আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাস্তুহারার রাজনীতি একটি ৬ মঈনুল রোড কাহিনী -(সংবাদের উপ সম্পাদকীয়)



বাস্তুহারার রাজনীতি মুনীরুজ্জামান 'আমার জন্য আপনারা দোয়া করবেন। আমি আজ বাস্তুহারা। ' বলেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। গত বুধবার দুপুুরে রাজধানী ইস্কাটন গার্ডেন লেডিস ক্লাবে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তিনি সাংবাদিকদের একথা বলেন। উল্লেখ্য, গত ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়া ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল সড়কের বাড়ি ছেড়ে আসেন।

যে বাড়িটি ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তাকে দেয়া হয়েছিল দুঃসময়ের সময় পার করার জন্য। বিরোধীদলীয় নেত্রীর বিলাপ 'আমি আজ বাস্তুহারা' খবরের কাগজে পড়ার পর, মনে পড়ে গেল পাকিস্তানি শিল্পপতি আদমজীর সেই উক্তির কথা। গত শতাব্দীর দু'দশকের শুরুতে আমেরিকার টাইমস ম্যাগাজিন (অথবা নিউইয়র্ক টাইমস) পাকিস্তানি এ শিল্পপতির ছোট্ট একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছিল। সেখানে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, (আমি এক গরিব পাকিস্তানি কোটিপতি)। আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রীও কি এক কোটিপতি বাংলাদেশি বাস্তুহারা? আমার যতদূর মনে পড়ছে ২০০৭ সালের ৬ আগস্ট তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে তার আয়কর রিটার্নে সম্পদের যে বিবরণী দিয়েছিলেন, তাতে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করেছিলেন ৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকার সমপরিমাণ।

প্রশ্নহলো_ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ যার সাড়ে তিন কোটি টাকার সমান, তিনি কী করে বাস্তুহারা হলেন_ সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। বিরোধীদলীয় নেত্রী শুধু যে ঘোষিত সাড়ে ৩ কোটি টাকার মালিক তাই নয়; তিনি অঘোষিত অর্থের নামে কালো টাকার মালিকও ছিলেন, সেটা নিজেই আদালতে বলেছেন। এই অঘোষিত অর্থের আয়কর নিতে রাজস্ব বোর্ড অস্বীকৃতি জানালে ২০০৭ সালের ৫ নভেম্বর তিনি হাইকোর্টে এনবিআরের বিরুদ্ধে রিট করেন। রিট আবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন বাড়ি ভাড়া থেকে অর্জিত ৩৬ লাখ টাকার কর হিসেবে তিনি ৯.৪৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হয়েও যিনি আয় গোপন করতে পারেন বা কালো টাকা সাদা করতে পারেন, তার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা আমার উদ্দেশ্য নয়; এরপরও তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারেন কি না সেই প্রশ্নও আমি এখানে তুলছি না।

আমার প্রশ্ন হলো বাড়ি ভাড়া হিসেবে যিনি বছরে ৩৬ লাখ টাকা আয় করতে পারেন তিনি বাস্তুহারা হলেন কিভাবে? লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, আয়কর রিটার্নের সম্পদ বিবরণীতে তিনি নিশ্চয়ই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ৬নং শহীদ মইনুল সড়কের বাড়িটির উল্লেখ করেননি, করলে স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে সম্পদের পরিমাণ মাত্র ৩.৫৪ কোটি টাকার সমপরিমাণ হতো না। অর্থাৎ তিনি এটা ভোলেননি যে, এই বাড়িটি তার নয়। আর বাড়ি ভাড়া থেকে আয় দেখিয়েছেন অর্থাৎ তার একটি বাড়ি রয়েছে যেটা সরকারেরই দেয়া। তাহলে তিনি বাস্তুহারা হলেন কী করে? হয় তিনি 'বাস্তুহারা' শব্দটির সঠিক অর্থ জানেন না, না হয় নতুন কোন অর্থ আরোপ করতে চাচ্ছেন শব্দটির ওপর। অথবা নিজেকে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত এবং অসহায় হিসেবে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপিত করে রাজনীতি করতে চাচ্ছেন 'বাস্তুহারা' হিসেবে।

