ে
বীরবল ও গোপাল ভাঁড়ের গল্প
জিয়ারত হোসেন
বাংলা সাহিত্যে রম্যরচনার প্রসার ও ব্যবহার আছে বিস্তর। রম্যরচনা কৌতুকমুখী হলেও এর মুখ্যবানী সমাজের নিয়ম-নীতি ও মূল্যবোধ তুলে ধরা। অনেক সময় রম্যরচনা নিতান্তই হাসি-ঠাট্টা মনে হলেও এর পিছনে রয়েছে সূক্ষ্ চিন্তাবোধ। বাঙালী সমাজে গোপাল ভাঁড় ও বীরবলের কৌতুক ও প্রজ্ঞার কথা অতি পরিচিত।
বীরবল:
বীরবল ১৫২৮ সালে যমুনার তীর সংলগ্ন টিকাভানপুরে এক দরিদ্র ব্রাম্মন পরিবারে জন্ম নেন।
তার প্রকৃত নাম ছিলো মহেশ দাস। প্রজ্ঞা, কৌতুক ও ন্যায়-বোধের জন্যে তিনি সম্রাট আকবরের রাজসভায় একজন উপদেস্টা হন। তিনি আকবরের সামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকান্ডের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। কথিত আছে তিনি ১৫৮৩ সালে আফগানিস্থান অভিযানে মারা যান। তার মৃত্যুতে সম্রাট খুব মর্মাহত হন এবং কয়েকমাস কাল বেশ কাতর ছিলেন।
বীরবলের রচিত কবিতাও ছিলো সমাদৃত। কিন্তু তিনি বেশী পরিচিত তার প্রজ্ঞা ও যুক্তিপূর্ন বাক্য বিনিময়ের জন্যে। সম্রাট আকবরের সাথে বীরবলের কথাপোকথন আজও আমাদেরকে বীরবলের কৌতুক ও প্রজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই কথাপোকথনগুলো বীরবলের গল্প হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। তিনি হাস্য-কৌতুকের আবরনে কোন ব্যক্তি বা ঘটনার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতেন।
একদিন সম্রাট আকবর দরবারের সমবেত সকলকে নিয়ে খোশ-আলাপ করছিলেন। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ সে ব্যক্তিকে কি সাজা দেয়া হবে যে আমার গোঁফ টানবে?” কেউ বললো বেত্রঘাত। কেউ বললো, “ ব্যাটাকে শূলে চড়ান”। কেউ বললো শিরোচ্ছেদ। বীরবল চুপচাপ ছিলো।
সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, “ কি বীরবল, তুমি কি বল?” বীরবল বললো, “জাহাপনা, তাকে মিষ্টি খেতে দিন!” সম্রাট রেগে উঠলেন। “তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? যে ব্যাটা আমার গোঁফ টানবে তাকে মিষ্টি খেতে দেবো?” বীরবল ধীরে সুস্থে বললো, “হুজুর, আমার মাথা ঠিকই আছে। এই পৃথিবীতে আপনার পৌত্র ছাড়া আর কোন ব্যাক্তির সাহস হবে আপনার গোঁফে টান দিতে? জাহাপনা, আপনিই বলুন, আপনার গোঁফ টানার জন্যে নাতীকে মৃত্যুদন্ড নাকি মিষ্টি দিবেন?” সম্রাট বীরবলের সুক্ষ চিন্তায় আবারো খুশী হলেন।
একবার সম্রাট আকবর বীরবলকে আদেশ দিলেন তাঁর রাজ্যের সবচেয়ে বেশী চারজন বোকা লোককে ধরে নিয়ে আসতে। বীরবল সময় চেয়ে বোকা লোক খুঁজতে দরবার হল থেকে বের হয়ে গেল।
