বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
অনেক দিন হল চশমার কাঁচ বদলানো হয় না। দু-বছর আগে একবার চোখের ডাক্তারের কাছে যাবে বলে ভেবেছিল ফরিদুর-ঠিক তখনই খুরশীদা ডির্ভোস চেয়ে বসল, যাওয়া আর হল না। আজকাল ছাপা অক্ষর পড়তে সমস্যা হয়।
জীবনের দীর্ঘ সময় বই পড়ে কাটিয়েছে ফরিদুর, এখন অসুস্থ শরীরেও তাকে কিছু না কিছু পড়তেই হয়, পড়তে না-পারলে এক ধরনের অস্বস্তি হয়; মনে হয়, তাহলে আর বেঁচে থাকব কেন - যদিও বেঁচে থাকাটা তার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না। পাশের কেবিনের বৃদ্ধ রেজাউল করিম পত্রিকা রাখেন। পড়া শেষ হলে এ কেবিনে পাঠিয়ে দেন। আজও দিয়েছেন। পত্রিকায় চোখ বোলায় ফরিদুর ।
অক্ষরগুলি চোখে ঝাপসা ঠেকে। অস্থির বোধ করে সে। কোনও কিছু না-করে সময় কাটানো কী যে অস্বস্তিকর। তার ওপর দিনটি আজ মেঘলা। রোদেলা হলেও অবশ্য কিছু এসে যেত না - এই শ্রীহীন দুঃস্থ সরকারি হাসপাতালে ঔজ্বল্য তাতে বাড়ত না, বরং ম্লানতা আর দৈন্য প্রকট হয়ে উঠত- মেঘলা দিনের ছায়ায় বরং অনেক অনভিপ্রেত দৃশ্য আড়ালে থেকে যায়, দৃশ্যের একঘেয়েমিতে একটা বৈচিত্র আসে।
মেঘলা দিন অনেক সময় কাঙ্খিত হয়ে ওঠে।
ফরিদুর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে, ক্লান্ত লাগে ওর, সিগারেটের জন্য শরীর বিদ্রোহ করে। হাসপাতালে সেটি সম্ভব না। ওই সিগারেটই কাল হয়েছে। একটানা পঁিচশ বছর সিগারেট টেনেছে, তার ধোঁওয়া ফুসফুসের অপরিমেয় ক্ষতি করেছে।
তাছাড়া, খুরশীদা চলে যাওয়ার পর খাওয়াদাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল, খিদে কমে গিয়েছিল।
যক্ষার জীবাণু বসত গেড়েছে তার বিক্ষত ফুসফুসে।
হাসপাতালে দু-মাস হতে চলল।
প্রথম-প্রথম অনেকেই দেখা করতে আসত। প্রকাশক, কলিগ, প্রতিবেশি।
এখন লোকজনের আসা-যাওয়া অনেক কমে গেছে। এক বোন থাকে রামপুরায়। জিন্নাতুন প্রথম প্রথম আসত, ওর হাজব্যান্ডও আসত। এখন আর আসতে পারে না। সংসারের চাপ।
অন্য কারণও আছে। যক্ষা হাসপাতালে সহজে কেউ আসতে চায় না। জিন্নাতুন তিনটি ছেলেমেয়ের মা।
তবে ফরিদুর তেমন একা বোধ করে না। লেখক বলেই ফরিদুর জীবন সম্বন্ধে কৌতূহলী।
কেউই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সম্বন্ধে সে কৌতূহলী। এরা তার নিয়মিত খোঁজ খবর নেয়। মিনারেল ওয়াটার এনে দেয় কিংবা এক্সরে করার সময় পাশে থাকে।
অবশ্য পাশের কেবিনের রেজাউল করিমের সঙ্গে সময় কাটে বেশি।
বৃদ্ধ থাকেন কলাবাগানে । ছেলেমেয়েরা সুপ্রতিষ্ঠিত। এসে বাল্যজীবনের গল্প করেন বৃদ্ধ। বৃদ্ধ সুবক্তা। ১৯৪০ সালে বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায় জন্মেছেন রেজাউল করিম ।
