পুরাই হতাশ
একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশের বন্ধুত্ব হতে পারে। তদ্রূপ একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের বন্ধুত্ব হতে পারে। এই বন্ধুত্ব টিকে থাকার জন্য উভয় পক্ষেরই মতের মিল ও চিন্তার মিল অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। বন্ধুত্ব চির অটুটভাবে বজায় রাখতে হলে দুই পক্ষেরই সমান ভূমিকা থাকতে হবে। সাধারণত সমাজে ধনীর সঙ্গে ধনীর বন্ধুত্ব, হয়; মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে কিন্তু ধনীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠলেও সেটা বেশিদিন টিকে থাকে না।
এর পেছনের কারণ অর্থ বা বিত্ত। তদ্রূপ একটি ধনী দেশের সঙ্গে আরেকটি ধনী দেশের বন্ধুত্ব হয়ে থাকে। ধনী দেশগুলোর সঙ্গে স্বার্থের লড়াইয়ে হেরে যায় বলেই ক্ষুদ্র দেশগুলো যেমন—দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আশিয়ান ও সার্কভুক্ত দেশ নিয়ে জোট বেঁধে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা হয়, আঞ্চলিক উন্নয়নের স্বার্থে। আরবি ভাষাভাষী দেশ নিয়ে আরব লীগ গঠিত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন দৃঢ়তর হয়েছে—আশির দশকের শেষদিকে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলার মাধ্যমে।
একটি মুদ্রা ‘ইউরো’ চালু করেছে তারা। সীমান্ত থাকলেও চলাচলের কঠোর বিধি-নিষেধে শিথিলতা রয়েছে; কিন্তু এই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। আন্তর্জাতিক যে কোনো ইস্যু বা স্নায়ুযুদ্ধ ইত্যাদির ব্যাপারে তারা সমসুরে একই বক্তব্য প্রদান করে থাকে। বিশেষ করে ইরান, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার, কিউবা, ভেনিজুয়েলা—এসব রাষ্ট্রের ব্যাপারে; এবং তাদের স্বাধীন কর্মকা ে দ্বিমত পোষণ করে থাকে। একই কারণে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে রয়েছে বণিক রাষ্ট্রগুলোর সুসম্পর্ক।
যত দোষই সে করুক না কেন—সেটা দোষ হিসেবে দেখতে নারাজ পশ্চিমা শক্তিগুলো। ইরাক ও আফগান পরিস্থিতিতেও তাদের রয়েছে অভিন্ন নীতি। এখানে রয়েছে তাদের বাণিজ্য স্বার্থ এবং এশিয়ায় প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্য এ দুটো দেশই শুধু নয়, পাকিস্তান-বাংলাদেশ এমনকি ভারতকেও হাতে রাখতে চাইবে তারা চীন ও রাশিয়ার মাতব্বরি এ অঞ্চলে তারা কখনওই মেনে নেবে না। যার কারণেই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় একটি অস্থিতিশীল অবস্থা সব সময় বিরাজ থাকুক, সেটা প্রভু রাষ্ট্রগুলো এবং দাতা সংস্থাগুলোও চায়। এ জন্যই বলতে হয়, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার (জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়া) সঙ্গে প্রভু রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্কটা বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে মানসিক দাসত্বের পর্যায়ে গিয়ে পড়ে।
প্রতিবেশী হলে দুটো রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারে। কোনো কিছুর বিনিময়ে যদি হয় সেটা যদি বাংলাদেশের বা ভারতের দুই পক্ষেরই সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা থাকে—তাহলে সে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া থেকে দুই পক্ষেরই বিরত থাকতে হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা নষ্ট হওয়ার পেছনে কারণ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। একই ধর্মে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও সে সম্পর্ক টিকে থাকেনি। ২৪ বছরের মধ্যেই সে সম্পর্কে চির ধরে—একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপ নেয় বাংলাদেশ।
