"ধর্মীয় কুসংস্কারে যারা আবদ্ধ তারা সব সময়েই দরিদ্র থাকে। " মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন
সৃষ্টিশীল মানুষ দুই ধরনের সম্পদ নিয়ে ধরণীতে শিল্পিত জীবন যাপন করে। প্রথমতঃ বস্তুগত সম্পদ, যা হতে পারে স্থাবর কিংবা অস্থাবর; যেমনঃ জায়গা-জমি, গাড়ি-বাড়ি, টাকা-পয়সা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, নানা রকম প্রাত্যহিক ব্যবহার্য দ্রব্যাদি ইত্যাদি। দ্বিতীয়তঃ মেধাসম্পদ (Intellectual Property) বা সৃজনশীল কর্ম, এর আওতায় আছে- সাহিত্যকর্ম, নাট্যকর্ম, শিল্পকর্ম, সঙ্গীতকর্ম, অডিও-ভিডিওকর্ম, চলচ্চিত্রকর্ম, ফটোগ্রাফি, ভাস্কর্যকর্ম, সম্প্রচারকর্ম, কম্পিউটার সফটওয়্যার, রেকর্ডকর্ম, ই-মেইল, ওয়েব-সাইট, বেতার ও টেলিভিশন সমপ্রচারকর্ম ইত্যাদি। কারো বস্তুগত সম্পদ যেমন প্রকৃত মালিকের পূর্বানুমতি বা মূল্য পরিশোধ ছাড়া ভোগ বা ব্যবহার করতে পারে না, মেধাসম্পদের ক্ষেত্রেও একই বিধান সমানভাবে প্রযোজ্য।
অথচ বস্তুগত সম্পদ রক্ষায় সারা পৃথিবীর মানুষ ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যতটা সচেতন ও কর্তব্য পরায়ন, মেধাসম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে ঠিক যেন তার বিপরীত, বিশেষ করে এশীয় প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোতে। মেধাসম্পদের রক্ষা ও এর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যে শব্দটি সংশ্লিষ্ট তা হচ্ছে কপিরাইট (Copyright) বা কর্মের অধিকার। আমরা যদি কপিরাইট শব্দটি বিশ্লিষ্ট করে অর্থ বিশ্লেষণ করি তা হলে এর অর্থ দাঁড়ায়- কপি করার অধিকার। অর্থাৎ সকল ধরনের সৃষ্টিশীল কর্মই কর্মের স্রষ্টা বা রচয়িতার অনুমতি ছাড়া কপি করা বা পুনরুৎপাদন করা, সেটা বাণিজ্যিক বা ব্যক্তিগত, যে পর্যায়েই হোক না কেন, তা কপিরাইট ধারণা, আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক চুক্তি, দেশীয় আইন, নৈতিকতা ও ইতিবাচকবোধের চরম পরিপন্থী।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কপিরাইট অফিস একটি আধা বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান।
এর প্রধান কাজ হচ্ছে দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সৃজনশীল ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক প্রণীত/রচিত সৃজনশীল কর্মসমূহের কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন এবং সনদ প্রদান, রেজিস্ট্রিকৃত কর্মসমূহের নমুনা সংরক্ষণ, এতদসংক্রান্ত- সকল ধরনের পাইরেসি রোধকরণসহ কপিরাইট সংক্রান্ত- বিরোধসমূহ নিষ্পত্তিকরণ। কপিরাইট আইন ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) এর বিধান দ্বারা কপিরাইট অফিস পরিচালিত হয়। কপিরাইট সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড সবসময় একাধিক পক্ষ সংশ্লিষ্ট। কপিরাইট আইনে সংশ্লিষ্ট সৃজনশীল ব্যক্তিবর্গের জন্য দেওয়ানী এবং ফৌজদারী উভয় ধরণের প্রতিকারের বিধান রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ World Intellectual Property Organization (WIPO) এর সদস্যভূক্ত দেশ হিসেবে WIPO পরিচালিত বার্ন কনভেনশন, UNESCO পরিচালিত ইউনিভার্সেল কপিরাইট কনভেনশন (UCC) এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্কার (WTO) সদস্য হওয়ার কারণে এতদসংক্রান্ত, TRIPS (Trade Related Aspects of Intellectual Property Rights) চুক্তিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য চুক্তি কনভেনশনের কপিরাইট সংক্রান্ত সকল শর্ত মেনে চলতে বাধ্য।
অনেক সময় দেখা যায়, এক একটি পার্সোনাল কম্পিউটারের চেয়ে কম্পিউটারে ব্যবহারের জন্য তৈরি এক একটি প্রোপ্রাইটরি (অরিজিন্যাল) সফটওয়্যারের দাম অনেক বেশি। ফলে ইচ্ছে থাকা সত্যেও উচ্চ মূল্যের কারণে অনেকের পক্ষেই হয়তো প্রোপ্রাইটরি সটওয়্যারের মূল কপি ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। যা প্রচলিত কপিরাইট আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘণ। মাইক্রোসফট যদি ঘোষণা দেয়, এই দেশে বেআইনিভাবে (পাইরেটেড কপি) কেউ তার অপারেটিং সিস্টেম এবং অন্যান্ন সফটওয়্যার আর ব্যবহার করতে পারবেন না, তাহলে আমাদের কি হতেপারে একটু ভেবে দেখতে পারেন। জাতীয় তথ্য ও প্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯ –এর ২৮৭ নং ক্রমিকে বলা হয়েছে, “ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে, বিশেষতঃ Total Cost of Ownership (TCO) -এর আলোকে ওপেন সোর্স সফটওয়্যার এবং প্রোপ্রাইটারি সফ্টওয়্যার এর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
কোন ব্যবসায়িক প্রস্তাবে TCO দৃষ্টিকোণ থেকে ওপেন সোর্স সফটওয়্যার সুবিধাজনক বিবেচিত হলে তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে”। এখন কথা হচ্ছে, ওপেন সোর্স সফটওয়্যার কী?
