ভেষজ ওষুধ ও শখের উপাদান হিসেবে বাঘের চামড়া, হাড় ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপক চাহিদার খরব পুরান কথা। নতুন ও আশার কথা, বাণিজ্যের পাশাপাশি বাঘ রক্ষায় উদ্যোগও স্পষ্ট হচ্ছে। নবেম্বরের ২১-২৪ তারিখে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ সম্মেলন তারই সংগঠিত রূপ।
যদিও মাত্র ১৩টি দেশ অংশ নিয়েছে, এ সম্মেলনকে বলা হচ্ছে ‘বৃহৎ বিড়াল’ বিষয়ে প্রথম বিশ্ব সম্মেলন। কারণ প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক নানা চাপ উপেক্ষা করে এখনো বন্য পরিবেশে বাঘ টিকে আছে মাত্র ১৩টি দেশেই।
বাঘ বিচরণকারী ১৩টি দেশের পাশাপাশি সম্মেলনে সক্রিয়ভাবে (পর্যবেক্ষক নয়, পক্ষ) অংশ নিয়েছিল বিশ্বব্যাংক, ডব্লিউডব্লিউএফ, ডব্লিউসিএস’র মতো কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। উপস্থিত ছিলেন হলিউড ফিল্মস্টার লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও ও সুপারমডেল নওমি ক্যাম্পবেলের মতো গ্ল্যামার জগতের ব্যক্তিত্বরাও। বাঘ রক্ষায় ক্যাপ্রিও তো ১০ লাখ ডলার অর্থ সহায়তার অঙ্গীকারও করেছেন।
সাদা চোখে দেখলে, বাঘ রক্ষায় ৩৩ কোটি ডলার তহবিলের প্রতিশ্রুতি ও যৌথ ইশতেহার স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত সম্মেলনটি প্রশংসা পাবারই যোগ্য। রাজসিক প্রাণীটির বিলুপ্তি ঠেকানোর প্রথম যৌথ উদ্যোগ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকও।
আশাবাদীরা এও বলতে পারেন যে, শতাব্দীর ব্যবধানে রাজসিক এ প্রাণীর সংখ্যা এক লাখ থেকে সাড়ে তিন হাজারে নেমে আসায় পরিবেশবাদীরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন, পিটার্সবার্গের বাঘ সম্মেলন তারই স্বীকৃতি।
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাঘ রক্ষা বঙ্গীয় ব-দ্বীপের জন্য নিছক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয় নয়। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিস্থিতি অনেকাংশে এ বৃহৎ বিড়ালের অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। বাঘ না থাকলে বিশ্বের বৃহত্তম গড়ান বনটি এক পর্যায়ে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তে বাধ্য।
আর সামুদ্রিক দুর্যোগে ‘প্রাকৃতিক ঢাল’টি আমাদের জন্য কতটা সহায়ক, তার প্রমাণ আমরা সিডর ও আইলার সময় পেয়েছি। কেবল আমাদের জন্য বা অংশগ্রহণকারী ১৩টি দেশের জন্যই নয়, গোটা পৃথিবীর প্রাণীবৈচিত্র্য ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে বাঘ রক্ষার বিকল্প নেই। কিন্তু কীভাবে?
সম্মেলনে গৃহীত হয়েছে বৈশ্বিক ব্যাঘ্র পুনরুদ্ধার কর্মসূচি (গ্লোবাল টাইগার রিকভারি প্রগ্রাম)। সম্মেলনে বলা হয়েছে, এর আওতায় আগামী এক যুগ কাজ করে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। আর এজন্য যে অর্থের প্রয়োজন সেজন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে।
কম-বেশি সাড়ে তিন হাজার বাঘ রক্ষার জন্য যে তহবিলের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে; তাতে বাঘপ্রতি এক লাখ ডলার বরাদ্দ হতে পারে। কিন্তু বরাদ্দ ও প্রতিশ্রুতিই কি শেষ কথা?
প্রথমত, যে দুটি দেশে সবচেয়ে বেশি বাঘ রয়েছে, বাংলাদেশ ও রাশিয়া (হোস্ট কান্ট্রি) ছাড়া তাদের আর কেউ এ সম্মেলনকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। এখন সবচেয়ে বেশি বাঘ রয়েছে ভারতে- ১৪১১। কিন্তু তারা পাঠিয়েছে প্রায় অনুল্লেখযোগ্য পর্যায়ের প্রতিনিধি। ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়াও তথৈবচ।
চীনে যদিও বাঘের সংখ্যা মাত্র ৪৫, বাঘ রক্ষায় দেশটির গুরুত্ব অন্যদিক থেকে। কারণ বাঘ-বাণিজ্যে চীনারাই হচ্ছে সর্বপ্রধান ভোক্তা। চীনারা যদি সচেতন হয়, বিশ্বে বাঘ হত্যা নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন নয়। চীনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাউ সম্মেলনে অংশ নিয়েও এর বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবহার বন্ধে সুনির্দিষ্ট ও জোরালো কোনো বক্তব্য রাখেননি।
দ্বিতীয়ত, প্রতিশ্রুত তহবিল কীভাবে গঠন হবে? ৩৩ কোটি ডলারের অংক বেশ বড় হলেও পুরো বিষয়টি তলিয়ে দেখে খুব উৎসাহ পাওয়া যাচ্ছে না।
কারণ প্রতিশ্রুতিদাতারা এজন্য নতুন অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছেন না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্যান্য কর্মসূচির বরাদ্দ অর্থ থেকেই একটি অংশ বাঘ রক্ষায় ব্যবহৃত হবে। এখন, উপকূলীয় অঞ্চলের শিক্ষা কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমিয়ে বাঘ রক্ষা কর্মসূচি কি বাংলাদেশের মতো দেশে সহজ হবে?
