- মা, ও মা ঘুমাইয়া গেছ মা। ও মা, কথা কও না ক্যা। মা, ও মা।
- হাসু, যা তো বিরক্ত করিস না
- মা, হুনো না, ঈদের আর কয়দিন বাকী
- কালকাই তো ঈদ, যা বাইরে যাইয়া খেল, বাপ আমার একটু ঘুমাইতে দে
- আগে কও আমারে আইজি একটা লাল জামা কিনা দিবা। মাঝখানে লাল ছোপ ছোপ থাকব।
কাইল আমি লাল জামা পইরা কুরবাণী দেখতে যামু।
- আইচ্ছা, হেইডা পরে দেহা যাইব। এখন যা তো।
- নাঃ আগে তুমি কইয়্যা লও। রোজার ঈদে বাবলু, খোকন, সজীব সবাই লাল জামা পইরা ঘুরতাছিল।
ওরা আমার পুরান জামা দেইখা হাসছে।
- আইচ্ছা দেহা যাইব। এখন যা তো।
হাসু খাটের নিচ থেকে প্লাস্টিকের বল নিয়ে বাইরে চলে যায়।
গাদাগাদি করে গড়ে ওঠা বারোটা ঘর, সেমি পাকা কিন্তু খুব ছোট ছোট।
হাসুদের ভিটা ছিল মাদারীপুরের অজো এক পাড়াগায়ে। হাসুর বাবা, রমিজ মিয়া ক্ষেতখামার নিয়ে মোটামুটি ভালই দিনাতিপাত করছিলেন। কিন্তু আডিয়াল খা করাল গ্রাসে দু বছর আগে হাসুরা সব হারিয়েছে। হারান মিয়ার ঢাকায় আসার প্রস্তাব পেয়ে রমিজ মিয়া যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিল। চার মাসে গলুয়ের চাল শেষ হয়ে এসেছিল।
সেই দিনই হারান মিয়ার সাথে ঢাকায় এসে পরে রমিজের পরিবার। জুরাইনের এক সেমি পাকা বিল্ডিংয়ে ওদের ব্যাবস্থা করে দেয় হারান মিয়া।
ছোট ছোট খুপরীর মত পাশাপাশি বারোটা ঘর। বাড়ির গেটে হারান টোকা মারতেই ওরা এক মহিলার গোঙ্গানীর আওয়াজ পেল। ভাত দিতে দেরী হওয়ায় ওই মহিলার স্বামী তাকে অকথ্য গালিগালাজ করছিল।
রমিজ মিয়ার যত সমস্যাই গিয়েছে সে মনোয়ারার সাথে কখনো এই ভাষায় কথা বলেনি। সেই বাসায় পা দিয়েই মনোয়ারার বুক কেপে উঠেছিল অজানা শংকায়। যাই হোক হারান মিয়ার কাছ থেকে একটা খুপড়ীর মত রুম বুঝে নিয়ে রমিজ মিয়া যেন হাফ ছেড়ে বাচল। পরদিন হারান মিয়া রমিজ মিয়ে তার রিক্সা গেরেজে নিয়ে যায়। মহাজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
রোজ ৬০ টাকা জমা। রমিজ মিয়া রিক্সা পেল। যদিও সে কিছুই চেনে না তার পরেও সে দিন ১২০ টাকা আয় হয়েছিল তার। টুকটাক কিছু সদায় করে বাড়ি ফিরছিল, আর তার একটা একটা সপ্নের জাল বুনছিল...ছেলেকে ভাল স্কুলে ভর্তি করতে হবে, মনোয়ারার জন্য একটা শাড়ী কিনতে হবে, টাকা জমিয়ে সে কি করবে এই সব হাজারো চিন্তা। সে দিনটার কথা রমিজ যে কতবার শুনিয়েছিল মনোয়ারাকে।
এ ভাবে বছরটা ভালই গিয়েছিল। রমিজ মিয়া, হারান মিয়াকে ধরে রিক্সার লাইসেন্স বের করে ফেলল। তখন বেশী উপার্জনের জন্য বড় রাস্তায় চালানো শুরু করল। বড় রাস্তায় চালানোর দ্বিতীয় দিনেই এক্সিডেন্ট করে মারা যায় হাসুর বাপ। মনোয়ারা এখন বাসায় বাসায় কাজ করে।
হারান মিয়াই তাদের আগলে রেখেছে। এই নিচু শ্রেণীতে ক্ষুধার্ত পুরুষের সব দৃষ্টি থেকে তাকে রক্ষা করে রেখেছে হারান মিয়াই।
ঘুম থেকে উঠে হাসুকে নিয়ে কাজের বাসায় যায় মনোয়ারা। আজ একটু দেরী হয়ে গেছে। মনোয়ারা এই বাসাতে কাজ করছে প্রায় মাত্র এক মাস।
বেগম সাহেবার একটা ছেলে আছে, সে হাসুর চেয়ে বড়ই হবে। হাসু তার সাথে খেলতে পারে। আগে যে বাসায় কাজ করত তার সাহেবের বদলী হওয়াতে তারা চট্টগ্রাম চলে গেছে। এখন এই নতুন বাসায় ঈদের বখসিস চাওয়াটা তার বাধছে...মাত্র এক মাস কাজ করেছে সে এখানে। লজ্জামাখা মুখে সে বেগম সাহেবার কাছে হাসুর জন্য একটা জামা আবদার করল।
