আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: যে গল্পটি লেখা হলো না



গল্প লিখার জন্য নাকি প্রচন্ড নিরবতার প্রয়োজন। অনেকে আবার বলে, গল্প লেখার সময়টা একটা অলৌকিক মুহূর্ত। এই অলৌকিক মুহূর্ত খুব সহজে ধরা দেবে না। কিংবা হয়ত অলৌকিক মুহূর্তটি আসবে কিন্তু লেখক বুঝবে না। আমারও অনেকদিন গল্প লেখা হচ্ছে না।

কলম নিয়েছি বহুবার। আসলে ইদানিংকার আমরা নতুন যুগের মানুষরা কলম দিয়ে লেখি না। আমরা কম্পিউটারের সামনে বসে বাটন চাপতে থাকি। কলম সব কিছু জয় করতে পারে এখন এটা ভুল। এখন বলতে হবে, কম্পিউটারের কি-বোর্ড সব কিছু জয় করতে পারে।

তাই বলছি, আমি বহুবার কম্পিউটারের বাটনে চাপ দিয়েছি। কিন্তু লেখার মতো কিছু পায়নি। গল্প লিখতে পারছি না। মনে ভেতর হাহাকার কাজ করছে। কোন সদ্য-বিবাহিত মেয়ে যদি জানতে পারে যে সে বন্ধ্যাত্ব রোগে আক্রান্ত।

তখন? তখন তার অনুভূতিটা কি হবে ভেবে দেখেছেন? ঠিক আমারও একি অবস্থা। বন্ধ্যাত্ব রোগে ভুগছি। প্রসব বেদনাও পাচ্ছি না বহুদিন। তবে আমি অনেকদিন ধরেই ধরে গল্প না লিখতে পারার কারণ বের করবার চেষ্টা করছি। একটা সময় ছিল যখন আমার গল্প পড়ে অনেকেই বলত, ‘গল্পে এতো মানসিক চাপ কেন? গল্প তো তাহলে ফুরিয়ে যাবে।

’ হয়ত তাই হয়েছে। প্রচন্ড মানসিক চাপ থেকে গল্প লিখতাম বলে এখন আর সেইভাবে গল্প লেখা হচ্ছে না। নতুন নতুন আইডিয়া আসলেও কিভাবে শুরু করবো? গল্পের কাহিনী কি হবে? এসব ভাবতে ভাবতে দুদিন পার হয়ে যায়। ততদিনে লেখার ইচ্ছাটাও বদলে যায়। এইতো কিছুদিন আগে লিখতে বসেছিলাম জোর করে।

জোর করে লিখেছি কিছু। দেখবেন? পড়ে দেখুন লাইনগুলো। ঝড় নেমেছে। আমার জানালার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া আম গাছটাকে রাতের ভুত মনে হচ্ছে। তার তীব্র বেগে নড়াচাড়ার আওয়াজ আর সাথে তার পাতার গন্ধ আমার নাকে এসে লাগে।

এ তো সবুজের গন্ধ। আশেপাশে দালানের চাপে মাটির গন্ধটা আটকে আছে। আর জানালার গ্রীলের পাশে আটকে আছি রাত জাগা আমি। ছাড়ছি দীর্ঘশ্বাস। আর তা মিশে যাচ্ছে ঝড়ো বাতাসের সাথে।

আমি বসে থাকি একা। একদম একা। রাত বাড়ে। রাত গভীর থেকে গভীর হয়। অন্ধকার গাড় হয়।

ঝুম ঝুম বৃষ্টির আওয়াজ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আমার মনের ভেতর জমে থাকা হাজারো মেঘের সারিগুলো উন্মাদ হয়ে উঠে। বুঝতেই পারছেন সেদিন প্রচন্ড ঝড় নেমেছিল। প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে লিখতে বসেছিলাম। এর বেশী আর এগুতে পারিনি।

তারপর কিছুক্ষণ গান শুনে ঘুমের দেশে চলে গেছি। গানটি ছিল- আমার নিশিথ রাতের বাদল ধারা/এসো হে গোপনে/ আমার সপনলোকের দিশাহারা…… রবীন্দ্রনাথের বৃষ্টির গান ভেতরের ক্লান্তি দূর করে দেয়। মনকে বিষন্নতার হাত থেকে মুক্ত করে তুলতে পারে। আবার অনেক সময় ভালো মনটাকেও বিষন্নতার বেড়াজালে আটকে ফেলতে পারে। রবীন্দ্রনাথের গান শুনে প্রেমে পড়া হয়নি এমন বাঙালী পাওয়া দুষ্কর।

রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা পড়ে কাঁদেনি এমন বাঙালী পুরুষ পাওয়া গেলেও নারী পাওয়া কঠিন। মনের একদম গহীন থেকে আবেদন আসবে রবীন্দ্রনাথের যে কোন সৃষ্টিতে এটাই রবীন্দ্র’র নিয়তি হয়ে দাড়িয়েছে। রবীন্দ্রনাথেরই খুব বিখ্যাত একটা উক্তি আছে। “মেয়েদের বুক ফাটলেও মুখ ফুটবে না। ” রবীন্দ্র আমলের কথা এগুলো।

রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত একটি গল্প আছে। অপ্রকাশিত মানে হলো জীবদ্দশায় গল্পটি তিনি লিখলেও প্রকাশ হয় নি। কেন প্রকাশ হয়নি তা ঘটনাটি শুনলেই বুঝতে পারবেন। গল্পটির নাম হলো “মুসলমানীর গল্প”। গল্পের নায়িকা কমলা বিয়ের পর বরের সঙ্গে শশুরবাড়ি যাচ্ছিল।

পথিমধ্যে হঠাৎ ডাকাতের হামলা হয়। তাকে উদ্ধার করে হবির খাঁ। হবির খা তাকে নিয়ে যায় তার কাকার বাসায়। কিন্তু হিন্দু পরিবার কমলাকে আশ্রয় দেয়নি। যার ফলে হবির খাঁ তাকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন।

হবির খাঁ মুসলমান। কমলা হিন্দু। মুসলমান পরিবারের মাঝে হিন্দু আচার নিষ্ঠা মেনে চলা অনেক কঠিন। তারপরও হবির খাঁ তাকে নিজ ধর্ম পালনের ব্যবস্থা করে দিলেন। এমনকি কমলার জন্য রান্না-বান্নার ব্যবস্থাও করা হলো তার শাস্ত্রমতো।

হবির খাঁ’র মেঝ ছেলে করিম। করিমের সাথে গভীর প্রণয় হলো কমলার। ভালোবাসা হলো তাদের। ভালোবাসা কখনও কোন বাঁধ মানে? তাই ধর্ম’র বাঁধও ভালোবাসা জয় করে নিলো। তাদের বিয়ে হলো।

কমলা মুসলমান হয়ে গেলো। নাম হলো- মেহেরজান। হিন্দু-মুসলমানের এই মানসিক-সামাজিক যুদ্ধ গল্পটিকে করে তুলেছে ঐতিহাসিক। তবে খুব সাধারণ এই গল্পটি অসাধারণ হতে পারতো যদি তা কবিগুরু তার জীবদ্দশায় প্রকাশ করতে পারতেন। তবে তা আর হয়নি।

প্রেমের অভিষেক তিনি করেছেন মুসলমান আর হিন্দুর মাঝে। সকল বাধাকে ডিঙিয়ে গেছেন তিনি। অথচ এই গল্পটি প্রকাশ হলো কবি’র মৃত্যুর ৭/৮ বছর পর। এগুলো আসলে নতুন নয়। এখনও তীব্র প্রেমের ব্যকুল আবেদন আজও পৃথিবীর বুকে অনেকটাই অপ্রকাশিত থেকে যায়।

যাইহোক। এগুলো আজবগুবে কিছু ঘটনা ভাবা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই। কারণ গল্প বলতে হবে। তাও আবার প্রেমের গল্প। বহু লেখক হয়তো প্রেমের গল্প লিখে একদম লারেলপ্পা হয়ে গেছেন।

তবে আমি লরেলপ্পা হতে চাই না। আমি একটা সাধারণ প্রেমের গল্প লিখতে চাই। মাঝে মাঝে মাথায় সব উদ্ভট আইডিয়া ঘুরে। সকল সিস্টেমকে ভেঙে ফেলে আমি প্রেমের গল্প লিখতে চাই। কিন্তু পাঠক-কূলের হামলার কথা চিন্তা করে আমি লিখতে পারি না।