রাস্তায় বের হতে বীরবল দেখলো একজন মস্ত পুরুষ বিরাট কাঁসার বাসনে করে কিছু ঝলমলে কাপড়-চোপড়, পান ও মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছে। কৌতুহলী মনে বীরবল লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এসব জিনিস নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? লোকটি বললো, “আমার স্ত্রী আমাকে তালাক দিয়ে অন্য একজন পুরুষের সাথে বের হয়ে গেছে। তাদের একটা সন্তানও হয়েছে। তাদের জন্যে এই উপহার নিয়ে যাচ্ছি। ” বীরবল ভাবলো এই হতভাগাটার মতো দ্বিতীয় কোন বোকা লোক এই রাজ্যে বোধহয় আর নেই।
বীরবল তার নাম-ঠিকানা রেখে পথ চলতে লাগলো।
কিছুটা পথ পার করে বীরবল দেখলো এক লোক মহিষের পিঠে চড়ে যাচ্ছে এবং লোকটার মাথায় বিরাট একটা ঘাসের বোঝা। বীরবল জিজ্ঞেস করলো, “তুমি মহিষের পিঠে যাচ্ছো, কিন্তু ঘাসের বোঝা নিজের মাথায় বইছো কেন?” লোকটা বললো, “ আজ্ঞে মহাশয়, আমার মহিষ গর্ভবতী। তার পিঠে বেশী ওজন দেয়া ঠিক হবেনা। আমাকে পিঠে নিয়ে হাটতেই মহিষটার কষ্ট হচ্ছে।
তাই ঘাসের বোঝা মহিষের পিঠে না দিয়ে আমার মাথায় করে নিচ্ছি”। বীরবল ভাবলো এই মহেষ ওয়ালা আরেক বোকার হদ্দ। তার নাম-ঠিকানা নিয়ে বীরবল চলে গেল।
কয়েকদিন পরে বীরবল এই দু’জন লোককে নিয়ে আকবরের দরবারে হাজির হলো। বললো, “হুজুর আপনার রাজ্যে বাস করা বোকাদের দরবারে নিয়ে আসলাম”।
সম্রাট বললেন, “ এখানেতো মাত্র দু’জন। আমি বলেছিলাম চারটে বোকা ধরে আনতে”। বীরবল দু’হাত জোড় করে বললো, “জাহাপনা, বোকাদের খুঁজে খুঁজে ধরে আনতে আমি হয়েছি তৃতীয় বোকা। আর বোকাদের ধরার আদেশ দিয়ে আপনি হলেন চতুর্থ বোকা। সব মিলে আমরা হলাম চার বোকা।
“ বীরবলের কাছে ধৃত দু’জন বোকার কাহিনী শুনে সম্রাট আকবর হেসে ফেললেন।
গোপাল ভাঁড়:
১৭০০ শতাব্দীতে গোপাল ভাঁড়ের জন্ম হয় কৃঞ্চনগরের এক নিম্নবিত্ত বাঙালী পরিবারে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ না পেলেও, তিনি তার বুদ্ধিদীপ্ত বাদানুবাদ ও ব্যবহারের জন্যে ভীষন পরিচিতি লাভ করেন। হাস্য-রস ও বুদ্ধিদীপ্ত আচরনের জন্য কৃঞ্চনগরের (বর্তমান পশ্চিমবাংলার নদীয়া অঞ্চল) রাজা কৃঞ্চচন্দ্র তাকে রাজ্যসভায় স্থান দিয়েছিলেন। তিনি হাস্য-রস দিয়ে রাজাকে আমেদিত করতেন এবং অনেক সমস্যা সুরাহায় সাহায্য করতেন।
একবার মুর্শিদাবাদের নবীন নবাব সিরাজউদ্দোলা বেড়াতে বেড়াতে কৃঞ্চনগর রাজ্যে এসে পৌঁছালেন। রাজার পিতৃশ্রাদ্ধের জন্যে রাখা ষাড়টি আলগা খেয়ে খেয়ে আরো মোটা তাজা হয়ে উঠেছে। একদিন নবাবের সামনে এসে পড়ল ষাড়টি। ভোজন বিলাসী নবাব আলগা ষাড়টি মালিকবিহিন মনে করে ধরে নিয়ে গেলেন তার ক্যাম্পে। মজাদার ভোজ হবে ষাড়টি দিয়ে।