বেগম সাহেবা এত অল্পদিনে ঈদের বকশীশ দিতে চাইলেন না, আবার মনোয়ারার মনও ভাঙ্গতে চাইলেন না। ও এই কথা দাঁড়াও বলে সে তার ছেলের একটা লাল জামা নিয়ে এলেন। আর বললেন, এই জামাটা অনেক দামী, এক হাজার টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল। বাবু এটা দু মাস মাত্র পরেছে। এদিক দিয়ে একটু ছিড়ে গেছে, একটু সিলিয়ে নিও।
ঠিক আছে, খুশি তো। মনোয়ারা আর কিছু বলতে পারল না। মনোয়ারা দেখল, জামাটা ছেড়া হলেও দেখতে সুন্দর...ধোয়া মনে হল তার কারন ময়লা নেই। হাসুর গায়ে মানাবে। একটু সেলাই করতে হবে এই আর কি? মনোয়ারা হাসুকে ডাক দিলেন, “হাসু, চল চল বাড়ি চল, আর খেলতে হবে না, জামা কিনতে হবে না।
” বেগম সাহেবা কিছু বুঝলেন না। মনোয়ারা তাকে আরো বিভ্রান্ত করতে মুচকি হাসি দিয়ে হাসুকে নিয়ে চলে আসল।
- মা, ও মা
- কি কস
- আমি স্কুলে যামু। অনিকের অনেক বই। আর আমার বই একটা।
অনিকের বইতে কত রকম ছবি আকা আছে। আমারি তুমি কিন্তু একটা ছবিয়ালা বই কিনা দিবা।
- কি ব্যাপার মা, বাড়ির দিকে ঢুকতাছ ক্যান, মার্কেটে যাইবা না। আমার জামা কিনবা না।
- হ বাবা, ক্ষুধা লাগছে তো, আগে গোসল টোসল কইরা লই, তার পরে খাইয়া একটু ঘুমাবি।
তার পর তরে নিয়া মার্কেটে যামু। এখন গেলে তরে মাইনষে দেখলে কি কইব।
- কি কইব
- কইব, ইস ক্যামুন দেহা যায়। খায় নাই, ঘুমায় নাই।
- ঘুম থাইক্যা উইঠ্যাই কিন্তু তুমি আমারে লইয়া মার্কেটে যাইবা।
- হ হ ঠিক আছে এখন তাড়াতাড়ি চল।
বাড়িতে এসে আর ঝামেলা করে না হাসু। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাকে ঘুম পাড়িয়ে মনোয়ারা পাড়ার দোকানদারের কাছে গিয়ে রিপু করিয়ে এনে ইস্ত্রী করিয়ে এনে একটা শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। হাসু ঘুম থেকে উঠেই দেখল তার পাশে একটা শপিং ব্যাগ পরে আছে।
দেখে ওটার মাঝে একটা লাল জামা। লাল জামা দেখেই তার মনটা যেন খুশীতে টগবগ করতে লাগল। লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমেই চিৎকার করা শুরু করল, “মা, ওমা”
- আইতাছি, হাক দিল মনোয়ারা।
- মা, ও মা,
- আরে বাবা আইতাছি তো
- এইডা আমার নতুন জামা
- হ বাবা, পর তো দেহি, গায়ে লাগে নাকি দেহি
মনোয়ারা জামার ভাজ খুলে পরিয়ে দিতে লাগলেন। ছেলের হাসি ভরা খুশী মুখ দেখে তার মনটা ভড়ে গেল।
হাসুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার রমিজের মুখখানি মনে পড়ে গেল। হাসুকে কতই না ভালবাসত রমিজ। আর তাদের ভালবাসাবাসির ধনকে নাকি অন্যের ফেলে দেয়া জামা পড়াতে হচ্ছে। হঠাৎ বুকটা তার ভারী হয়ে গেল। বুক ফেটে যেন একটা গরম বাতাস বের হয়ে গেল।
হাসুর সে দিকে খেয়াল নেই, মা এটা ভাজ করে রাইখ, কাইলক্যা পড়মু। হাসু জামাটা মার দিকে ছুড়ে দিয়ে দৌড়ে বাইরে খেলতে চলে। গেল। মনোয়ারা হাসুর যাবার পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর চোখ দিয়ে যেন তপ্ত লালঅশ্রু বয়ে যাচ্ছে....।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।