স্থানটি নদীময় । মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, গ্রামীন পরিবেশ, পাঠশালার সহচর, তাদের সঙ্গে চর হোগলায় বনভোজন, তেঁতুলিয়া নদীতে নৌভ্রমন, ভোলা সদরে সিনেমা দেখা ও লজিং জীবনের কথা উঠে আসে বৃদ্ধের স্মৃতিকথায়। ভোলা সদরে সিনেমা দেখার সময়ই সিগারেট ধরেছিলেন। শুনতে-শুনতে ঝিমুনি ধরে ফরিদুরের। পাঁচ কি দশ বছর আগে হলে মনোযোগ সহকারে নোট নিত ।
ঘটনাক্রম সাজাতো। উপন্যাসে রূপ দিত।
ফরিদুর মূলত একজন ঔপন্যাসিক। তরুণ বয়েস থেকেই জীবনে বিচিত্র বর্ণময় রূপ বিশাল ক্যানভাসে ধরতে চেয়েছে। এ ক্ষেত্রে তার আদর্শস্থানীয় কাউন্ট লিও তলস্তয়; যাকে গোর্কি মনে করতেন-স্বয়ং ঈশ্বর; ... গত কুড়ি বছরে বাজারে ফরিদুরের পাঁচটি উপন্যাস বেরিয়েছে।
তবে পাঠকমহলে তেমন সাড়া ফেলেনি। বিক্রিও তেমন হয়নি। কখনও ইন্টারভিউ বেরয়নি, টিভি থেকেও কেউই তাকে ডাকেনি। বরং কাগজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে ঋণ বেড়েছে। বাংলাবাজারের প্রকাশক তাকে এড়িয়ে চলে।
এসবই ফরিদুরের হৃদয়কে বিক্ষত করছিল।
তার চেনাজানা লোকজন অবশ্য তাকে ব্যাংক কর্মকর্তা বলেই জানে। ফরিদুর তাতে কষ্ট পায়। সে নিজেকে ঔপন্যাসিকই ভাবে। তারা বোঝেনা ব্যাংকের চাকরিটা জাস্ট বেঁচে থাকার জন্য।
নতুন বই বেরুলে স্বাক্ষর করে পরিচিত লোকজনদের উপহার দেয়। কেউই পড়েও দেখে না সম্ভবত। গ্রামীণ পটভূমিকায় লেখা ‘রাহেলার বিচিত্র জীবন’ নিয়ে একটি বিখ্যাত দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকিতে রিভিউ বেরিয়েছিল ২০০৪ সালে। তার জন্য অবশ্য হাজার দশেক টাকা খরচ হয়েছিল। তাতেও অবশ্য বইমেলায় উপন্যাসটির বিক্রি বাড়েনি।
হতাশা গ্রাস করছিল ফরিদুর হক কে।
রশীদাও বিয়ের পর থেকে তার লেখকজীবনকে খুব একটা সিরিয়াসলি নেয়নি। খুরশীদা মূলত শরৎচন্দ্রে ভক্ত। এমন কী আশাপূর্ণা দেবী কিংবা সেলিনা হোসেনের বই কিনে পড়ে খুরশীদা, তবে কখনও ফরিদুরের লেখা একটিও উপন্যাস কখনও পড়ে দেখেনি। রায়েরবাজারে তিনরুমের ভাড়া বাড়ি ফরিদুরের।
স্বামী সাহিত্যসাধনা করে- এই ভেবে- খুরশীদা কখনও ফরিদুরের লেখার সময় টিভির আওয়াজ কমায়নি । ফরিদুর দীর্ঘশ্বাস চেপেই লিখে গেছে-কোনওদিন হয়তো বিদগ্ধ পাঠকমহলে সাড়া ফেলে দিতে পারবে-এই আশায়।
খুরশীদা একটা স্কুলে পড়ায়। মাঝে-মধ্যে ওর কলিগরা আসে বাসায়। একবার ওর এক কলিগ-নাম শামীমা- এসে বলল, আপনি হুমায়ুন আহমেদের মতো লিখতে পারেন না ফরিদ ভাই? হুমায়ুন আহমেদের লেখায় কি টানটান উত্তেজনা থাকে।
ওহ্ ।
শামীমা আরও বলেছিল, আপনার লেখায় ফ্ল্যাশ ব্যাক আর ডেসক্রিপশন বেশি ফরিদ ভাই...