অনেকেই আমাকে নোংরা বলা শুরু করবেন। উদাহরণ দিয়ে বলি, একবার “গন্ধ” নামে একটি গল্প লিখেছিলাম। দৈহিক প্রেমের পরিণতি নিয়ে গল্প। এমনকি আমার প্রথম গল্প “দেহ”। সেটাও গোপন ক্যামায় দৈহিক প্রেমের দৃশ্য নিয়ে একটি গল্প।

প্রেম ইদানিং নোংরা সব গুটির মাধ্যম হয়ে গেছে। সবাই প্রেম করে নিছক দেহ’র মজা লুটে নেবার জন্য। কি? সবাই বললাম দেখে আপনারা রাগ করছেন? জানি রাগ তো করবেনই। সবাই না হলেও ৭০ ভাগ প্রেমিক-প্রেমিকা দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এটাকে আবার তারা বলে, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

তবে এই প্রকাশ যদি গোপন ক্যামেরায় চলে আসে তবে এর পরিণতি কি দাড়ায়? আসলে আমি দুখিত। অনেকেই বলে, আমার লেখায় মেয়েদের নিয়ে উল্টা-পাল্টা বিষয় নিয়ে লেখা থাকবেই। আমার এক মেয়ে বান্ধবী সব সময় বলে, তোর মেয়েদের প্রতি এতো অসম্মান কেন? আসলে কেউ বোঝে না। এটাকে অসম্মান বলে না। এটাকে বলে কটাক্ষ।

মেয়েদের দু-মুখো চরিত্রকে আমি কটাক্ষ করি। যাইহোক। ইদানিংকার মেয়েদের সেন্স বলে কিছু কাজ করে না। ভালোবাসার গন্ধ পেলেই তারা ছুটে যায়। যেখানে তারা শান্তি পাবে বলে ধারণা করে সেখানেই তারা ছুটে যাবে।

এটাই তাদের স্বভাব হয়ে দাড়িয়েছে। ২. আকাশ সেদিন মেঘলা ছিল। ঐগানটাও শুনছিলাম, আকাশ এতো মেঘলা যেও না তো একলা/ এখনই নামবে অন্ধকার…… কি চমৎকার গান। তাই না? আমি তখন শাহবাগ মোড় থেকে হেটে হেটে আজিজ সুপার মার্কেটের দিকে যাচ্ছি। কি করার? আমার বেকার জীবনের একমাত্র সম্বল এখন আজিজ সুপার মার্কেট।

আমার এক শিক্ষক একদিন আজিজে আমাকে দেখে বলেছিলেন, তুমি এখানে? শেষ। তোমার জীবন শেষ। আমি খুব গর্ব নিয়ে বলি-আমার জীবন শেষ হয়নি। বরং আমি একটি অন্যরকম জীবনের স্বাদ নিতে পারছি। যে জীবনের মানে নেই।

যেখানে আছে শুধু বিষ্ময়। নিত্য-নতুন বিষ্ময়। বেকার জীবন মানেই হলো একটি মরুভূমির মতো জীবন। যদিও আমি মনে করি, সেই মরুভূমি দিয়ে প্রত্যেকটি মানুষরই একবার হলেও হাটা উচিত। বেকারত্বটা কি জিনিস তা মানুষ হিসেবে উপলব্ধি করা দরকার।

আমার বন্ধুরা আবার এ ক্ষেত্রে অনেক সৌভাগ্যবান। তারা জানে না বেকারত্ব কি জিনিস। পড়াশুনার শেষের সাথে সাথে চাকরী পেয়ে গেছে। কি আর চিন্তা। নাকে তেল দিয়ে ঘুমা।

আর সময় পেলে আমাকে পেয়ে কিছু উপদেশ বাণী শোনানো। আর আমার আড়ালে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি। আমার ছাত্রজীবনের চাঞ্চল্যময় জীবন নিয়ে হাসাহাসি। কিংবা সমালোচনা। এগুলোই চলে।

হয়তো চলে না। মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করি তাদের এই স্বভাবের। তখন আবার অন্য কথা। বলবে, ব্যাটা চাকরী না পেয়ে হাতাশায় পাগল হয়ে গেছে। এগুলো সবই আমাকে হতাশায় ডোবায়।