একটি সফটওয়্যারের সোর্স কোড বা এর সংকেত যখন কোন ব্যবহারকারীর নিকট উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় তখন এটিকে উন্মুক্ত, মুক্ত বা ফ্রী সফটওয়্যার বলা হয়। মুক্ত সফটওয়্যারের মূল কথাই হল মেধাসত্ত্বঃ কারও কুক্ষিগত সম্পদ নয়। এটি সকলের জন্য উন্মুক্ত। ওপেন সোর্স সফটওয়্যারগুলো সারা পৃথিবীর অসংখ্য কম্পিউটার বিজ্ঞানী, গনিতবিদ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদের পুরোপুরি স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে উঠেছে।
কোন সফটওয়ার চালানো, কপি করা, বিতরণ করা, তার খুঁটিনাটি জানা এবং তা পরিবর্তন ও উন্নত করার স্বাধীনতাই হল ফ্রী সফটওয়ারের মূল কথা। সারা বিশ্বে ওপেন সোর্স প্রোডাক্টগুলো একটি লাইসেন্সের অধীনে সকলের জন্য সুলভ করে তোলা হয়। সেই অসাধারণ লাইসেন্সটি হলো জিএনইউ জিপিএল। সোর্সকোড বিষয়টি হয়তো অনেকের অজানা। সব সফটওয়্যারই প্রোগ্রামিং কোড (সি, সি++, জাভা) লিখে তৈরি করা হয়।
সফটওয়্যারের পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করার প্রয়োজন হলে ওই প্রোগ্রামিং কোডে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করতে হয়। এ প্রোগ্রামিং কোডকে বলা হয় সোর্সকোড। ওপেন সোর্স সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে আপনি, আমি বা যে কেউ কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে নিজের প্রয়োজন অনুসারে সোর্সকোডের পরিবর্তন করে সফটওয়্যারকে কাস্টমাইজ করতে পারি। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোন একটি মাত্র কোম্পানি এই সফটওয়্যারের মালিক নয়। আরো বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে এটি সফটওয়ার ব্যবহারকারীদের চারপ্রকার স্বাধীনতার কথা বলেঃ “যে কোন উদ্দেশ্যে সফ্টওয়্যারটি চালানোর স্বাধীনতা; সফটওয়ারটির কার্যপদ্ধতি জেনে নিজের প্রয়োজন মত তাকে পরিবর্তন করার স্বাধীনতা (এর একটি পূর্বশর্ত হল সফটওয়ারটির সোর্সকোড পড়তে পারা); সফটওয়ারটির কপি পুনঃবিতরণের স্বাধীনতা; এবং সফটওয়ারটি উন্নত করা ও সমাজের সুবিধার্থে উন্নত সংস্করণটি সকলের ব্যবহারের জন্য প্রকাশের স্বাধীনতা” এই প্রধান চারটি শর্তসহ আরো কিছু শর্ত পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেই কেবল জিএনইউ জেনারেল পাবলিক লাইসেন্স (GPLv3) এর আওতাভুক্ত হওয়া সম্ভব।
এই স্বাধীনতাসমূহের সবগুলো প্রদান করলেই কেবল একটি সফটওয়ারকে ফ্রী সফটওয়াররূপে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং এরকম একটি সফটওয়ারকে আপনি পরিবর্তিত বা অপরিবর্তিত অবস্থায়, বিনামূল্যে কিংবা অর্থের বিনিময়ে এবং যেকোন স্থানে যেকোন ব্যক্তির নিকট পুনঃবিতরণ করতে পারবেন। যেকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেকোন ধরনের কম্পিউটারে যেকোন কাজের জন্য প্রোগ্রামটি ব্যবহার করতে পারবে। একাজগুলো করার জন্য আপনাকে কারো নিকট থেকে কোন অনুমতি নিতে হবে না কিংবা অনুমতি লাভের জন্য কাউকে কোন অর্থও প্রদান করতে হবে না।
সফটওয়ারটি ইচ্ছামত পরিবর্তন করার এবং পরিবর্তিত সংস্করণটি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও সকলের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে; এক্ষেত্রে সফটওয়ারটির মূল সংস্করণের কথা উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন নেই।
আর যদি সফটওয়ারের পরিবর্তিত সংস্করণটি প্রকাশ করা হয়, তবে কোন বিশেষ ব্যক্তিকে কোন বিশেষ উপায়ে কোন কিছু জানানোরও কোন বাধ্যবাধকতা থাকতে পারবে না।
‘ফ্রী সফটওয়ার’ মানেই কিন্তু ‘অবাণিজ্যিক’ সফটওয়ার নয়। যেকোন ফ্রী প্রোগ্রামকে অবশ্যই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার, পরিবর্তন ও বিতরণ করার অনুমতি সম্বলিত হতে হবে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ফ্রী সফটওয়ার তৈরি করা আজ আর কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়; তাছাড়া এধরনের বাণিজ্যিক ফ্রী সফটওয়ারের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
[ লেখকঃ মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রোগ্রামার, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।
ই-মেইলঃ ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।