সে দিনই কোমল স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল ফরিদুরের। সরে গিয়েছিল পায়ের তলার মাটি ।
কেইউ টের পায়নি।
তবে খুরশীদার ওপর বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই ফরিদুরের।
মা হওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছে খুরশীদা; প্রায় পনেরো বছর। বড্ড দেরিতে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে খুরশীদা । বিয়ের সময় বয়েসে দশ বছরের ছোট ছিল খুরশীদা। ডিভোর্সের সময় পয়ত্রিশ। দু’বছর ধরে খোঁজখবর নেই।
শুনেছে নতুন স্বামীর সঙ্গে কিশোরগঞ্জে আছে। বাচ্চাকাচ্চার মা হতে পেরেছে কি না জানে না ফরিদুর।
আজ মেঘলা দিনের বিকেলের আগে রোদ উঠল।
বিছানার ওপর বসেছিল ফরিদুর। শূন্য বোধ হচ্ছিল তার।
মনে হচ্ছিল সে দিকচিহ্নহীন। দরজার কাছে রোদ। একটি কাক। কাকটিকেও দিকচিহ্নহীন বলেই মনে হল। হুশ করতেই উড়ে গেল।
ঠিক তখনই দরজায় একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল। অপরিচিত। সালাম দিল। শ্যামলা। সাদা ওড়না আর নীল রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা।
কাঁধে ঝুলি। ফরিদুর ঈষৎ বিস্মিত। আপনি?
আমার নাম জাকিয়া। আসব?
আসুন, বসুন।
জাকিয়া ভিতরে ঢুকল।
বসল। বলল, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ফিলোসফিতে।
ও।
আপনার লেখা আমার ভালো লাগে।
২০০৬ সালের বইমেলায় প্রথম আপনার বই কিনি। প্রচ্ছদ ভালো লাগল। নামটাও বুকে কাঁপন ধরালো।
কোন বইটার কথা বলছেন? ফরিদুরের বুকে ভীষণ তোলপাড় হচ্ছে।
‘অবরুদ্ধ জীবন’।
ওহ্ ।
জাকিয়া বলল, চোখের সামনে ১৯৭১ ভেসে উঠেছে। যেন আপনি সেই সময়টায় ছিলেন। লুৎফুরের আত্মত্যাগে আজও চোখে পানি আসে।
ফরিদুর বলল, হ্যাঁ।
মুক্তিযোদ্ধার কাহিনী। চার বছর রির্সাচ করতে হয়েছিল।
আপনি অনেক খেটে লিখেন। না?
গম্ভীর কন্ঠে ফরিদুর বলল, আমি ব্যক্তিজীবনে হয়তো অত সৎ নই, কিংবা অলস, তবে লেখালেখির ক্ষেত্রে সৎ এবং কঠোর পরিশ্রমী।
জানি।
কী ভাবে জানলেন আমি হাসপাতালে?
জানতাম না।
তাহলে?
আমার এক কাজিন জার্নালিষ্ট। সমকালের কাজ করে। ওকে আপনার কথা জিজ্ঞেস করতেই ওই খোঁজখবর করে জানাল।
ও।
আপনার শরীর এখন কেমন?
