বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
৬৫০ খ্রিস্টপূর্বর মাঝামাঝি। অপরাহ্নকাল। প্রাচীন ভারতের বারানসী নগরের উপকন্ঠে গঙ্গা নদীর নির্জন পাড় ঘেঁষিয়া হাঁটিতেছিল সৌম্য।
নীলাভ আকাশের নীচে চরাচর জুড়িয়া মধ্য-ভাদ্রের বিনম্র রৌদ্র ছড়াইয়া ছিল। পাটলরঙা জলরাশি তটে আছড়াইয়া পড়িতেছিল; তাহার ছলাত ছলাত শব্দ উঠিতেছিল। নদীর পাড়ে শুভ্র কাশের বিস্তারিত জঙ্গল। তাহার নিকটেই একটি ডাহুক আসিয়া নামিল; পাখিটির ডানার কৃষ্ণকায় পালক ও বুকের শুভ্র বর্ণের পালকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইয়া যায় সৌম্য। সহসা কাশের বন হইতে একটি ধূসর বর্ণের শৃগাল ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে ডাহুকটির দিকে দৌড়াইয়া যায়।
সৌম্য উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। শৃগালটি কি পাখিটিকে আক্রমন করিবে? ভাবিতেই ডাহুকটি শূন্যে উড়িয়া গেল। শৃগালটি চোখের নিমিষে অদৃশ্য হইয়া যায়।
সৌম্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল।
সুযোগ পাইলেই প্রকৃতিতে সবল প্রাণি দূর্বল প্রাণিকে নির্মম ভাবে আক্রমন করিয়া বসে - ইহা সৌম্যের নিকট এক নিষ্ঠুর রক্তাক্ত চক্রের ন্যায় ঠেকে; সে এই রক্তচক্র মানিয়া লইতে পারে না।
মনোরম প্রকৃতির সহিত প্রগাঢ় নৈকট্য অনুভব করে সৌম্য; সে নিরামিষাশী, মাছমাংস খায় না। অরণ্য হইতে ব্যাধ পশুপাখি শিকার করে, তাহাতে মনুষ্যসমাজে মাংসের সংস্থান হয়। ইহা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু নিছক আনন্দ লাভ করিবার জন্য কিছু সংখ্যক মানুষ পশুপাখি শিকার করিয়া বেড়ায়- ইহার কি ব্যাখ্যা? সৌম্যের বন্ধু কল্যাণ নিছক আনন্দলাভের জন্য তীর-ধনুক লইয়া পশুপাখি শিকার করিয়া বেড়ায়। সৌম্য বারংবার বারণ করিয়াছে, কল্যাণ কর্ণপাত করে নাই।
গঙ্গার পাড়ে একাই হাঁটিতেছিল সৌম্য; তাহার সারথী ও দেহরক্ষীগন অবশ্য আশেপাশেই রহিয়াছে।
সৌম্যর একা থাকিতে ভালো লাগে। একা থাকিয়া সে চিন্তামগ্ন হইয়া থাকে। তবে সে নির্জনতাপ্রিয় হইলেও তাহার উপর অর্পিত দায়িত্ব অবহেলা করে না। স¤প্রতি সৌম্য তাহার পিতা কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হইয়াছে। সৌম্যর পিতা অশ্বসেন; কাশী রাজ্যের একজন ধনবান শ্রেষ্ঠী ।
হাতির দাঁত-এর বানিজ্য করিয়া শ্রেষ্ঠী অশ্বসেন প্রভূত অর্থ উপার্যন করিয়াছেন। গঙ্গার পাড়ে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করিবার উদ্যেগ গ্রহন করিয়াছেন শ্রেষ্ঠী ।
তরুণ সৌম্য সে নির্মাণ কাজের তত্ত্ববধান করিতেছে ।
দিবসের আলোক মুছিয়া গিয়া ধীর লয়ে সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছিল। আকাশের রং দ্রুত বদলাইয়া যাইতেছিল।