তৃতীয়ত এবং প্রধানত, প্রশ্ন উঠতে পারে টাইগার সামিটে বিশ্বব্যাংকের প্রবল উপস্থিতি নিয়ে। তার মানে, বাঘ রক্ষা তহবিল কি এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিই পরিচালনা করবে? এ ধরনের তহবিল পরিচালনায় বাইরের মাতবরির অভিজ্ঞতা কিন্তু ভালো নয়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিভিন্ন পর্যায়ে তহবিল পাওয়ার কথা আমরা বহুদিন ধরে শুনে আসলেও এখন পর্যন্ত ‘এক ডলার’ও পাওয়া যায়নি।
এর পেছনে অনেকে বিশ্বব্যাংকের কারসাজি খুঁজে পান। প্রতিষ্ঠানটি গোড়া থেকেই ওই তহবিল ব্যবস্থাপনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চাইছে। বাংলাদেশ রাজি না হওয়াতেই নাকি সবকিছু বিলম্বিত হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ পরিস্থিতির অবনতির জন্য পরিবেশবাদীরা যে প্রতিষ্ঠানকে অনেকাংশে দায়ী করে থাকেন, তারা হঠাৎ করে বাঘ রক্ষায় তৎপর হলো কেন? মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি হলেই কিন্তু সন্দেহ জাগে। বাঘ বিচরণের প্রধান অঞ্চল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গত দুই দশকে বাঘের সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার পেছনে প্রধানত দায়ী পাহাড় ও জঙ্গল বিনষ্টকারী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো।
হিমালয়কেন্দ্রিক পাহাড় ও বনভূমি ছিল বাঘ ও হাতির যথেচ্ছ বিচরণকেন্দ্র। কিছুদিন আগে প্রকাশিত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ওই অঞ্চলে ৫৫২টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর বেশিরভাগই বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ও উৎসাহে বাস্তবায়িত হচ্ছে। হিমালয়ের উত্তরপাশেও চলছে বাঁধ নির্মাণের মহোৎসব। সেগুলোর মূল উদ্যোক্তা স্বভাবতই চীন।
লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডেও বাঁধ নির্মাণে উৎসাহ যোগাচ্ছে চীন ও বিশ্বব্যাংক। এখন হঠাৎ করে এ দুই পক্ষ বাঘ বাঁচাতে আগ্রহী হলো কেন?
বাংলাদেশের সিলেট-চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাঘের বিলুপ্তি কিংবা সুন্দরবনে বিপন্নতার কারণগুলো কী? প্রধান কারণ হচ্ছে বাঘের আবাস ও বিচরণস্থল কমে যাওয়া, বাঘের খাদ্যযোগ্য প্রাণী কমে যাওয়া, বনজসম্পদের মাত্রাতিরিক্ত আহরণ ইত্যাদি। সুন্দরবনে বাঘের উপযুক্ত প্রতিবেশ ধ্বংস করেছে চিংড়ি চাষ। আশির দশকে সুন্দরবন অঞ্চলের সব কৃষিজমি থেকে কৃষি ও কৃষককে উচ্ছেদ করে কৃষিজমিকে বাণিজ্যিক চিংড়িঘের বানানো হয়েছিল। তখন থেকেই কিন্তু চাপ বাড়তে থাকল সুন্দরবনের ওপর।
বিশাল জীবিকাহারা মানুষ সুন্দরবনের বনজসম্পদ সংগ্রহ করে জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়েছিল। বাণিজ্যিক চিংড়িঘের সম্প্রসারণে বিশ্বব্যাংক সরাসরি জড়িত। বনে ও পাহাড়ে খনিজ অনুসন্ধান কিংবা আইপ্যাকের মতো ম্যানগ্রোভ প্রতিবেশ বিচ্ছিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গেও প্রতিষ্ঠানটি ও তার বন্ধুরা কি দায় এড়াতে পারে? এখন বাংলাদেশে পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থার যে দুর্গতি, তার জন্য বিশ্বব্যাংকের দায়ই সিংহভাগ, এমনটি অনেকেই মনে করেন।
বাঘ সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যোগ দিয়েছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ এ প্রাণী রক্ষায় বৈশ্বিক উদ্যোগের কথাও বলেছেন জোরেশোরে।
তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, বাঘ না রক্ষা পেলে বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষা করা যাবে না। কিন্তু ইতিমধ্যে এদেশে বহুল সমালোচিত একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত একটি উদ্যোগে আমরা কতটা সুফল পেতে পারি?
লেখাটি ইষৎ বিস্তৃত পরিসরে এর আগে 'সাপ্তাহিক'- এ প্রকাশ হয়েছে
http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=4549
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।