মানসিকভাবে আমাকে দাস বানিয়ে রাখবেন, ওপরে ঝুলিয়ে রাখবেন—বন্ধুত্ব নামক একটি শ্লোক শব্দ। এভাবে বন্ধুত্ব টিকে থাকেনি কোনো রাষ্ট্রে অদ্যাবধি। পাকিস্তানের অন্যায় আচরণ যেভাবে ২৪ বছর ধরে বাঙালিরা মেনে নেয়নি; তদ্রূপ ভারত যদি মনে করে, পাকিস্তানি স্টাইলে বাংলাদেশের ওপর প্রভুত্ব বজায় রাখবে, তাহলে সে বন্ধুত্ব কচু পাতার পানির মতো টলটলায়মান অবস্থায় থাকবে বটে; কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেটা বিনষ্ট হয়ে যাবে। ভারতকে মনে রাখতে হবে—বাঙালিরা পাকিস্তানের জুলুম, শোষণ, অত্যাচার যেভাবে মেনে নেয়নি—সেরকম পরিস্থিতি যদি ভারত সৃষ্টি করে, তাহলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যত চুক্তি হোক না কেন, সেটা চুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বাস্তবে কিন্তু বন্ধুত্বের মধ্যে বিরাট ফাটল সৃষ্টি হবে।
সেরকম কিছু আলামত বহুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৪ সালের চুক্তি মোতাবেক বেরুবাড়ী হস্তান্তরের বিনিময়ে দীর্ঘ ৩৫ বছর অতিক্রম হয়ে যাওয়ার পরও মাত্র তিন বিঘা করিডোর এখনও আমাদের মালিকানায় আসেনি। ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলে ৩০ সালা পানিচুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ খরা শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি থেকে বঞ্চিত থাকছে। এই চুক্তিও বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের যে চুক্তি হয়েছিল সেখানে তিস্তার পানির সুষ্ঠু বণ্টনের কথা উল্লেখ ছিল এবং এ রকম একটা কথাও উভয়পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল যে তিন মাসের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
অথচ ১০ মাস হয়ে গেল। এর মধ্যে আগস্ট মাসে ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব বাবুও এলেন ৬ ঘণ্টার ঝটিকা সফরে। সেখানে তিস্তা প্রসঙ্গে কোনো কথা ভারতীয় মন্ত্রী উচ্চারণ করেননি। এ ব্যাপারে আমাদের নিরাশ করল ভারত সরকার। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বহু ঝড়-ঝাঁপটা বয়ে গেছে উপমহাদেশে।
ভারতের ভূখ থেকে তীব্র প্রতিবাদ উঠেছে—এই বাঁধ নির্মাণ করলে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের টিপাইমুখ অঞ্চলের ব্যাপক অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত এসব কথায় কর্ণপাত করেনি। জোর যার মুল্লুক তার—অনেকটা এই নীতিতে বলেই ফেলেছে, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আলি আকবর খান প্রথম আলো পত্রিকার ৫ সংখ্যায় দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছেন।
পানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত দীর্ঘ সাক্ষাত্কার দিয়েছেন গণমাধ্যমের কাছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বৃহত্তর সিলেট থেকে শুরু করে ভৈরব পর্যন্ত এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাবে। জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি শুধু এ কারণেই ঘটবে না, প্রায় লাখের অধিক জেলে পরিবারে নেমে আসবে অচলাবস্থা। ভারত স্বদেশের বিশেষজ্ঞদের কথা যেমনি শোনেনি, ঠিক তেমনি বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশের অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের কথা শোনেনি। এরপর আরও কাহিনী আছে—ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের শতাধিক ছিটমহল অমীমাংসিত অবস্থায় দীর্ঘ ৩৯ বছর পর্যন্ত ঝুলে আছে, যার আশু কোনো সমাধানের কথা ভারত বলছে না।