পাখিরা কেহ-বা একা, কেহ-বা দল বাঁধিয়া নীড়ে ফিরিতেছিল। সৌম্য অনির্দিষ্ট পদক্ষেপে হাঁটিতেছিল। তাঁহাকে চিন্তামগ্ন দেখাইতেছিল। তাহার কারণ আছে। তাহার সম্মুখে এক বিষম বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
গতকাল রাত্রিতে প্রদীপের আলোয় ঋকসংহিতা পাঠ করিতেছিল সৌম্য। ঋকবেদ ইন্দ্র-বরুণ প্রমূখ দেবতাদের স্তুতিতে পরিপূর্ণ -যা বিভৎস যজ্ঞের দ্বারাই সম্পন্ন হয়; ইহাতে সৌম্যের বেদপাঠ নিরানন্দ ঠেকে। সে রক্তাক্ত যজ্ঞ সমর্থন করিতে পারে না। সে ভাবিয়া পায় না প্রাণিহত্যা করিয়া দেবতার কৃপালাভ কিরূপে সম্ভব? যজ্ঞের অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হইলে প্রাণিগনের কি যন্ত্রণা অনুভূত হয় না? যখন আর্যবর্ত জুড়িয়া নিরন্ন ও গৃহহীন মানুষের ক্রন্দন ধ্বনি উঠিতেছে - তখন যজ্ঞে ঘৃত ও কাষ্ঠের বিপুল অপচয় করিয়া কার কী লাভ? ... পার্শ্বের ভাবনায় ছেদ পড়িল। মা আসিয়া ঘরে ঢুকিল, তাহার পর বিবাহের কথা তুলিল ।
সৌম্য অস্বস্তি বোধ করিতে থাকে । সে জানে তাহার বিবাহের জন্যে অস্থির হইয়া আছে। মা বলিল, তোর বিবাহের জন্য আমরা একটি সুকন্যার সন্ধান পাইয়াছি।
সৌম্য চুপ করিয়া থাকে।
মা বলিল, কন্যা অযোধ্যার রাজকুমারী প্রভাবতী।
লোকে বলে প্রভাবতী সুন্দরীশ্রেষ্ঠা।
সৌম্য তাহার ভিতরে গভীর উদ্বেগ টের পাইল। তাহার হৃদয়ে বিপুল জ্ঞানতৃষ্ণা আর বিশ্ব জগৎ সম্বন্ধে অপার কৌতূহল বিরাজ করে। সে বিশ্ব জগৎ সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করিতে চায়। সংসারধর্ম পালন করিয়া তাহা সম্ভব নয়।
তাহাকে জ্ঞানলাভ করিতে হইবে। এখন সংসারের মায়ায় জড়াইয়া গেলে সৌম্য জ্ঞানলাভ করিবে কি করিয়া? জ্ঞানলাভই যাহাদের মোক্ষ-তাহাদের কি বিবাহ করা উচিত? মা বলিল, রাজকুমারী প্রভাবতী সুন্দরী। তাহা না হয় বোধগম্য হইল, কিন্তু রাজকুমারীর মনের গড়নটি কীরূপ। তাহার হৃদয়ে কি করুণার অনুভূতির উষ্ণ স্রোত বহমান? তাহার কাছে কি দান ও ধ্যানের গুরুত্ব সর্বাধিক? সে কি দাসদাসীর প্রতি নির্মম আচরণ করে? সে কি শূদ্রদিগকে মিছিমিছি গঞ্জনা দেয়? বিবাহের পর মৃগয়ায় যাইতে চাইবে না তো প্রভাবতী ? হরিণ বধ করিতে বলিবে না তো? বন্ধু কল্যাণ-এর মৃগয়ার প্রবল তৃষ্ণা। তাহার তীরের ফলা পাখির রক্তে নিয়ত রঞ্জিত হয় ।
তাহার সঙ্গে সৌম্যের সম্পর্ক ক্রমশ শীতল হইয়া আসিতেছে। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইলে গঙ্গার ঘাট হইতে সুলভ ললনাদের তুলিয়া লইয়া নির্জন উদ্যানবাটিকায় লইয়া যায় কল্যাণ, তাহার পর তাহাদের সহিত বন্য কামক্রীড়ায় মত্ত হইয়া উঠে। সৌম্য বিবমিষা বোধ করে। প্রভাবতী তাহার স্ত্রী হইতে পারে, তবে তাহার সঙ্গে কামের সম্পর্ক স্থাপন করা সহজ হইবে না, যৌন বিষয়ে গভীর সঙ্কোচ বোধ করে সে। এই সমস্ত উপলব্দি না-করিয়াই মা অবুঝের মতন বিবাহের জন্য অস্থির হইয়া উঠিয়াছেন।
এখন কি করা?