খবরটি পৌঁছল রাজা কৃষচন্দ্রের কাছে। চিন্তায় পড়লেন তিনি। ষাড়টি ফেরৎ চেয়ে নবাবকে ক্ষ্যাপানো ঠিক হবে না। তাছাড়া তার রাজ্যে মুসলমান নবাব গরু জবাই করে খেলেতো হিন্দু ধর্মের আর মান থাকবে না। চিন্তায় চিন্তায় বিষন্ন হলো রাজা।
গোপাল দরবারে এসে জানতে চাইলো রাজা এতো বিষন্ন কেন। ঘটনা শুনে গোপাল রাজাকে অভয় দিয়ে বললো, “আমি অনায়াসে ষাড়টাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবো”। রাজা বললো, “দেখিস, নবাব যেন ক্ষেপে না যায়”। রাজাকে সম্নান জানিয়ে গোপাল রওয়ানা হলো নবাবের ক্যাম্পের দিকে।
গোপালের হাসি-ঠাট্টা নবাবের অজানা নয়।
অনেক হাস্য-রস বিনিময়ের পর গোপাল জিজ্ঞেস করলো, “নবাব সাহেব, এই ষাড়টি এখানে বাঁধা রয়েছে কেন?” “ষাড়টি জবাই করে বিরাট এক ভোজের আয়োজন করছি কাল,” বললো নবাব। গোপাল বললো , “হুজুর হলেন দয়ার সাগর, বেড়াতে এসেও কৃষনগরের লোকদের উপকার করতে ভুলেননি। নবাব কিছু বুঝে উঠতে পারলোনা। জিজ্ঞেস করলো, “ভোজের জন্যে ষাড় জবাই দেবো – এতে কৃষনগরের লোকের উপকার হবে কিভাবে?” গোপাল জানালো, “নবাব বোধহয় জানেন না যে এই ষাড়টি শাক-সবজি নয় মানুষের মল ও শুকুরের বিষ্ঠা খেয়ে এতো নাদুস নুদুস হয়েছে। ফলে ষাড়টির গায়ে ভীষন গন্ধ এবং এলাকার লোকজন এটাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচে”।
নোংরা খাবার খেয়ে ষাড়টি নাদুস-নুদুস হয়েছে কথাটা ভেবে নবাবের ভোজের জন্যে ক্ষুধা মিটে গেল! তিনি আদেশ দিলেন ষাড়টি দুরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসতে। গোপাল নবাবকে সেলাম ঠুকে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে গেল। রাজা কৃষচন্দ্র ষাড়টি ফিরে পেয়ে গোপালকে পুরস্কার দিলেন।
অন্য একটা গল্পে আছে যে গোপালের এক দরিদ্র প্রতিবেশী ছিলো। লোকটি অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো করার চিন্তায় সবরকম দিবা স্বপ্নে বিভোর থাকতো।
একদিন সে তার স্ত্রীকে বললো, “ আমার কিছু টাকা হলে কয়েকটা গাভী কিনবো”। স্ত্রী বললো, “আজ্ঞে, তা’হলে আমাদের অনেক দুধ থাকবে। দুধ দিয়ে ঘি ও মাখন বানাবো”। স্বামী বললো, “ দুধ ও ঘি বিক্রি করে অনেক টাকা করতে পারবো”। স্ত্রী বললো, “বেশী দুধ হলে আমার বোনকে কিছুটা দিতে পারবো”।