এই সব কিছুর মাঝে আমার সাহিত্য আমাকে প্রাণ দেয়। আমাকে অক্সিজেন দেয়। আমি দাড়িয়ে থাকি স্বপ্ন নিয়ে। আমি বিস্মিত হই। আমি পৃথিবী দেখি।

আমি আকাশ দেখি। চাঁদ দেখি। পাখি দেখি। মাঝে মাঝে সমুদ্রের কাছে গিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ শুনি। আমার জীবন।

এভাবেই বেকার জীবনটা বহন করতে হচ্ছে। অনেকেই বলে, বেকার জীবন একটা অভিশাপ। আমি বলব, বেকার জীবন যদি অভিশাপের হয় তবে এই অভিশাপের মাঝে সকলকে পড়তে হবে। কারণ, এই অভিশপ্ত জীবন মানুষ চিনতে শেখায়। বন্ধু-শত্রু-আত্মিয়স্বজন সকল কিছু চিন্তে শেখায়।

আমাকে দিয়ে অনেকে অনেক কাজ হাসিল করিয়ে নেয় মুলা ঝুলিয়ে। বলে- ‘তোমাকে চাকরী দেবো। কাজ করো আমার জন্য। ’ কাজ করে দেই। সকল কিছু-সকল বিপদ উপেক্ষা করে কাজ করে দেই।

কিন্তু বেলা শেষে ফলাফল একটাই। বলা হবে- ‘এই মুহূর্তে আমার হাতে সুযোগ নেই তোমাকে দেবার মতো। তবে একদিন হবে। চিন্তা করো না। ’ তখন নিজেকে কনডম মনে হয়।

আসলে কনডমের চেয়েও নিকৃষ্ট মনে হয়। কনডম যেমন ব্যবহারের পর ফেলে দেয়। ঠিক সেরকম। আমাকে ব্যবহার করা হয়। তাই কনডম ছাড়া নিজেকে আর কিছুই ভাবতে পারি না।

চাকরী না পাওয়ার পেছনে অন্যকে দোষ দেয়াটাও আমার উচিত হচ্ছে না। আমি পড়াশুনাটাও ঠিক মতো করিনি। টেনে-টুনে পাশ করে বের হয়েছি। এই কোন রকমে পাশ দিয়ে চাকরী দিবে কে? তাই নিজের পরিণতিকে মেনে নিয়েছি নিজের ভুলের শাস্তিস্বরুপ। তবে শাস্তি পেয়ে লাভ হচ্ছে কি? চেষ্টাগুলোতে কাজ হচ্ছে কি? যাইহোক।

আমি এগিয়ে যাই আমার শান্তি পাওয়ার জায়গা আজিজ সুপার মার্কেটের দিকে। আমার কথা শুনে আপনারা হয়তো ভাবছেন ওখানে আমার অনেক পরিচিত মানুষ। আসলে সত্য কথাটা হলো ঐখানে তেমন কারও সাথে আমার পরিচয় নাই। আমি যাই, ঘুরে ঘুরে বইয়ের দোকানগুলো দেখি। মাঝে মাঝে দোকানির সাথে কোন একটা বই নিয়ে আলাপ চালাই।

কথা বলি। ছোটখাটো আড্ডা হয়ে যায়। তবে এখন আজিজে গিয়ে তেমন একটা আনন্দও পাই না। পানসে হয়ে গেছে। বইয়ের দোকনগুলো বন্ধ করে গড়ে উঠছে কাপড়ের দোকান।

বস্ত্র দখল করছে কাগজের স্থান। অনেকটা এমন ভাবেই বলতে ইচ্ছে করছে। উলঙ্গ মানুষের সামনে বই আর কাপড় দিলে তো তারা কাপড়টাকেই আগে নেবে। এটাই স্বাভাবিক। ঘুরে ঘুরে দেখছি বইগুলো।

আমি নোবেল জয়ী লেখক হোসে সারামাগোর “অন্ধত্ব” বইটি খুজছি। পাচ্ছি না। এছাড়াও এবারকার নোবেল জয়ী লেখক মারিও ভার্গাস য়োসার কোন একটা বই। কিন্তু পাচ্ছি না। বইয়ের সাগরে পড়ার অভ্যাস আছে আপনার? পড়ে দেখবেন।