বহু মানুষের কন্ঠস্বরে বাস্তবে ফিরিয়া আসিল সৌম্য।
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। চতুর্দিকে ভাদ্রের থই থই জোছনার ঢল নামিয়াছে। জোছনায় আলোকিত মাঠের দিকে তাকাইল সৌম্য। গঙ্গার পাড় ঘেঁষিয়া সবুজ ঘাসের বিস্তির্ণ মাঠ; এই মাঠেই দ্বিতল প্রাসাদ নির্মিত হইবে।
প্রবেশ পথের সমুখে নির্মান করা হইবে কষ্টি পাথর একটি শিবমূর্তি । শ্রেষ্ঠী অশ্বসেন শিবভক্ত; উপরোন্ত, কাশী রাজ্যের লোকের বিশ্বাস- বারানসী নগরটি প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন স্বয়ং শিব । এমন কী বেদ সংহিতায় বারানসী নগরের কথা উল্লেখিত হইয়াছে। আর্যবর্তে কাশী রাজ্যের বারানসী নগরটি অত্যন্ত পবিত্র বলিয়া গন্য হয়।
নির্মাণ ক্ষেত্রটি ঘিরিয়া বহুসংখ্যক মশাল জ্বলিয়া উঠিয়াছে।
বহু মানুষের কর্ম ব্যস্ততা পরিলক্ষিত হয়। নির্মাণ শ্রমিকের অস্থায়ী ছাউনি গড়িয়া উঠিয়াছে। আর্যাবর্তের নানা স্থান হইতে গরুর গাড়ি করিয়া কাঠ-পাথরসহ নির্মাণ সামগ্রী আসিতেছে। শ্রমিক ও শূদ্রেরা সেইসব নির্মাণসামগ্রী বহন করিয়া যথাস্থানে লইয়া যাইতেছে। আগামীকাল প্রাসাদের শিলান্যাস হইবে।
সেই উপলক্ষে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হইবে । সৌম্য বিবমিষা বোধ করে। সৌম্যের পিতামাতা ও অন্যান্য অতিথিবর্গ যজ্ঞানুষ্ঠানে উপস্থিত থাকিবেন ।
কষ্টি পাথরের স্তুপে হেলান দিয়া দাঁড়াইয়া ছিল যাদবদা। যাদবদার পরনে ধূতি, খালি গা।
কাশী রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থপতি যাদবদা। সৌম্যের পিতা অশ্বসেন শিবমূর্তি নিমার্ণের ভার তাহার উপরই দিয়াছেন। যাদবদার বয়েস অনুর্ধ ত্রিশ হইবে; মাঝারি আকারের শক্ত সমর্থ গড়ন, গাত্র বর্ণ শ্যাম । চুলের ইষৎ জটা ধরিয়াছে, মুখ ভর্তি দাড়িগোঁফ। যাদবদার হাতে একখানি কাঁসার পাত্র।
তাহাতে সোমমদ । যত্রতত্র সোম পান করে যাদবদা, তবে কখনোই যাদবদাকে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হইয়া যাইতে দেখে নাই সৌম্য।
যাদবদা সৌম্যকে দূর হইতেই দেখিতে পাইয়াছে। সৌম্য নিকটে আসিতেই ঈষৎ হাসিয়া কাঁসার পাত্রখানি উপরে তুলিয়া যাদবদা বলিল, কি? পান করিবে নাকি?