স্বামী বললো, “সেকি কথা? তোমার বোনকে কোন দুধ দেয়া যাবে না। বরং অতিরিক্ত দুধ বিক্রি করে সংসারে আরো টাকা আনবো”। এভাবে বাদানুবাদে স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া বেধে গেল। স্বামী আরো বললো, “আমি যখন বাড়ীতে থাকবো না তখন যেন আমার অনুপস্থিতিতে তোমার বোনকে চুপি চুপি দুধ দিতে না পারো তার ব্যবস্থা আমি করছি”। এ-কথা বলে সে বাড়ীর হাড়িগুলো ভাঙ্গতে লাগলো।
স্বামী বললো, “তোমার হাড়ি সব ভেঙ্গেঁ দিচ্ছি। হাড়ি না থাকলে তুমি তোমার বোনকে আর দুধ দিতে পারবে না”।
তখন তাদের বাড়ীর পাশ দিয়ে গোপাল যাচ্ছিল। লোকটির হাড়ি ভাঙ্গার কর্ম দেখে জিজ্ঞিস করলো, “হ্যাগো হাড়ি ভাঙ্গছো কেন?” সব শুনে গোপাল তার হাতে থাকা একটা বাঁশের লাঠী মাথার উপর শূন্য আকাশে খোঁচা দিতে থাকলো। গোপালের ব্যবহার দেখে প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করলো, “ গোপাল বাবু তুমি লাঠি দিয়ে শূন্যে খোঁচা দিচ্ছ কেন?” গোপাল উত্তর করলো “তোমার গরু তাড়িয়ে দিচ্ছি।
তারা আমার সবজি বাগানের শশা খেয়েছে”। লোকটি আশ্চার্য হয়ে বললো, “ তোমার বাগানের শশা খেয়েছে? তোমারতো কোন সবজী বাগানই নেই! শশা আসবে কোথা থেকে?” গোপাল বললো, “একদিন আমার বাগান হবে। তখন বাগানে অনেক শশা ফলবে”। এ কথা বলে গোপাল আবার আকাশের দিকে লাঠি দিয়ে খোঁচা দিতে থাকলো। এতোক্ষনে প্রতিবেশী বুঝতে পারলো সে ভুলে নিজের বাড়ীর হাড়ি ভাঙ্গছে।
সে গোপালকে ধন্যবাদ দিলো তার ভুল ভাঙ্গানোর জন্যে।
একদিন রাজা কৃষচন্দ্র গোপালের বুদ্ধি পরীক্ষার জন্যে এক ফন্দি আটলেন। রাজা বললেন, “গোপাল, বড় চিন্তায় আছি”। গোপাল জিজ্ঞেস করলো, “মহারাজ, কিসের চিন্তা আপনাকে ভাবনায় ফেলেছে?” রাজা বললেন, “সত্য ও মিথ্যার মাঝে দূরত্ব কতটুকু তা ভেবে পাচ্ছিনা। তুমি কি এ ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারে?” গোপাল বললো, “ এ আবার তেমন কঠিন ভাবনার কথা হলো! চোখ ও কানের মাঝে যে দুরত্ব, সত্য ও মিথ্যার মাঝেও সেই দুরত্ব”।
রাজা গোপালের কথার মানে বুঝতে না পেরে বিশ্লেষন দাবী করলেন। গোপাল বললো, “ মহারাজ, যা কানে শুনবেন তা যদি চাক্ষুষ প্রমান করতে পারেন, তাহলে সেটাই হবে সত্যি। আর যা কানে শুনবেন কিন্তু চাক্ষুষ প্রমান নেননি, সেটা সত্যি বলে ধরে নিবেন না। তাহলে দেখা যায় সত্য-মিথ্যার সাথে চোখ-কানের একটা শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। সেজন্যে বলেছি চোখ-কানের মাঝে যে দুরত্ব, সত্য-মিথ্যার মাঝে সেই দুরত্ব”।
রাজা কৃষচন্দ্র বুঝতে পারলেন গোপাল শুধু ভাঁড় নয়, বুদ্ধিমানও বটে।
সূত্র:
১. কে. এম. আনিসুর রহমান (গোপাল ভাঁড়ের সেরা গল্প)
২. http://www.bharatadesam.com
3. http://www.english-for-students.com
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।