আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেভাবেই তুমি সকাল দেখো...

....

ডেকাফোনিক আলট্রাসাউন্ড সিস্টেমে বাঙালী শিল্পী শুভমিতার গান বাজছিল। ছেলেটি আর মেয়েটি আকাশ চুম্বি বাড়ির এক ব্যালকনিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছিল সে গান। ঘন্টাখানেক আগেই তীব্র ঝড়ের মত হয়ে গেছে। এখন চারিদিক শান্ত, আকাশটা এক মায়াবী গোলাপী আলোয় ভরে আছে। সূর্য হেলে পড়েছে দিগন্তের কাছে, সন্ধ্যা নামবে একটু পরেই।

আকাশের এক পাশে নীলাভ আলোয় বিদ্যুতের ছটার মতন নানান নকশা খেলে বেড়াচ্ছে। ঝড়ের পর বাতাসে অক্সিজেনের পরিমান বেশ কমে যায়, নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। মেয়েটি ব্যালকনির বায়ু নিরুদ্ধ স্বচ্ছ পলিকার্বনেট শাটার টেনে দিয়ে অক্সিজেন রেগুলেটরটা বাড়িয়ে দেয়। বছর পঞ্চাশ আগে উপর্যুপরি কয়েকটা পরমাণু বোমা ফাটার পর থেকে আবহাওয়া অনেক পালটে গেছে। ঝড়ের সাথে মাঝে মাঝেই এসিড বৃষ্টি হয়।

দিন রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেকটাই বেড়ে গেছে। ওদের ভাষা বাংলা না, এখানে ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু কয়েক মাস হল ছেলে মেয়ে দুটি বাংলাভাষার ভীষণ ভক্ত হয়ে পড়েছে, ইন্টারনেটে বাংলা সাইট থেকে কিছু গান ডাউন লোড করার পর ওদের এই আসক্তি। এখানে পৃথিবীর ইন্টারনেট নিষিদ্ধ। কারোর জানার কথা নয়।

কেবল প্রতিরক্ষা বাহিনীর অন্তর্গত মহাকাশ গবেষণাগারের কাজের জন্য বাইরের ইন্টারনেট ব্যবহার হয়। ছেলেটি সামরিক সার্ভার থেকে হ্যাকিং এর সূত্র ধরে বাংলা সাইটগুলোর সন্ধান পেয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের সম্ভার ওদের অবাক করে তুলেছে। যেটুকু সুযোগ পেয়েছে হ্যাক করা ইন্টারনেটের সূক্ষ্ম অলিন্দ দিয়ে বাংলা শিখেছে দুজনে মিলে। শুভমিতার মন মাতানো গানের সুর ঘরের মধ্যে ভেসে বেড়ায়।

"যেভাবেই তুমি সকাল দেখ সূর্য কিন্তু একটাই যতভাগে ভাগ কর না প্রেম, হৃদয় কিন্তু একটাই............" হঠাৎ মেয়েটার গলায় ঝোলানো মোবাইলে তীব্র সংকেত বেজে ওঠে। গানটা বন্ধ করে মোবাইল ধরে কথা বলে সে। বাজতে থাকা এইরকম গানের কথা বাইরের কেউ জানুক ওরা চায় না। খুব অসুবিধায় পড়তে হবে। একদিন অসাবধানতায় এপার্টমেন্টের অধিকর্তা এসে শুনে ফেলায় প্রচন্ড অবাক হয়ে হাজার প্রশ্ন করেন, প্রথমতঃ এমন ভুলভাল প্রলাপ শোনার কারণ কি! তারপর কোত্থেকে পাওয়া গেল, কে দিল, কেন দিল... ওয়ার্নিংও দেন।

অবাক হবারই কথা, কারণ জায়গাটা পৃথিবী নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র আলফা সেন্টুরির একটা গ্রহ। আলফা সেন্টুরি পরষ্পরকে প্রদক্ষিণ করে চলা দুটি যমজ নক্ষত্র। সুতরাং তার কোন গ্রহের প্রাণীরা একটি সূর্যের কথায় অবাক হবেই তো। ওখানকার আকাশে দুটি সূর্য দেখা যায়। এছাড়াও শুধু একটি হৃদয়ের কথা বললে ওরা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকবে, অবিশ্বাস্য মনে করবে।

কারণ ওদের মস্তিষ্কের গঠন মানুষের থেকে একদম আলাদা। মানুষের হৃদয় বা মন একটাই, যার আধার মস্তিষ্ক। তার গঠন একসাথে একাধিক প্রসেস চালাতে পারে না। কিন্তু ওদের মস্তিষ্ক একাধিক ভাগে বিভক্ত, সোজা কথায় বললে ওদের মন মাল্টিপ্রসেসিং অপারেটিং সিস্টেমের মত, যা একসাথে একাধিক মানসিক প্রসেস এক্সিকিউট করতে পারে। তাই ওদের হৃদয়ও অনেকগুলো, তাদের পছন্দ অপছন্দগুলো আলাদা হতে পারে।