সৌম্য হাসিল। মাথা নাড়িল।
বলিল, না যাদবদা।
যাদবদা জানে সৌম্য মদ্যপান করে না। বস্তুত, সৌম্যর সঙ্গে বন্ধুর ন্যায় আচরণ করে বলিয়ই যাদবদা যাদবদা ঈষৎ রহস্য করিল। যাদবদা শিল্পী বলিয়াই গম্ভীর ও মৌন হইয়া থাকিলেও আলাপচারিতায় সৌম্যের সঙ্গে অত্যন্ত অমায়িক। বারানসী নগরে বিশ্বামিত্র গলিতে যাদবদার বাড়ি, জায়গাটি গঙ্গার ঘাটের সন্নিকটে।
যাদবদার বাড়িতে সৌম্যের অবাধ যাতায়াত। প্রায়শ দুইজনে মিলিয়া, ষড়দর্শন, উপনিষদ কিংবা পুরাণকথায় মগ্ন হইয়া উঠে। যাদবদার স্ত্রী বিদিশা বউদিও সেই প্রাণবন্ত তর্কালাপে যোগ দেয়। বিদিশা বউদির গাত্রবর্ণ শ্যাম হইলেও অত্যন্ত রূপসী এবং শরীর হইতে নিয়ত রহস্যময় বিদুৎঝলক বিচ্ছুরিত হয় । সৌম্য সে রহস্য ভেদ করিতে পারে না।
যাদবদার মা বিনোদিনী মাসিমা যথার্থ একজন রন্ধনশিল্পী। কত না বিচিত্র রান্না জানেন মাসিমা। নানা রকম পদ রাঁধিয়া সৌম্যকে খাওয়াইয়া সৌম্যকে বিমুগ্ধ ও কৃতজ্ঞ করিয়া ফেলে।
যাদবদা গম্ভীরকন্ঠে বলিল, সৌম্য।
বল যাদবদা।
তোমার পিতা আমাকে শিবমূর্তি নির্মাণের কার্যাদেশ দিয়াছেন বটে, কিন্তু, আমি জানি তিনি আমাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিবেন না।
সৌম্য চুপ করিয়া থাকে। তাহার পিতা অশ্বসেন বৈষয়িক। শ্রেষ্ঠী বলিয়াই কি বৈষয়িক? সৌম্য বলিতে পারে না। তাই বলিয়া যাদবের ন্যয় একজন মহৎ শিল্পীর সহিত বঞ্চনা করিবে? পিতার শিল্পবোধ নাই, তিনি শিল্পরসিক নন।
সৌম্য তাহার ভিতরে ক্ষোভ টের পাইল। যাদবদাকে সৌম্য অপরিসীম শ্রদ্ধা করে। কত কত সময় গঙ্গার ঘাটে বসিয়া যাদবদার সঙ্গে কত কত বিষয় লইয়া কথা বলিয়াছে। এই সব সংলাপের মর্ম পিতা যদি বুঝিতেন!
এক ঢোক সোম গিলিয়া যাদব বলিল, আমি তোমার পিতার নির্দেশিত কাজ সমাপ্ত নাও করিতে পারি।
কেন?
আমি কৃষ্ণের ভক্ত হইয়া উঠেতেছি।
কে কৃষ্ণ?
বলিব। তার আগে বলি-আর্যবর্তের মানুষের মনের ভাব বদলাইয়া যাইতেছে সৌম্য। আর্যবর্ত এখন বৈদিক যুগ ছাড়িয়া কৃষ্ণযুগে উপনীত হইয়াছে। লোকে এখন যাগযজ্ঞ পরিত্যাগ করিয়া ক্রমেই কৃষ্ণবাদী হইয়া উঠিতেছে। ভক্তিই কৃষ্ণবাদের মূলকথা।
কিন্তু, কে কৃষ্ণ? সৌম্যের কন্ঠে অস্থিরতা ফুটিয়া উঠিল।
বলিতেছি। কৃষ্ণ হইলেন মথুরার যাদবকূলের এক অসামান্য জ্যোর্তিময় বীরপুরুষ, লোকে বলে - তিনিই বিষ্ণুর অবতার।
সৌম্য চমকাইয়া উঠিল। বলিল, বেদের দেবতা বিষ্ণুর অবতার?