মাথাটা কিভাবে বিগড়ে যায়। দেখবেন- কিনতে গেছেন এক বই কিন্তু ফিরছেন আরেক বই নিয়ে। বইয়ের দোকানে গিয়ে শূণ্য হাতে ফিরেছেন এমন গাধা কিংবা অমানুষ এখনও পৃথিবীতে মনে হয় জন্মায়নি। যদি জন্মায় তাহলে বলতে হবে সৃষ্টিকর্তা ভুল করে তাকে মনুষ্যকূলে পাঠিয়েছেন। তার জন্মানো উচিত ছিল কোন এক শূয়োরের গর্ভে।

গায়ে লেগেছে? লাগে নি? তার মানে আপনি বই কিনেই বইয়ের বাজার থেকে ফিরেছেন। তো, আমি বই খুজছি। যদিও আমি অনুবাদ সাহিত্য খুব একটা পছন্দ করি না। মনে হয়, অনুবাদে সাহিত্যের আসল রসটা পাওয়া সম্ভব না। তারপরও কি করার।

এতো বড় মাপের সাহিত্যিকদের ইংরেজী বই পড়তে গেলে তো ইংরেজীতে ধাতস্থ হওয়া লাগবে। আমি তা পারবো না। আমি অনুবাদটাই পড়ি। শেষে পেলাম হোসে সারামাগোর- যীশু খৃষ্টের একান্ত সুসমাচার। কিনে ফেললাম।

আরও কিছু দেখছি। একটা বই উল্টালাম। ঠিক ঐ মুহূর্তে একটি মেয়ে ঢুকলো দোকানে। খুব অবহেলার চোখে বই দেখছে। বই মনে হয় তার শত্রু।

উল্টাচ্ছে-পাল্টাচ্ছে। খুব সাধারণ বৈশিষ্টের বাঙালীয়ানা মেয়ে। চোখে কাজল দেয় না। কাজল দিলে হয়তো মেয়েটিকে আরও ভালো লাগতো। কপালে টিপ নেই।

টিপ পরলে বাঙালী ভাবটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতো চেহারাতে। কিন্তু হাতাশায় ডোবা মেয়েটি বই দেখে হতাশার ভঙ্গিতে। আপনারা হয়তো ভাবছেন, আমি কি করে বুঝলাম মেয়েটা হতাশায় মড়ানো? বুঝে গেছি। মেয়েদের চোখ হলো পৃথিবীর সবচাইতে রহস্যময় বস্তু। এবং সত্যি কথাটা হলো- প্রতিটি মেয়ের চোখে তার দুঃখগুলো একদম ফুটে উঠে।

হাজারো রহস্যের মাঝেও সেই হতাশা মাখা চোখটা তারা লুকিয়ে রাখতে পারে না। তাদের ছল ছল করা চোখ পুরুষের অন্তরে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আঘাত করবেই যদি পুরুষরা সেই চোখের দিকে তাকায়। আসতে আসতে মেয়েটি আমার পাশে এসে দাড়ালো। আমার বইটির দিকে একটু উকি দিয়ে দেখলো আমি কি বই কিনলাম। তারপর ঠোটের কোণে মুচকি হাসি।

আমি জানি কেন হাসছে। তারপরও প্রশ্ন করেই ফেললাম, আপনি হাসলেন যে? থতমত খেলো মেয়েটি। বলল- জি, মানে হাসলাম মানে? হ্যা। হাসলেন তো। আমার বইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন তো আপনি।

মেয়েটি একটু নিজের বিব্রতবোধটা কমিয়ে বলল- আসলে আপনার হাতে অদ্ভুত এই রাইটারের বই দেখে হাসলাম। - অদ্ভুত কেন হবে? হোসে সারামাগো বিখ্যাত নোবেল জয়ী লেখক। মেয়েটি এবার অবলীলায় হেসে উঠলো। বলল- ওহ তাই নাকি? কি আশ্চর্য দেখুন। আমি এই লেখকের নামটাই শুনিনি।

হুম। সেটা বলেন। যীশু খৃষ্টের উপর লেখা এই বই অনেক সাড়াজাগানো বই। বুঝলেন। এর ইংরেজী নাম হলো- “দি গসপেল অ্যাকোর্ডিং টু জেসাস ক্রাইস্ট”।

