এক্সট্রা এনার্জি এক্সচেঞ্জার
হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ২০০১-২০০৯ পর্যন্ত নিউইয়র্কের সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর জন্ম ১৯৪৭ সালে শিকাগোতে। ২০০৯ সালের ১৩ মে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়েরসমাবর্তনে তিনি এই বক্তৃতা করেন।
ধন্যবাদ, তোমাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। এর চেয়ে ভালো আর কি কিছু হতে পারে, পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন নিউইয়র্ক ইরাঙ্কির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে? কোনো কিছুই হতে পারে না। আমি এ সম্মানকে গ্রহণ করতে পেরে গর্বিত। তাই সবাইকে ধন্যবাদ। সমাবর্তনের এ বিশাল আয়োজন ও সব স্নাতকধারী, তাদের পরিবার ও বন্ধুজনদের দেখে আমি এটাই বলতে চাই যে তোমরা এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে এ সম্মান গ্রহণ করতে যাচ্ছ।
এই মুহূর্তটি দেশ ও সারা পৃথিবীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তরুণ প্রজন্মের মেধা, শক্তি, উৎসাহ ও দায়বদ্ধতা এখন তাদের খুব দরকার। আমি মনে করি, তোমরা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত এ পৃথিবীর জন্য, যা এখন অস্থিতিশীল। কিন্তু পৃথিবী অবশ্যই তোমাদের শিক্ষাকে আন্তরিকতার সঙ্গে অভিবাদন জানাবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী (সেক্রেটারি অব স্টেট) হিসেবে আমি চলমান পৃথিবীর সব ধরনের চ্যালেঞ্জ সম্বন্ধে সচেতন।
ক্ষুধা, দারিদ্র্য, আদর্শবাদগত দ্বন্দ্ব, মহামারি ও নিউক্লিয়ার শক্তির ক্রমবর্ধনশীলতাসহ এ চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে আমরা মুখোমুখি হই প্রতিনিয়ত। তোমরা নতুন এই স্নাতকেরা এবং তোমাদের প্রজন্ম এ চ্যালেঞ্জগুলোকে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করবে। আমি জানি, আমরা যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই থাকি না কেন, এগুলো থেকে নিজেদের ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় নেই। আর এ চ্যালেঞ্জগুলো কখনোই মানব-প্রচেষ্টা, সহযোগিতা কিংবা নির্ভরশীলতাকে হ্রাস করতে পারবে না। এগুলো আমাদের এক করবে, সে বন্ধন আমাদের শক্তি জোগাবে।
তাই আমাদের চ্যালেঞ্জ হবে সব ভালোকে নিয়ে এক হয়ে কাজ করা। কারণ আমরাই পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে তুলব আগামীর জন্য।
অনেক বছর আগে আমি যখন স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন দেখেছি, কূটনীতি ছিল কিছু সুবিধাভোগী মানুষের চিন্তার ক্ষেত্র, যারা বন্ধ দরজার মধ্যে সংকীর্ণ পরিবেশে কাজ করত। বর্তমানে আমাদের কূটনীতিবিদদের ক্ষেত্রটি আর সীমিত পরিসরে আবদ্ধ নেই। আমাদের কূটনীতিচর্চাও আর স্টেট বিভাগ ও এম্বাসিগুলোর মধ্যে নিবৃত্ত নেই।
আমাদের একবিংশ শতকের দেশ পরিচালনার ভিত্তি তৈরি হয় এসবকে নিয়েই, নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে, বড় শহরগুলোর ব্যবসায়ীদের আলোচনা কক্ষে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলঘরে, তোমাদের আড্ডায় এবং বড় হাসপাতালগুলোর পরিচালনা কক্ষে। আমাদের চিন্তাশীল ক্ষেত্রে তোমরা এসে প্রবেশ করো। আমাদের কর্মতৎপরতায় তোমাদের অংশগ্রহণ আমাদের প্রভাবিত করে।
পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তারকারী অনেক চ্যালেঞ্জই আমাদের সঙ্গে ভবিষ্যতে মোকাবিলা করবে বিশ্বের শতকরা ৬০ ভাগ জনসংখ্যা, যাদের বয়স ৩০ বছরের নিচে। তরুণ প্রজন্ম অবশ্য এর মধ্যেই নিজেদের মেধা, কৌশল ও উদ্ভাবনী শক্তিকে ব্যবহার করে অভিনব কাজ করছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং রাজনীতি ও কূটনীতিচর্চাকে ভিন্ন আকার দিয়েছে।
যেমন: কলম্বিয়ায় দুজন স্নাতক ফেসবুক ব্যবহার করে প্রায় দেড় কোটি মানুষকে একত্র করেছে; সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে একটি দীর্ঘতম শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এসবই ইতিহাসকে বদলে দেয়। তাদের শান্তিপূর্ণ প্রচেষ্টা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্ককে যতটা ধ্বংস করেছে, তা বছরের পর বছর সামরিক সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েও সফল করা সম্ভব নয়।
আমি জানি, তোমাদের মধ্যে একজন কিলিমানজারো পর্বতের ঢালে মাসের পর মাস ধরে একটি উন্নয়ন প্রকল্পের মডেল তৈরির জন্য কাজ করছে, যা নারী ও পরিবারকে নিয়ে দারিদ্র্য দূর করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। তোমাদের আরেকজন সহপাঠী গত বছর চীনে ভূমিকম্পে আহত ব্যক্তিদের ত্রাণ ও সাহায্যের জন্য দিনরাত কাজ করেছে।
