মাটির কলকে। সুর্দীঘকাল ধরে যাঁরা এই নেশাটি করছেন, তাঁদের অভিমত, ‘কষের জন্য কেউ কেউ ধাতব বা পাথরের কলকে ব্যবহার করে,কিন্তু তাতে গরম হয়ে যায় পর পর ছিলিম সাজালে'।

বহু সহজিয়া আউল-বাউল-ফকির-দরবশেকে দেখেছি মাটির কলকেয় একটুকরো পাথরের টিকলি দিয়ে লালশালুতে মুখ রেখে বেদম টানে দপদপপিয়ে আগুন জ্বালাতে। আট কুঠুরি নয় দরজা ঘুরেও সে আগুন নেভার নয়! সত্যি বলতে, প্রথম দিনের সেই যে নেশার নবিশ ওড়াউড়ি তা থামনেনি আজ র্পযন্ত। তবে দিকশুন্যপুর থেকে হয়তো একদিন মনটা ঠিকই উড়াল দেবে নেশাশুন্যপুরে। তার আগে প্রতি রাতে স্বপ্নে কড়া নাড়ে স্রোত ছোঁওয়ানো সেই সবুজ গ্রাম। আমার পিতৃ-পুরুষের মাটি।

আমার শৈশবের বেলাভূমি। যেথায় আমার প্রথম নেশা-কষ্টের হাতেখড়ি। তা লাঘব করতে পৌঁছে যাই জয়দবের উঠানে,একেবারে হিমভোরে। যেখানে গিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করি ,দুনিয়াকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো এক ডানপিটের নিঃসঙ্গতার ফ্রেমে। সবার অলক্ষ্যে সেই শৈশবেই ছিঁড়েছে নাঁড়ির বাঁধন।

পেটে বিদ্যের কালি এবং থলিতে কাগুজে নোট জমাতে এখন বিদেশ বিভুঁইয়ে বসে দিতে হচ্ছে মানুষ হওয়ার মাশুল। জীবনের এই অর্ধেক পথে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে দেখি ,অগনতি অভিশাপ ধেয়ে আসছে সাপের ফণা পাকিয়ে। বাকি আগামির আঁধুলি নিয়ে এখনই ব্যাস্ত নিৎসঙ্গতার ঘুনপোকা। এই দুইয়ে চাপে তাই বেঁচে থাকার মন্ত্র শুধুই গাঁজা ! চারশো বছরের প্রাচীন ইস্পাত নগরীতে জীবন যখন শুধুই গ্লানির ঘানি টানা গাঁধা,তখন ছিলিমে ওঠে সুখের চোষন,মন ভোলে স্বজন-কষ্টের পলি বাঁধা হাঁপড়ে শ্বাস নেয় কগ্ধকালসার এক পরাগাছা র্স্বণলতা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার     বুকমার্ক হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।