হাঁ।
এই কারণে কৃষ্ণভক্তদিগকে লোকে বৈষ্ণব বলিয়া ডাকে। বৈষ্ণবরা যজ্ঞবিরোধী, তাহারা মূলত নিরামিষাশী এবং সংগীতের মাধ্যমে আর্যবর্তে প্রেম ও ভক্তির প্রচার করিয়া বেড়ায়। তাহাদের মূল বক্তব্য হইল, ভক্তির মাধ্যমে মহেশ্বরকে পাওয়া যায়। এই কারণে কৃষ্ণের জন্মভূমি মথুরায় যাগযগেজ্ঞ ডামাডোল নাই, সেখানেই কেবলই প্রেম ও ভক্তির জয়গান। বৈষ্ণবদের সাধনভজনে পরমাত্মাকে অন্বেষন করিবার তাগিদ রহিয়াছে।
তাই বলিতেছি, আর্যবর্তের লোকের মনের ভাব বদলাইয়া যাইতেছে সৌম্য।
ওহ্ । কতকিছু অজানা রহিয়া গেল। সৌম্য কাতর হইয়া উঠিল। তাহার মনের ভিতরে রিন রিন করিয়া একটি অদৃশ্য বীণা বাজিয়া উঠিল।
গৃহত্যাগ না করিলে জ্ঞান পূর্ণ হইবে না, পিতার ন্যায় সংকীর্ণমনা যজ্ঞবাদী ও সৌন্দর্যবোধরহিত হইয়া জীবন অতিক্রম করিতে হইবে । যে জীবন মূলত অসার। বৃহৎ জগতের বিপুল ও বিচিত্র অভিজ্ঞাতায় স্নাত না হইলে বাঁচিয়া থাকিয়া কি লাভ। সংসার ত্যাগ করিবে সৌম্য। সংসারের ক্ষদ্র গন্ডী শুভবোধ সম্পন্ন চিন্তাশীলের জন্য নয়।
শুনিলাম তোমার নাকি বিবাহের কথাবার্তা চলিতেছে? যাদবদা জিজ্ঞাসা করিল।
আপনাকে কে বলিল!
কে আবার, তোমার সারথী সুরঞ্জন।
সৌম্য চুপ করিয়া থাকিল। তাহার পরে স্তিমিত কন্ঠে বলিল, আমিই আপনাকে বলিতাম ।
যাদবদা বিমর্ষকন্ঠে বলিল, বিবাহ করিবে ভালো কথা, তবে মনে রাখিও প্রণয় হইল জগতের প্রধানতম সুখের উৎস।
সেই সুখের আকর্ষনে তাড়িত হওয়াই নরনারীর নিয়তি। তবে প্রণয়ের আকর্ষন অধিক কাল স্থায়ী হয় না, প্রয়ণের সুখ ফুরাইলে নর ও নারী উভয়ই নতুন প্রণয়ের দিকে ছুটে। তাহাতে সর্ম্পকে তিক্ততা সৃষ্টি হয়, কখনও প্রাণবিয়োগও ঘটিতে পারে।
কই, আপনি তো বিদিশা বউদিকে ভুলিয়া যান নাই। কথাটি সৌম্যের মুখ ফসকাইয়া বাহির হইয়া গেল।
যাদবদা হাসিল। বড় মলিন সে হাসি। সৌম্যের কথার উত্তর না দিয়া এক ঢোঁক সোম গিলিল যাদবদা।
প্রণয়? এইসমস্ত আবেগ তুচ্ছ করিবে সৌম্য। যে তৃষ্ণা সহজে মিটে না, সৌম্য সেই তৃষ্ণার পিছনে অকারণে ছুটিবে না।
বরং সে জ্ঞানলাভ করিবে। জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করিবে। সৌম্য যাদবদার মুখের দিকে তাকাইল। বড় বিমর্ষ ও ব্যথিত একটি মুখ। যাদবদাকে দেখিয়া বোঝা যায় না তাহার ভিতরে কী ভয়ানক দুঃখের ঝড় বহিয়া যাইতেছে; কিছুকাল হইল বিদিশা বউদি এক তরুণ বীণাবাদকের হাত ধরিয়া নিরুদিষ্ট হইয়া গিয়াছে।