এই সব ছিটমহলবাসী নিদারুণ দুঃখ-কষ্টে মানবেতর দিন যাপন করছে—তারা জানে না তাদের দেশ কোনটি। এক কথায় এই ছিটমহলের অধিকাংশই ভারতের দখলে। এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার যে একেবারে নীরব ভূমিকা পালন করছে তাও নয়; কিন্তু বাংলাদেশের দাবির পক্ষে কোনো ইতিবাচক সায় দিচ্ছে না ভারত। একইভাবে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ প্রশ্নে অর্থাত্ প্রাপ্য অংশের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক কোনো আলোচনার টেবিলে বসার আগ্রহ প্রকাশ করছে না ভারত। অথচ ভারতের প্রতিটি দাবি বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, বেরুবাড়ী হস্তান্তর করেছে। উদার বাণিজ্যনীতি মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য বৈষম্য বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও ট্রানজিট দিয়েছে। ভারতের জন্য ক্ষতিকর কোনো সন্ত্রাসী ঘাঁটি থাকতে পারবে না—এ ধরনের শুধু অঙ্গীকারই নয়, সেভেন সিস্টারের স্বাধিকারের জন্য আন্দোলনরত কয়েকজন নামকরা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে তার প্রমাণও দিয়েছে। পত্রিকায় দেখি, ভারত-পাকিস্তান নাকি একে অপরের শত্রু।
সেখানে বিএসএফ সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া পাকিস্তানিদের গ্রেফতার করে, গুলি করে না। কিছুদিন আগে বিএসএফের ক্রোকোডাইল ইউনিট ভারতের জলসীমা থেকে গ্রেফতার করেছে ছয় পাকিস্তানি জেলেকে। গোলাগুলির ঘটনা সেখানেও ঘটে মাঝেমধ্যে; কিন্তু গুলিতে আহত করে—একেবারে মেরে ফেলা হয় না। আন্তর্জাতিক রিপোর্টে যে তথ্য দেখলাম তাতে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে। দুঃখজনক, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রতিদিন আমরা যে সংবাদ পাই, সেটা গ্রেফতারের ঘটনা নয়, ফাঁকা গুলির ঘটনাও নয়— সেটা হলো একেবারে শেষ করে প্রাণবায়ু বের করে দেয়ার ঘটনা।
ডাইরেক্ট শুট—একেবারে মাথায় অথবা বুকে। মাছ ধরতে গিয়ে, গরু চড়াতে গিয়ে, গাছে ফল পাড়তে গিয়ে খুন হয় যুবক-কৃষক ভাইয়েরা। বাবার খাবার নিয়ে যাওয়া কিশোরীও খুনের তালিকায় থাকে। ফসল কাটতে গিয়ে খুন হয় বৃদ্ধ কৃষক। শত্রু দেশ আর বন্ধু সরকারের আমলের মানুষের খুন।
পার্থক্যটা কোথায়। অপরাধ করলে অপরাধীর শাস্তি হবে। গ্রেফতার করা হবে, ধরতে না পারলে হাতে-পায়ে জখম করে পাকড়াও করবে। একেবারে মাথা এবং বুককে নিশানা করে গুলি করা—এটা তো বন্ধুত্বের পরিচয় হতে পারে না। পাকিস্তান আমলে শুনেছিলাম, এই বিএসএফ-ইপিআরের (বিডিআর) ভয়ে মানুষ বর্ডারের ৫ মাইল ভেতরে থাকত।
সীমান্তে আসার সাহস পেত না। এখন তারা বন্ধুত্বের পরিচয় দিচ্ছে পাখির মতো গুলি করে। ১৭ আগস্টের বিবিসি সংবাদ শুনলাম—সেখানে সাক্ষাত্কার অনুষ্ঠানে ভারতীয় সিকিউরিটি ফোর্সের সাবেক প্রধান বললেন, খুনের মতো কাজ করলে খুন তো করতেই হবে। বিবিসির ভাষ্যকার বললেন, প্রতিদিন এভাবে অপরাধের বিচার না করে প্রমাণহীন খুন করা কতটা যৌক্তিক। বিএসএফের সাবেক প্রধান বললেন, কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে যে আসে তার সততা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
বিবিসি বলল, একেবারে খতম না করে হাতে পায়ে গুলি করে আহত করা যায় না? উত্তরে বিএসএফ প্রধান বললেন, রাতের অন্ধকারে হাত-পা তো দেখা যায় না। বিবিসি বলল, বাংলাদেশ তো এ রকম কর্মকা করে না। উত্তরে তিনি বললেন, ভারতীয় লোকজন বাংলাদেশের মতো অপরাধজনিত কর্মকা। এ জন্যই বললাম এবং লিখলাম—বন্ধুত্ব মানে মানসিক দাসত্ব নয়। বন্ধুত্বের অর্থ এই নয় যে আপনি অন্যায় করবেন তার বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না।
বন্ধুত্ব অর্থ একসময়ের উপকারের কথা স্মরণ করে পরবর্তী সময়ের সব সর্বনাশ ও ধ্বংস সহজভাবে মেনে নেয়া নয়। পৃথিবীতে এ ধরনের বন্ধুত্বের নজির অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশে তার ভূরি ভূরি হদিস মিলবে। ২০১০ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১৯ মাসে সীমান্তে নিহতের সংখ্যা ২০০ পেরিয়ে গেছে। এ জন্য নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া আর কাকে দোষ দেয়া যায়
আমারদেশ হতে নেয়া..
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।