ম্লান হাসল ফরিদুর।
আপনার জন্য সুপ এনেছি।
ওহ্, সুপ।
জাকিয়া উঠে দাঁড়ায়। ঝুলি থেকে ফ্লাক্স বের করে ।
বিছানার ওপাশে একটা টেবিল। তার ওপর প্লেট আর গ্লাস সাজানো। যতœ করে গ্লাস ধুয়ে নেয় জাকিয়া। সুপ ঢালে। তারপর ফরিদুরের দিকে বাড়িয়ে বলে, নিন খান।
আপনিও নিন।
জাকিয়া হাসে। বলে, আমি তো খেয়েই এসেছি। বলে মুখোমুখি বসে। কথায় কথায় জানা গেল জাকিয়া বিবাহিতা।
স্বামী জাপানে চাকরি করে। নেক্সট উইকেই জাপান চলে যাচ্ছে। তার আগে প্রিয় লেখকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
ফরিদুর বিষন্ন বোধ করে।
ঝুলি থেকে ফরিদুরের নতুন বই বার করে জাকিয়া ।
‘এ অলীক জীবন’ । বলে, ফরিদ ভাই, একটা অটোগ্রাফ দিন।
জীবনে শেষ সইটি করে ফরিদুর। বুক কেঁপে ওঠে।
জাকিয়া বলে, আমি এখন যাই।
আপনি ভালো থাকবেন। আশা করি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
জাকিয়া চলে যায়।
তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে ।
ফরিদুরের বিষন্নতা গাঢ় হয়ে ওঠে।
এ সময় রেজাউল করিম আসেন। আজ আর এলেন না। হয়তো শরীর ভালো ঠেকছে না। শরীরে যক্ষার জীবাণু। মাঝে-মাঝে ভীষণ ক্লান্ত লাগে।
তাছাড়া মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন বৃদ্ধ। ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে থাকে। তারা বৃদ্ধ বাবাকে ঢাকারই কোনও ওল্ডহোমে রেখে যেতে চায়। রেজাউল করিম এর কষ্ট এখানেই। তিনি একবার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায় যেতে চান।
ছেলেমেয়েরা তার কথা হেসে উড়িয়ে দেয়।
পুরনো পত্রিকা টেনে নেয় ফরিদুর। সারাদিনে অনেকবারই পড়া হয়েছে। তারপরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। ক্ষীণ আলো।
অক্ষর ঝাপসা লাগে। বাস্তবের কামড়ে বড় অস্থির লাগে তার। স্বপ্নকল্পনায় আশ্রয় নিতে চায় ফরিদুর। কল্পনা করে খুরশীদা তার কাছে ফিরে এসেছে। সবুজ রঙের ডুরে শাড়ি পরে।
যেভাবে স্বপ্না আসত ফরিদুরের তরুণ জীবনে ।
ফরিদুরের কলেজ জীবন কেটেছে মানিকগঞ্জ শহরে। ছোট চাচার বাড়ি থেকে পড়েছে। এস.কে সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের উলটো দিকে আস্তরহীন একটি বাড়ির দোতলায় এক ঘরে ঠাঁই হয়েছিল। মানিকগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘আলোর বাণী’তে কবিতা লিখত।