এ উপন্যাস সারামাগোকে এনে দেয় পর্তুগিজ লেখক এসোসিয়েশন পুরস্কার। তবে এই উপন্যাসটির বিষয়বস্তু বিতর্কের জন্ম দিলে পর্তুগিজ সরকারের ওপর চাপ আসতে থাকে। ক্যাথলিক চার্চ থেকে বইটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়। এই বিষয়ে সারামাগো দাবি করেন, এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। এই বিতর্ক সৃষ্টির পর সারামাগো এবং তার স্ত্রীকে লিসবন শহর ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

বুঝেন তাহলে। মেয়েটি এবার সব কিছু ভুলে হাসতে থাকে। অনেকটা পাগলটাইপের হাসি। তবে কি মায়বী! কি আকর্ষণীয়! রহস্য ঘেরা। আবেগ জোড়ানো।

যেনো ঘন মেঘের গর্জনের মাঝেও সূর্য উকি দেয়। ছলছল চোখে এই বুঝি পানি গড়িয়ে পড়বে। এমন সময় হাসিতে বিলিন হয়ে যায় চোখের পানি। সমুদ্রের ঢেউ যেভাবে আছড়ে পড়ে তীরে। ঠিক সেভাবে সেই শব্দ আমার অন্তরের একদম ভেতরে গিয়ে আচড়ে পড়ছে।

আমার ভেতরটা যেনো চুরমার করে দিচ্ছে। আমি হুট করেই বলে উঠলাম- আপনি হাসছেন কেন? ওমা কি আশ্চর্য। আমি হাসবো না? আপনি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছেন। আপনার কাছে কি আমি জ্ঞান চেয়েছি? কিছুটা মুচকি হেসে আমি বললাম- আসলে এটা বাঙালীর অভ্যাসের একটি। জ্ঞান বন্টন করা।

এরপর আর মেয়েটি আমার দিকে তাকায়নি। হঠাৎ দেখি বের হয়ে যাচ্ছে। খুব আফসস হলো। আহ। নামটাই তো জিজ্ঞেস করা হয়নি।

কি নাম মেয়েটার? যাইহোক। আমি আবার ডুব দেই বইয়ের সাগরে। বের হই। ভাবলাম আরেকটা দোকানের দিকে যাবো। শংকরের “চৌরঙ্গী” বইটাও কিনতে হবে।

বের হতেই হিমেল বাতাসের মতো আমার শরীর-মনে এসে লাগলো এক অসাধারণ হিমেল শব্দ। তোমার গীতি জাগালো স্মৃতি নয়ন ছলছলিয়া, বাদল শেষে করুণ হেসে যেন চামেলি-কলিয়া । । আমার মনটা কেন যেন আনচান হয়ে উঠে উঠলো। কোথা থেকে আসছে গানটার আওয়াজ।

পাগলের মতো ছুটতে থাকি। এতো রবীন্দ্রনাথ। শব্দ কাছে আসতে থাকে। সে বাণী যেন গানেতে লিখা দিতেছে আঁকি সুরের রেখা যে পথ দিয়ে তোমারি, প্রিয়া, চরণ গেল চলিয়া। দেখি।

অবাক হয়ে দেখি। ঠিক আমারই মতো বিস্ময় নিয়ে দাড়িয়ে আছে মেয়েটি। একটি সিডির দোকানে। যেখানে প্রাধান্য পায় রবীন্দ্রনাথ। আবেগ নিয়ে চোখ বন্ধ করে শুনছে গান।

ঠোট নাড়ছে। মিন মিন করে মুখ মিলাচ্ছে। সেতারের আওয়াজে একটুখানি চোখ মেলল। সেই ছলছলে চোখ। পানি গড়িয়ে পড়ছে।

আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা প্রিয় আমার ওগো প্রিয় বড় উতলা আজ ওরা আমার খেলাতে হার মানবে আহা। আহা রবীন্দ্রনাথ। তোমার গান শুনে বাঙলার এই নারী চোখ ভেজায়। নিরবতায় তোমার গীত তাকে হারিয়ে ফেলে। জানো তুমি রবীগুরু? ওগো রবীন্দ্রনাথ……………………. আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা বেধেছে আমার প্রিয়া…… আমি কাছে যাই।