তাই মানুষের সিঙ্গল প্রসেসিং একটিমাত্র হৃদয়ের কথায় ওদের অবাক হবারই কথা। ওখানে যে শুধু একটি মেয়ে আর একটি ছেলের মধ্যে ভালোবাসার কথা ভাবা অস্বাভাবিক! মাল্টি প্রসেসিং হৃদয় খুঁজে নেয় একাধিক ভালোবাসার পাত্র পাত্রী। এ এক জটিল পারমুটেশান কম্বিনেশান। ওরা যেটা লুকিয়ে রাখতে চায়, তা হলো ওদের ভালোবাসা! কারণ খুবই অস্বাভাবিক ভাবে ওরা শুধুই পরস্পরকে ভালোবাসে। ওখানকার প্রাণীদের মানসিক গঠনের বিরুদ্ধে গিয়ে ওরা নিজেরা একদিন অনুভব করলো যে ওদের পরস্পরকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারছে না।

খুব ভীত হয়ে ওরা ডাক্তারের কাছে গেছিল চিকিৎসার জন্য। শুধু একজনকেই ভালোবাসার কলঙ্ক নিয়ে ওরা সমাজে বাস করবে কি করে! দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর হতাশ হয়ে ডাক্তার জানিয়েছিল কিছু করার নেই, ওদের দুজনেরই মস্তিষ্কের একটা জন্মগত ত্রুটি রয়েছে, যার চিকিৎসা সম্ভব নয়। ওদের মস্তিষ্কের মাল্টিপ্রসেস ইনিশিয়ালাইজ করার যে অংশটা রয়েছে তা একের বেশী প্রসেস লঞ্চ করতে অক্ষম। তাই ওদের মন মাল্টিপ্রসেসিং সাপোর্ট করে না, সুতরাং একটি হৃদয়ে একাধিক ভালোবাসার প্রশ্নই নেই। ডাক্তার আরো জানিয়েছিলেন এই অস্বাভাবিকতা খুবই বিরল যদিও ওদের আর সব কিছু স্বাভাবিক, কিন্তু উনি আগে কখনও শোনেন নি ।

সূর্য প্রায় দিগন্তরেখা ছুঁই ছুঁই, তাপমাত্রা একলাফে অনেকটা কমে গেছে। দুজন হাতের মধ্যে হাত রেখে আকাশের অরোরা বোরিয়ালিসের দিকে তাকিয়ে। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় দুজনের মুখ উদ্ভাসিত। ছেলেটি তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট সাজি বার করে, তাতে কয়েকটা রক্তিম কৃষ্ণচূড়া ফুল। মেয়েটি অবাক হয়, এখানে পৃথিবীর ফুল।

ওই গ্রহে কোন ফুল ফোটানো যায় না আবহাওয়ার প্রতিকূলতার কারণে। ছেলেটি ইন্টারনেটে এই ফুলের ছবি দেখে অনেক কষ্ট করে ক্যাড ডিজাইন থেকে থ্রি-ডাইমেনশানাল প্রিন্ট নিয়ে এসেছে তার দয়িতার জন্য। মেয়েটি এক হৃদয় উষ্ণতা ঢেলে দিয়ে গ্রহণ করে সেই ফুল। এবার মেয়েটি মোড়ক থেকে বার করে একটা সুন্দর ডিজিটাল ফোটোফ্রেম, যাতে পৃথিবীর অজন্তা গুহাচিত্রের সেই বিখ্যাত ছবির কপি। মুকুট পরা স্মিত হাস্য মানুষ হাতে ফুল নিয়ে মাথাটা ইষৎ হেলিয়ে।

ছেলেটি দুই হাত পেতে উপহার নেবার সময়েই টুক করে ডুবে যেতে চায় সূর্যটা... অন্ধকার নেমে ওদের মুখ থেকে প্রথম সূর্যের আভাটুকু মুছে দেবার আগেই আর এক পাশ থেকে উদয় হয় দ্বিতীয় সূর্য। অপর সূর্যের রক্তিম আলো রাঙিয়ে তোলে দুটি সিঙ্গল প্রসেসিং হৃদয়! ব্যালকনির পলিকার্বনেটের শাটার খুলে দেয় ছেলেটি। হোক না বাইরে অক্সিজেন কম, একসাথে সন্ধ্যা আর ভোরের আলো মাখানো এক ঝলক টাটকা বাতাস দুজনকে মুড়ে ফেলে। এই আলো আর বাতাস সারা গায়ে মেখে নিয়ে দুজন একসাথে গেয়ে ওঠে, যেভাবেই তুমি সকাল দেখ সূর্য কিন্তু...এক মুহুর্ত থমকে গিয়ে দুজন দুজনার চোখের দিকে তাকায়... তারপর হেসে ফেলে বলে... সূর্য কিন্তু দুটো!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।