না হলে 'বাস্তু'র মালিক যিনি তিনি নিজেকে 'বাস্তুহারা' হিসেবে ঘোষণা করবেন কেন? এর মধ্যে গৌরবটা কোথায় সেটা আমাদের বোধগম্য নয় এবং তিনি ১৩ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে এসে টেলিভিশনে যে কান্নাকাটি করেছেন, তার মধ্যেইবা গৌরবটা কোথায়, সেটা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। সেটা এই কারণে, অসত্যের ওপর দাঁড়িয়ে যে সত্য রচনা করা যায় না, বাড়ি নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে সেটা বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা তার উপলব্ধিতে আনেননি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রীকে 'বাস্তুহারা' হিসেবে দেখতে চাই না এবং বাস্তুহারা মনেও করি না; কিন্তু তিনি নিজেকে হেয় করলেন এবং শুধু নিজেকে নয়, দেশবাসীকেও অপমান করলেন 'বাস্তুহারা' হিসেবে ঘোষণা দিয়ে। যারা তাকে নিজেকে বাস্তুহারা ঘোষণা দেয়ার কুবুদ্ধিটা দিয়েছেন, তারা তার প্রতি যেমন, তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতি কোন সুবিচার করেননি। ক্ষতি করেছেন তার ইমেজের, ক্ষতি করেছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী নামক প্রতিষ্ঠানটির এবং অবশ্যই ক্ষতি করেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির।

এটা ঠিক শহীদ মইনুল সড়কের বাড়িটি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অসহায় বিধবা স্ত্রীকে দেয়া হয়েছিল তার দুই নাবালক ছেলেকে নিয়ে বসবাস করার জন্য। প্রায় দুই দশক পর প্রয়াত রাষ্ট্রপতির অসহায় বিধবা এখন আর অসহায় নেই। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক, দুই দু'বার প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং তার নিজের ঘোষণা মতে সাড়ে ৩ কোটি টাকার মালিক (অবশ্য অনেকে মনে করেন টাকার অঙ্কটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য)। সরকার প্রদত্ত তার একটি বাড়ি রয়েছে গুলশানে। বর্তমান বাজার দরে যার মূল্য ৩০ কোটি টাকার কম নয়।

তিনি এখন আর অসহায় বিধবা নন। তার দুই ছেলেও এখন আর নাবালক নন। তারা শুধু সাবালকই নন, অকল্পনীয় অর্থ ও বিত্তের মালিক। অর্থাৎ যে কারণে ক্যান্টনমেন্টের এ বাড়িটি তাকে দেয়া হয়েছিল সেই কারণগুলো এখন আর নেই। এরপরও তিনি কেন জনগণের সম্পদ ভোগদখল করবেন? রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি করবেন? টিভিতে তার কান্নাকাটি দেখে সেজন্যই বোধহয় অনেকে মনে করেছেন রাজনীতি তিনি করছেন নিজের জন্য, ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটির জন্য_ দেশ ও জনগণের জন্য নয়।

দেশ এবং জনগণ তার রাজনীতির দুটি লেবাস মাত্র, তার আদর্শ নয়। না হলে ওই বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি হিসেবে ১, ৪, ৯ ও ১০ নভেম্বর ছোট-বড় অর্ধশতাধিক কার্টন, কয়েকটি বড় ব্যাগ, স্টিলের ট্রাংক সরিয়ে নেয়ার (প্রথম আলো, ১৩.১১.২০১০) পরও তিনি দেশবাসীর সামনে কীভাবে বলেন, তাকে 'এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ' এভাবে নিজেকে অপমানিত করার উদ্দেশ্যটি আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি দেশবাসীকে অশ্রুসজল কণ্ঠে বলেছেন, 'আমি অপমানিত, লাঞ্ছিত, লজ্জিত বোধ করছি। ' আমাদের সম্মানিত বিরোধীদলীয় নেত্রীর উদ্দেশে আমরাও বলতে চাই বাড়িটি তার নয়, যে বাড়িটি তাকে শুধু থাকতে দেয়া হয়েছিল।

জনগণের সেই বাড়িটি জনগণের কাছে ফিরে যাওয়ায় তিনি যে 'অপমানিত, লাঞ্ছিত এবং লজ্জিত বোধ' করেছেন, তাতে আমরা দেশবাসীই বরং অপমানিত, লাঞ্ছিত এবং লজ্জিত বোধ করেছি। এ প্রসঙ্গে একজন আওয়ামী লীগ সমর্থক বলেছেন, 'স্বামীর মৃত্যুর পর কেঁদেছেন বলে শোনা যায়নি, দুই ছেলের জন্যও যাকে চোখের জল ফেলতে দেখা যায়নি, তিনি যে একটি বাড়ির জন্য, যে বাড়িটি তার নয়; কেঁদেছেন। এ থেকে বোঝা যায় আসলে তার রাজনীতির চরিত্রটা কী। ' আওয়ামী লীগ সমর্থকের এ উক্তিটি কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না এবং উক্তিটি মোটেই রাজনৈতিক নয়, একেবারে ব্যক্তিগত আক্রমণ, অশোভন। কথাটি তাকে বলতেই তিনি আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, তা বটে।