ত্রাণ পৌঁছাতে চলে গেছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছে রুয়ান্ডায়। জাতিগঠন, বাণিজ্য পুনঃস্থাপন ও সরকার চালনায় জর্জিয়ায় কাজ করেছে পরিশ্রমের সঙ্গে। তরুণ প্রজন্মের তোমরা অনেকেই সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বারাক ওবামাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচারণা চালিয়েছ। তাই প্রেসিডেন্ট ওবামা ও আমি তরুণ প্রজন্মের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতার সঙ্গেই অবগত।
আমি মনে করি, প্রতিটি দেশের তরুণদের সুযোগ গড়ে দিতে হবে, যেখানে তারা তাদের বিশ্বাস ও আদর্শকে কর্ম এবং বাস্তবতায় রূপান্তর করতে পারে। দেশের নেতৃত্বদানকারীদের এ ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া উচিত, যাতে তাঁরা তোমাদের ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে পারেন। সে কারণে আমরা স্টেট বিভাগসহ সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বের সঙ্গে নির্দেশনা দিই, যাতে তারা এ মূল্যবান জনমতকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করে।
আমি জানি, তোমাদের জন্য নতুন কোনো ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়ার দরকার নেই। তোমাদের নতুন করে কোনো কিছু শুরুর অপেক্ষা করতে হবে না।
আমাদের বিশ্বায়নের আশীর্বাদে জীবন হয়ে গেছে অনেক গতিশীল।
আজ বাড়ি ফিরে অনলাইন ইন্টারনেটের মধ্য দিয়ে ‘কে-আই-ভি-এ’ (কিভা) নামের ওয়েবসাইটটি ব্রাউজ করে দেখতে পারো, যেখানে তোমরা সান মা নামের একজন ভিয়েতনামের মাকে সাহায্য করতে পারো, যে ধানের বীজ আর সার কেনার জন্য ক্ষুদ্রঋণ খুঁজছেন। কিংবা হেইভার ইন্টারন্যাশনাল ওয়েবসাইট লগ অন করে এশিয়া ও আফ্রিকার কোনো এক ক্ষুধার্ত পরিবারকে কিছু অনুদান দিতে পারো। সাহায্য করতে পারো ওয়ানগারি মাথাইকে, তাঁর সবুজ বিপ্লবের কর্মকাণ্ডে। মানুষের প্রতি তোমাদের এ সাহায্যের হাত এবং পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য তোমাদের এ পদচারণ শুধু একটি সামান্য বিষয় বা ব্যক্তিকে বদলে দেয় না, এটি বদলে দেয় পুরো পৃথিবীকে।
তোমাদের সারা বিশ্বের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ পৃথিবীর সঠিক অনুশাসনকে প্রতিষ্ঠা করে। তাই আমাদের প্রয়োজন, সচেতন নাগরিক, যারা ঘর থেকে শুরু করে সমাজ ও দেশকে জবাবদিহি করবে।
আমাদের এখন প্রত্যেককে প্রয়োজন সবার জন্য। এ প্রয়োজন সব সময়ই ছিল। আজকের পৃথিবীতে এটি আরও পরিষ্কার।
যেকোনো মহামারি আজ একটি দেশ থেকে শুরু হয়ে দ্রুত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়। কোনো একটি আগ্রাসী আদর্শবাদ অল্পসংখ্যক মানুষের কাছ থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিস্তৃত হতে থাকে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব ক্ষতিগ্রস্ত করে বৃহৎ একটি ব্যাংক, বিমাপ্রতিষ্ঠানসহ ব্যবসায়ী প্রকল্প থেকে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে অবস্থানরত একজন সামান্য কৃষককে। এগুলো আজকের বাস্তবতা। কিন্তু আমাদের কাজে এ যুগে এমন কিছু মাধ্যম আছে, যা সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করতে পারে।
সবার জন্য যা হুমকির সৃষ্টি করে, তার বিরুদ্ধে একত্রে অগ্রসর করতে পারে।
এখন তোমাদের কাছে আছে এক ঐতিহাসিক সুযোগ। একে কাজে লাগাতে হবে। আমি জানি, আজকের এ অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে তোমরা বিশ্বব্যাপী মন্দা সম্পর্কে অবগত। এ সময়টা হয়তো তোমাদের স্নাতকদের জন্য কঠিন ও প্রতিকূল।
কিন্তু এখনই সে সময়, যখন আমরা সবাই একত্রে জেগে উঠেছি। আমি জানি, আমাদের সামনে অনেক বাধা ও সম্ভাবনা আসবে। আমরা কেউ তা বলতে পারব না। তাই সামনের পথ হবে কঠিন। কিন্তু তোমাদের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বিমা, যা তোমরা অর্জন করেছ, তা হলো নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা।
আর তাই এ শিক্ষাকে ঢাল বানিয়ে নাও। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমরা কঠোর পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় নিজের সাফল্যকেই শুধু নিশ্চিত করবে না, নিজের ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে ছাড়িয়ে বৃহৎ ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে। পরিবর্তনকে থামিয়ে রাখার কোনো পথ নেই। পরিবর্তন আসবেই। আমাদের শুধু সতর্ক থাকতে হবে, পরিবর্তন আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে, না দুর্যোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
আজকের এ শুভক্ষণটি শুধু তোমাদেরই। যাও, এই বিশ্ববিদ্যালয়কে, এই শহরকে, দেশকে ও পৃথিবীকে একটি মূল্যবান ভবিষ্যৎ প্রদান করো, যা নির্মাণের স্বপ্ন দেখি আমরা সবাই। ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা ও যাত্রা সফল হোক।
(প্রথম-আলো)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।