স্বপ্না কে পড়ে শোনাত সে কবিতা। স্বপ্নাকে নিয়ে কয়েকবার সিনেমা দেখেছিল। সিঁড়িঘরে চুমু খেয়েছিল। ছোট চাচী দু’পক্ষের মেলামেশা পছন্দ করেনি, প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। আই. এ পরীক্ষার সময় স্বপ্নার বিয়ে হয়ে যায়।
পড়া ফেলে বিয়ে বাড়িতে খাটতে হয়েছিল। এ রকম নিদারুন অভিজ্ঞতা লেখার কাজে আসবে বলে মুখ বুজে সহ্য করেছিল ফরিদুর। ঘিওর থেকে বরযাত্রী এল। চোখের সামনে কনে দেখা আলোয় স্বপ্নাকে নিয়ে গেল তারা। স্বপ্নার অনুপস্থিতি দীর্ঘদিন যন্ত্রণা দিয়েছিল ফরিদুরকে।
বছর দশেক পর খুরশীদার বেশে আবার ফিরে এল স্বপ্না ।
নতুন বউকে নিয়ে অশেষ আশা ছিল ফরিদুরের। ফরিদুর মূলত ঔপন্যাসিক। খুরশীদাকে পান্ডুলিপি পড়ে শোনাত। খুরশীদা কখনও তেমন উৎসাহ বোধ করেনি।
শরৎচন্দ্রে মগ্ন হয়ে ছিল। ফরিদুর নিজেও শরতের ভক্ত, কিন্তু,কখনও ভাবেনি - শরৎ এভাবে তার প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠবে । এমন কী রাবেয়া খাতুনের বইও কিনে পড়ত খুরশীদা, অথচ ...অথচ ফরিদুরের বই ফেলে রাখত। বলত, তোমার লেখায় গল্প নেই, খালি দীর্ঘ বর্ণনা। সংলাপও তেমন নেই।
শরতের অনেক লেখা সাবলীল সংলাপ দিয়ে শুরু।
ফরিদুর খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করে বলত, আহা, সংলাপ হলেই সাহিত্য হয় না, সাহিত্য হল জীবনকে খোঁড়া। জীবনকে না খুঁড়লে সাহিত্য হয় কী ভাবে বল? তার জন্য পটভূমি তৈরি করতে হয়-যা হুমায়ূন আহমেদ পারেন না, কিংবা বইয়ের কাটতি কমে যাওয়ার আশংকায় করেন না, যে কারণে তাঁর লেখায় গভীরতা নেই। তুমি কায়েস আহমেদ এর লেখা পড়নি? ‘অন্ধ তীরন্দাজ’ কিংবা ‘নির্বাসন’?
খুরশীদা চুপ করে থাকে।
ফরিদুর বিপন্ন বোধ করে।
তবুও এই সঙ্গহীন সন্ধ্যায় সেই খুরশীদাকেই কল্পনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চায় ফরিদুর।
খুরশীদার বদলে নার্স এল ।
নার্সের নাম নীপা সাহা। এরই মধ্যে অল্পবিস্তর পরিচয় হয়ে গেছে। অবিবাহিতা।
গ্রামের বাড়ি গৌড় নদী। দীর্ঘদিন জন্মস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন। ছুটিছাঁটায় দেশের বাড়ি যায় না। হাসপাতালে নিজের লেখা ক’টা বই এনেছে ফরিদুর। নীপা সাহাকে-আমি একজন লেখক বলে- একটি বই সই করে উপহারও দিয়েছে।
নীপা সাহার তেমন ভাবান্তর হয়নি, মুখচোখে তেমন সমীহ ভাবও ফোটেনি। আসলে মৃত্যুময় একটি নীরস পরিবেশে থাকে।
আজও নীপা সাহা যান্ত্রিক স্বরে বলল, কাল সকাল আটটার আগে কিছু খাইবেন না কইলাম।
কেন?
বেলাড টেস্ট করাইতে হইবে। প্রোফেসর সাহেব বোলছেন।
ফরিদুর জিজ্ঞেস করে, সেদিন যে এক্সরে করা হল -তার কী খবর?