দেশ ও জনগণের জন্য রাজনীতি করতে হলে ২৭২ শতাংশের বাড়ি, ৬৭ জন কর্মচারী, ৮টি বিলাসবহুল গাড়ি, বাড়িতে বিশাল সুইমিংপুল, রাজপ্রাসাদ বেডরুম, বাথরুমে এসির প্রয়োজন? সর্বোপরি জনগণের পয়সায় জনগণের বাড়ি দখলে রাখা প্রয়োজন? _এই প্রশ্নগুলোর জবাব আমার জানা নেই, দেয়ারও কথা নয়। এর জবাব বেগম খালেদা জিয়ারই দেয়া উচিত, অবশ্য যদি তিনি দেন। যে বাড়িটি বিরোধীদলীয় নেত্রীর নয়, কোনদিনই ছিল না, কোনদিনই হবে না, সেই বাড়িটি নিয়ে এখন দেশে রাজনীতি হচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী অপমানিত, লাঞ্ছিত, লজ্জিত বোধ করছেন। এর কোনটাই হতো না যদি, যেদিন থেকে রাজনীতি শুরু করেছেন, সেদিনই ক্যান্টনমেন্টের এ বাড়িটি জনগণকে ফিরিয়ে দিয়ে বলতেন 'আমাদের বিপদের সময় রাষ্ট্র তথা জনগণ আমাদের এ বাড়িটি দিয়েছিল, আজ রাষ্ট্রকে তার সম্পদ ফিরিয়ে দিলাম।

রাষ্ট্র এবং জনগণের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ' এই বলে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছেড়ে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে এসে রাজনীতি করতেন। বস্তুত যেদিন থেকে রাজনীতি শুরু করেছেন, সেদিন থেকেই সরকারি বাড়িতে থাকার নৈতিক অধিকার তিনি হারিয়েছেন; কিন্তু বাস্তব হলো এই সুবুদ্ধিটুকু আমাদের দেশের রাজনীতিকদের নেই। কবে হবে, কে জানে? আদৌ হবে কি না কে জানে। একইভাবে প্রশ্ন করা যায়- খালেদা জিয়া 'বাড়ি ইস্যু' নিয়ে রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করার হুঙ্কার দিচ্ছেন।

২৯ নভেম্বরের পর আদালতের রায় যদি তার আপিলের বিপক্ষে যেত, তাহলে তিনি কি পারতেন 'চোখের জলে এক কাপড়ে বেরিয়ে আসার' রাজনীতি করতে? পারতেন কি 'বাস্তু'র মালিক হয়েও নিজেকে 'বাস্তুহারা' ঘোষণা করতে? বোধহয় পারতেন না, অথবা পারতেন! এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই। অন্তত বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি থেকে এর জবাব পাওয়া যাবে না। যেমন জবাব পাওয়া যাবে না ১০ নভেম্বর আইন বিভাগের সামনে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করার লিখিত আবেদন ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার আইনজীবী টিএইচ খান শুধু লিভ পিটিশনের আবেদনের শুনানি রাখতে প্রার্থনা করেছেন' (প্রথম আলো ২০.১১.২০১০) কেন_ এই প্রশ্নের। উপস্থিত ক্ষেত্রে আমরা যারা 'তথাকথিত জনগণ' আমাদের নামেই যা কিছু এই দেশে_ বাড়ি দখল, বাড়ি উদ্ধার, রাজনীতি, ক্ষমতায় যাওয়া-আসা সবকিছুই হচ্ছে।

আমরা আশঙ্কায় রয়েছি রাজনীতিতে সংঘাত এবং নৈরাজ্য অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন 'বিএনপি দুর্বল' কোন আন্দোলনই করতে পারবে না। এই প-িতরা বোঝেন না, এ কারণেই তো তারা আরও বেপরোয়া। তার চেয়েও বড় একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন হচ্ছে আইনি প্রক্রিয়ার সমাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা না করে সরকার যে পরিস্থিতি উস্কে দিয়েছে_ ক্ষমতায় থাকার প্রশ্নে সেটা তারা হয়তো সামলে নিতে পারবে। অর্থাৎ ক্ষমতায় টিকে যাবে।

কিন্তু যে চ্যালেঞ্জগুলো তাদের সামনে রয়েছে দ্রুত এবং ক্রমঅবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা, বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়ন করা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি_ এই চ্যালেঞ্জগুলো কি সরকার সামনের দিনের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যথাযথভাবে address করতে সক্ষম হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।