আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভূমিকম্পের ঝুকিতে দেশ

গণমাধ্যমকর্মী, চেয়ারম্যান - উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান, সদস্য সচিব - সম্মিলিত জলাধার রক্ষা আন্দোলন।

ভূমিকম্পের ঝুকিতে দেশ ছয় মাত্রার বেশি অর্থাৎ সাত মাত্রার তীব্রতায় ভূমিকম্প হলেই ধসে পড়বে রাজধানী ঢাকার ১৪ শতাংশ বাড়ি। ভূমিকম্পে অবকাঠামো ধসে পড়ার সাথে সাথে প্রাণহানি ঘটবে ব্যাপক। অন্যদিকে নয় মাত্রার তীব্রতায় ভূমিকম্প হলে ধসে পড়বে ঢাকার ২৮ শতাংশ বাড়ি। মাত্র ১০ শতাংশ হাউজিং কোম্পানি যথাযথ ভবন কোড মেনে চলে।

৫০ শতাংশ সচেতন কিন্তু মেনে চলে না। বাকি ৪০ শতাংশ কোম্পানি এ ব্যাপারে সচেতনই নয়। বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর পাশে ১৬০০ শতাব্দীতে গড়ে ওঠে ঢাকা শহর। শুরুতে ছোট একটি আয়তন নিয়ে ঢাকা শহর গড়ে উঠলেও পরে শহরটি পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিকে বেড়েছে এবং তা অব্যাহত আছে। বেশির ভাগ এলাকাই জলাভূমি ভরাট করে আবাসিক এলাকা করা হয়েছে।

এই জলাভূমির ওপর তৈরি আবাসিক এলাকায় ঝুঁকি বেশি। গবেষনায় দেখাগেছে, যদি ঢাকায় সাত মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে ৮৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। ২৪ হাজার বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। এর ফলে আহতের সংখ্যা হবে কল্পনাতীত। দিনের চেয়ে রাতে ভূমিকম্প হলে নিহত ও আহতের সংখ্যা হবে সবচেয়ে বেশি।

কারণ রাতের বেলা মানুষ ঘুমিয়ে থাকে বলে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারবে না। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্বের ঘনবসতি শহরের অন্যতম। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৩২ শতাংশ অর্থাৎ ১৬ হাজার কোটি টাকার সরাসরি ক্ষতি হবে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে। এ ছাড়া আরো বহুবিধ ক্ষয়ক্ষতি হবে। অপরদিকে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে প্রতি বছর ১ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার করে দেবে যাচ্ছে ঢাকা শহর।

এর ফলে যে কোনো সময় মারাত্মক ভূমিধস হয়ে লাখ লাখ লোকের মৃত্যুর আশঙ্কা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার চারপাশের নদীনালা, খালবিল রক্তনালীর মতো প্রবাহিত হতো। কিন্তু গত ৪০ বছরে এগুলো একের পর এক দখল ও ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। একদিকে নদী-জলাশয়ের অপমৃত্যু অন্যদিকে নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে ঢাকা শহরের পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে গেছে।

শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ৬১ দশমিক ১৮ মিটার বা ১৮৬ ফুট নিচে নেমে গেছে। জানা গেছে, প্রতি ১০০ বছর আগে সর্বশেষ ১৮৯৭ সালে এ অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল ঢাকা থেকে ২৩০ কিলোমিটার দূরে। অন্য দিকে ১৮৮৫ সালে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল বর্তমান যমুনা সেতুর গোড়ায়। ১৮৯৭ সালে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রামে ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি ভবন ভেঙে গিয়েছিল।

ভূমিকম্প ঝুঁকিমুক্ত রাখতে হলে ভবনের নকশা নমনীয়ভাবে (ফ্লেক্সিবল) করা উচিত যেন ভূমিকম্প হলে ভবন মচকাবে কিন্তু ভাঙবে না। এর জন্য বিম যেখানে মিলেছে সেখানে ঘন ঘন রড দিতে হবে। এর জন্য ২ শতাংশ রড বেশি লাগবে। এর বিনিময়ে গড়ে উঠবে ঝুঁকিবিহীন ভবন। ভারতে ২০০১ সালের ভূজ ভূমিকম্প ১০ মাত্রার তীব্রতায় থাকলেও শুধু নয় লাখ ৮০ হাজার চুন-সুরকির কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

গুজরাটে দুই লাখ ৩০ হাজার ভবন ধসে যায়। গুজরাট ভূমিকম্পে মোট প্রাণহানি ঘটে ১৫ হাজার এবং আহত হয় এক লাখ ৭০ হাজার। ভূজ শহরে ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। সে তুলনায় ঢাকা এর চেয়ে অনেক বেশি বড় শহর। ফলে ক্ষতির পরিমাণ ভূজ অথবা গুজরাটের চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে জরিপে বেরিয়ে আসে।

মনিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ-সায়েন্স বিভাগের এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ভারতের মনিপুরের টিপাইমুখ বাঁধের আশপাশে রয়েছে কিছু ফাটল। এ ফাটলগুলো সক্রিয় হলে মাঝারি থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সৃষ্টি করতে পারে। প্রসঙ্গত, এখানে ভূমিকম্প হলে এর প্রভাব ঢাকা শহরসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পড়তে পারে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত এক থেকে দুই শ’ বছরে সংঘটিত পাঁচ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার কয়েক শ’ ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ছিল টিপাইমুখ বাঁধ এলাকার এক শ’ থেকে দুই শ’ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে। গত ১৫০ বছরে টিপাইমুখের ১০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে দু’টি সাত মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে এবং শেষেরটি হয়েছিল ১৯৫৭ সালে।

মিরপুর থেকে পুরান ঢাকা পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে মাটি যথেষ্ট শক্ত। এ ছাড়া অন্য এলাকার মাটি সেভাবে শক্ত নয়। বেশির ভাগই জলাশয় ভরাট করে উঁচু করা হয়েছে। তা ছাড়া এমন অনেক আবাসিক এলাকা তৈরি করা হয়েছে যেগুলো এক সময় একেবারেই জলাভূমি ছিল। বাইরে থেকে বালু এনে উঁচু করে অভিজাত এলাকা তৈরি করা হয়েছে।

এসব এলাকা বালু দিয়ে ভরাট করার সময় যথাযথভাবে দুর্মোজ (কমপ্যাকশান) করা হয়নি। অনেক ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের কাছে দুর্মোজ করার জন্য যন্ত্রপাতিও নেই। দুর্মোজ করলেই বেশি বালু লাগে না। সাত মাত্রায় ভূমিকম্প হলে জলাভূমি ভরাট করে যেসব আবাসিক এলাকা তৈরি করা হয়েছে অথচ কমপ্যাকশান করা হয়নি সেগুলো ধসে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ইদানীং ঢাকায় ভবন তৈরিতে এসেছে আধুনিকতা।

এ আধুনিকতা ক্ষতির কারণ হতে পারে ভূমিকম্প হলে। ভবনের সুন্দর অভ্যন্তরীণ নকশা (ইনটেরিয়র ডিজাইন) করার সুবিধার্থে ফ্ল্যাট-প্লটের বাড়ি করা হচ্ছে। এগুলো বিমহীন ভবন। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এ ভবনগুলোর তলাগুলো একটার ওপর একটা ধসে পড়তে পারে। বিম ভবনের শক্তি বাড়ায়।

বিম থাকলে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ভবনের তলাগুলো একটার পর একটা ধসে পড়বে না। হয়তো ফাটল দেখা দেবে অথবা ঝুলে থাকবে। এতে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। এ ব্যাপারে রিহ্যাবের সভাপতি প্রকৌশলী তানভীরুল হক প্রবাল বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বিমবিহীন ভবন তৈরির পক্ষে না। ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে অবস্থিত ঢাকার পরিপ্রেক্ষিতে বিমবিহীন ভবন তৈরি করা ঠিক না।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ১১ বছরেই ঢাকার পানির স্তর নেমেছে ৩৫ মিটার এবং প্রতি বছরই তা বাড়ছে। শহরের বেশিরভাগ মাটি কংক্রিটে ঢেকে যাওয়ায় বৃষ্টির পানিও মাটি শোষণ করতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ভূত্বকের মধ্যে যে চাপ থাকে পানি তুলে নিলে তা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এতে ভূমিকম্প বা মারাত্মক ভূমিধসের আশঙ্কা থেকেই যায়। তিনি আরো বলেন, শুধুমাত্র ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে ঢাকা শহর প্রতি বছর ১ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার দেবে যায়।

জানা গেছে, ঢাকা শহরের ভূতাত্ত্বিক গঠন এমনিতেই ভালো নয়। তার ওপর কোনো ধরনের আইন না মেনেই গড়ে উঠেছে ভবনগুলো। এ অবস্থায় ভূমিধস হলে ক্ষয়ক্ষতি মারাত্মক আকার ধারণ করবে। বিশেষ করে নগরীর পশ্চিম পাশে যেসব আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে সেখানে মাটির পুরুত্ব ২৫ ফুটের বেশি নয়। ফলে স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প বা ভূমিধসেও দেবে যেতে পারে ঢাকা শহর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হয় না। তোলা হলেও শুধুমাত্র পানের জন্য যে পানি লাগে তাই তোলা হয়। অন্য কাজে ব্যবহৃত পানির চাহিদা মেটানো হয় নদীর পানি থেকে। বিশ্বের যে কোনো বড় শহরের তুলনায় ঢাকা শহরের এই সুযোগটা বেশি ছিল। কিন্তু নদী দখল ও দূষণের ফলে সেই সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

ফলে দেড় কোটি মানুষের পানির জোগান দিতে নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে। ফলে পানির স্তরও দিন দিন আরো নেমে যাচ্ছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।