আমাকে দেখেনি। হারিয়ে আছে। আমার রবীন্দ্রপ্রেমী হারিয়ে আছে। রবীন্দ্রাথ বলেছে- ওরা আমার খেলাতে হার মানবে। আমি হার মেনেছি।

ওর প্রেমের কাছে আমিও হার মেনেছি। অবাক হওয়া-বিষ্ময় হওয়া সব কিছই তো ছিল। মেয়েটি খুব ধীরে আমার দিকে তাকায়। গম্ভীর হয়ে বলে- আপনি এখানেও? - জ্বি, আমি এখানেও। গান শুনতে এসেছি।

সত্যি? আজকালকার ছেলেরা তো রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাই ছেড়ে দিয়েছে। আমি বললাম- আমিও খুব একটা শুনি না। তবে আপনার মুগ্ধ হওয়া দেখে আমি শুনছি। মেয়েটি একটুও এবার বিব্রত হয় না। সে দোকানিকে বলে আরেকট সিডি চালাতে।

বেজে ওঠে, তুমি মোর পাও নাই পরিচয় । তুমি যারে জান সে যে কেহ নয়, কেহ নয় । । মালা দাও তারি গলে, শুকায় তা পলে পলে, আলো তার ভয়ে ভয়ে রয়– বায়ুপরশন নাহি সয় । ।

এসো এসো দু:খ, জ্বালো শিখা, দাও ভালে অগ্নিময়ী টিকা । মরণ আসুক চুপে পরম প্রকাশরূপে, সব আবরণ হোক লয়– ঘুচুক সকল পরাজয় । । আমি দাড়িয়ে থাকি। আমিও চোখ বন্ধ করি।

হে রবীগুরু। তুমি আমার জীবনে এসেছ কোন এক নারীর বেশ ধরে। আমি জানি। তোমার প্রেমে আমার কাঙাল হতে ইচ্ছে করছে। তোমার পূজা দিতে ইচ্ছে করছে।

হে রবীগুরু তোমাকে প্রণাম। প্রণাম। লাবণ্য ছোয়া মেয়েটি। চলে যাচ্ছে। আটকানোর শক্তি নেই।

দৌড়ে যাই। দেখি বাদল নেমেছে। কাছে যেতেই শুনি মেয়েটি গুন গুন করে গান গাচ্ছে। আমার নিশীথরাতের বাদল ধারা এস হে গোপনে আমার স্বপনলোকে দিশাহারা । ।

ওগো অন্ধকারের অন্তরধন , দাও ঢেকে মোর পরান মন – আমি চাইনে তপন , চাই নে তারা । । আমি থমকে যাই। আর না। গানটা আমার তার কন্ঠেই শুনতে হবে।

হবেই। আমার নিশীথরাতের বাদল ধারা। এসো হে গোপনে। আর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। বৃষ্টির ঝুম ঝুম শব্দের মাঝে হারিয়ে যায় মেয়েটি।

ঘোলাটে আকাশের নিচে আমি দাড়িয়ে একা। ভিজে একাকার। শেষ: ঘটনাটা অনেকদিন হলো। এখনও মাঝে মাঝে মনে হলে বুকটা আনচান করে উঠে। মেয়েটির নামটাতো জানা হলো না।

রবীন্দ্রপ্রেমী মেয়েটি। লাবণ্যভরা, হতাশাগ্রস্থ চোখ, রহস্যময় পাগল হাসি মাখা মেয়েটি এখন কোথায়? এখনও রাত হলে মাঝে মাঝে আমি গাই, যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে/ নিয়ো গো/ নিয়ো গো/ আমার ঘুম নিয়ো গো হরণ করে…….. বিস্ময় জাগানো সব কিছু নিয়ে আমার গল্প লেখার অভ্যাস আছে। এই রবীন্দ্রপ্রেমী মেয়েটিকে নিয়েও আমার খুব গল্প লিখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু হয়ে উঠলো না। রবীন্দ্রনাথকে নিজের গল্পের হিরো বানাবার মতো সাহস আমার নাই।

একমাত্র রবীন্দ্রনাথের জন্য সেদিন মেয়েটির নাম জানা হলো না। একমাত্র রবীন্দ্রনাথের জন্যই আমার গল্পটি লেখা হলো না।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.