নীপা সাহা বলল, রিপোর্ট ভালো না। ড. ইলাহী বোললেন।
অনেক মৃত্যু দেখে অভ্যস্ত এরা। এরা এভাবে নির্মোহ ভাবে বলতে পারে। ফরিদুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
১৩ নং কেবিনের মহিলা মারা গেল গত বৃহস্পতিবার। মহিলা এসেছিল রাজশাহী থেকে। বেশ আলাপ হয়েছিল। অনেক আত্মীয়স্বজন দেখতে আসত। কত কী যে খাওয়াত মহিলা।
ফরিদুর গুমোট বোধ করে।
নীপা সাহা বলল, আপনার রিলিজ অরডার কইলাম শিঘ্রই হইয়া যাইবে । বাসায় গিয়া প্রেরেকতেক দিন অষুধ খাইবেন, ঝোঝলেন। নাইলে কইলাম এমডিআর হইয়া যাইবে। তহোন বোঝবেন, খরচ যেমুন, কষ্ঠও তেমুন।
ফরিদুর হাসল।
নীপা সাহা চলে যায়।
বৃদ্ধ রেজাউল করিমের সঙ্গে নীপা সাহার উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। দু-জনই একই অঞ্চলের। দু-জনই দীর্ঘদিন জন্মস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন।
যে কারণে, দু-জনের আলাপ দীর্ঘস্থায়ী হয়, যা এক নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করেছে। এ বিষয়টি উপন্যাসে ফুটিয়ে তোলার কথা ভাবে ফরিদুর । তবে উৎসাহ পায় না। পরক্ষণেই জাকিয়ার মুখটি মনে পড়ে যায়। আমার লেখা পঠিত হয়, অন্তত সে কথা বলতে জাকিয়া তো এল।
শূন্য বাড়িতে ফিরে নতুন উপন্যাসে হাত দেবে ফরিদুর।
রাত দশটার দিকে হাসপাতাল ঝিমিয়ে যায়। কেবিনের বাইরে টানা বারান্দা। দেওয়াল ঘেঁষে কাঠের বেঞ্চ পাতা। কখনও ওখানে অনেক রাত অবধি বসে থাকে ফরিদুর।
আজও বসল। গ্রিলের ওপাশে দীর্ঘ দীর্ঘ গাছ। বড় একটা মাঠ। বস্তি। ওই দৃশ্যগুলো কখনও বৃষ্টিতে ভিজে কখনও জোছনায় ছেয়ে যায়।
আজ সকালে রেজাউল করিম চলে গেলেন ... যেখানে গেলে কেউই কখনও ফেরে না, সেখানে চলে গেলেন বৃদ্ধ। বড় নিঃশব্দেই চলে গেলেন বৃদ্ধ। যাওয়ার আগে বৃদ্ধ কিছু বলে যায়নি। ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে থাকে বলে বাবার জন্য ওল্ড হোম এর ব্যবস্থা করেছিল- এইই ভালো হল , বৃদ্ধ ভাগ্যবান। ওল্ড হোমে থাকতে হল না।
মৃত্যুর আগে একবার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায় ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, সে সাধ অপূর্ণই রয়ে গেল। দীর্ঘদিন সিগারেট খেয়েছেন বৃদ্ধ, হাসপাতালে এসেও গোপনে সিগারেট খেতেন। সিগারেট খাওয়ার তৃষ্ণা আর জ্বালাবে না বৃদ্ধকে।
নীপা সাহাকে আজ গম্ভীর দেখাল। সত্যিই কি বৃদ্ধ রেজাউল করিমের হৃদয়ের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল নার্সটি? আজ বিকেলে নীপা সাহা বলল, আমি চইল্লা যাইতেছি।
কই?
গেরামে।
কেন?
শহরে আর ভাল লাগে না।
ও। কি করবে?
গেরামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ামু।
আসলে রেজাউল করিমের মৃত্যু ওকে কাতর করে তুলেছে।
রেজাউল করিম মৃত্যুর আগে জন্মভূমিতে ফিরতে পারেনি।
নীপা সাহা ভয় পেয়েছে। যদি ও জন্মভূমিতে না ফিরতে পারে। তাই ও গৌড় নদী চলে যেতে চায়।
রাত বাড়ে।
জুন মাসের মাঝামাঝি। উথালপাতাল হাওয়া। মাঠে জোছনার ঢল । সে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে পায়ে রেলিংয়ের কাছে চলে আসে।
বাতাস ওকে ধাক্কা মারে। আমি চলে যাওয়ার আগে একবার খুরশীদাকে কি দেখতে পাব না? ফরিদুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে সান্ত্বনা দেয়-খুরশীদা এল না, জাকিয়া তো এল। কত যত্ন করে সুপ রেঁধে আনল। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ফরিদুরের সাহিত্যজীবন সার্থক হল।
গ্রিলের ফাঁকে হাত বাড়ায় ফরিদুর।
টলটলে জোছনা কেমন নীল রঙের ফুল হয়ে উঠে তার করতলে ঝরতে থাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।