তাহার পর হইতে যাদবদা তীব্র মানসিক অশান্তি ভোগ করিতেছে। বিদিশা বউদির স্বভাব অতি চঞ্চলা ছিল। শরীরে উদ্যত যৌবন নদীর স্রোতের মতন খেলিয়া বেড়ায়। একদিন আড়ালে সৌম্যকেও গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিয়া চুম্বন করিয়াছিল। হৃদপিন্ডের সেই কম্পন বহুদিন ধরিয়া সৌম্য অনুভব করিয়াছিল।
হঠকারী এক সিদ্ধান্তের বশেই কল্যাণকে যাদবদার বাড়ি লইয়া গিয়াছিল সৌম্য। বিদিশা বউদি ঠিকই নারীমাংসলোভী সুখসন্ধানী কল্যাণের খল স্বভাবটি চিনিয়া লইয়াছিল। তাহারা যাদবদার চোখের আড়ালে প্রণয়ে লিপ্ত হইয়াছিল ।
সৌম্য নিজেকে ধিক্কার দেয় ...
পরের দিন প্রভাত হইতেই বেদপাঠ চলিল। যজ্ঞের মূল অনুষ্ঠান আরম্ভ হইতে হইতে অপরাহ্ন হইল।
যজ্ঞস্থলের এক পার্শ্বে বেষ্টনী তুলিয়া তাহার উপরে আচ্ছাদন দেওয়া হইয়াছে। তাহার নীচে আসন পাতিয়া অশ্বসেন বসিয়া আছেন। তাহার পাশে সৌম্য এবং সৌম্যর পাশে তাহার মা বসিয়া আছেন। নিকটেই কাশী রাজ্যের মন্ত্রী সুমিত্র, অযোধ্যার প্রতিনিধি বীরসেন ও অন্যান্য অতিথিগন বসিয়া আছেন।
যজ্ঞস্থল হইতে দূরে শ্রমজীবি শূদ্ররা সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়াইয়া ছিল।
যজ্ঞে তাহাদের অধিকার নাই। তাহারা যাহা দেখিবে, দূর হইতেই দেখিবে। তাহাদের যজ্ঞবেদির নিকটে আসিবার অধিকার নাই, অথচ ইহাদের ঘামশ্রমেই শ্রেষ্ঠী অশ্বসেনের সুরম্য প্রাসাদখানি নির্মিত হইবে।
যজ্ঞের পুরোহিত বৃদ্ধ। তাহার পলিত কেশ, গাত্রবর্ণ গৌড়, তিনি রক্তবর্ণের পট্টবস্ত্র পরিয়া আছেন।
তাহার সহকারীরা অবশ্য নবীন। তাহারা প্রতেকেই মুন্ডিত মস্তক এবং হলুদ রঙের গেরুয়া বসন পরিহিত। তাহারা ইতোমধ্যেই যজ্ঞস্থলের কেন্দ্রে খুঁটির সঙ্গে একটি কৃষ্ণ বর্ণের হৃষ্টপুষ্ট ষাঁড় বাঁধিয়া রাখিয়াছে । ষাঁড়টি ঘিরিয়া রাশি রাশি কাঠ ¯ত’পীকৃত করিয়া রাখিয়াছে, এবং তাহার উপর মাটির ঘট হইতে ঘি ঢালিবার প্রস্তুতি নিতেছে।
পুরোহিতের ইঙ্গিত পাইয়া নবীন ঋত্বিকগন কাঠের রাশির উপর ঘি ঢালিতে লাগিল।
সৌম্য অস্থির হইয়া উঠিল।
পুরোহিতের ইঙ্গিতে একজন নবীন ঋত্বিক কাঠের স্তুপে অগ্নি সংযোগ করিল।
নিমিষে দাউদাউ করিয়া আগুন জ্বলিয়া উঠিল।
পুরোহিত উচ্চস্বরে মন্ত্রপাঠ করিতে লাগিলেন।
সৌম্য ছটফট করিয়া উঠিল।
সে তাহার পিতাকে বলিল, বাবা! যজ্ঞের আগুনে জীবন্ত প্রাণি হত্যা করিয়া কী লাভ?
কী কারণে শ্রেষ্ঠী অশ্বসেন আজ প্রসন্ন ছিলেন না। তিনি ক্রোধে উন্মক্ত হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, তুমি এই মুহূর্তেই যজ্ঞস্থল ত্যাগ কর! অর্বাচীন! কুলঙ্গার! আমি অনেক সহ্য করিয়াছি, দিনদিন তোমার আচরণ সহ্যের সীমানা ছাড়াইয়া যাইতেছে। তুমি এক্ষুণি যজ্ঞস্থল হইতে নিঃক্রান্ত হও।
সৌম্যের মুখখানি আরক্ত হইয়া যায়।
তাহার মাথা টলিয়া উঠিল। সে উঠিয়া দাঁড়াইল। আগুনের সংস্পর্শে আসিয়া ষাঁড়টি মর্মান্তিক চিৎকার করিতেছে। সেই চিৎকার সৌম্যের নম্র স্নায়ূতে তীব্র যন্ত্রণা সৃষ্টি করে। চারিদিক ক্রমেই ধোঁওয়ায় আচ্ছন্ন হইয়া যাইতেছে।
বাতাসে কাঠ পোড়া আর মাংসপোড়ার গন্ধ ছড়াইয়াছে।
দ্রুতপদে যজ্ঞস্থল ত্যাগ করিতে থাকে সৌম্য। তাহার সর্বাঙ্গ থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। অতিথিদের সম্মুখে পিতা নিদারুন র্ভৎসনা করিল। আজই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত লইবে সৌম্য - প্রেমশূন্য মনুষ্যত্বহীন মানুষের সঙ্গ আর নয়, আর্যবর্তের পরিসীমা অনেক বিশাল, সে পথে নামিবে।
স¤প্রতি পিতার সঙ্গে অন্য একটি বিষয়ে বিরোধ বাঁধিয়াছে সৌম্যর। আগামীকাল পিতা সবান্ধব গঙ্গা পাড়ের অরণ্যে মৃগয়ায় যাইবে। সৌম্য যাইবে না। সৌম্য প্রকৃতির সহিত নিবিড় মৈত্রী অনুভব করে, প্রাণী হত্যা তাহার পক্ষে সম্ভব না।
চারিদিক ধোঁওয়ায় আচ্ছন্ন।
যজ্ঞস্থলের বাইরে বাইরে অনেকগুলি রথ। সৌম্য তাহার রথের সারথী সুরঞ্জনকে দেখিতে পাইল না। সম্ভবত সে যজ্ঞানুষ্ঠানের নারকীয় দৃশ্যে মগ্ন হইয়া আছে।
সৌম্য এক লাফে রথে উঠিয়া বসিল। তাহার পর বারানসী নগর অভিমুখে রথ ছুটাইয়া দিল।
মায়ের মুখখানা তাহার মনে পড়িল। পিতা অপমান করিল, মা প্রতিবাদ করিল না। চুপচাপ বসিয়া থাকিল।
ঝড়ের গতিতে রথ চালাইয়া বারানসী নগরে উপস্থিত হইল সৌম্য।
পিতার সঙ্গে অভিমান করিয়া যাদবদা আজ যজ্ঞস্থলে আসে নাই।
নগর পরিত্যাগ করিবার পূর্বে যাদবদা সঙ্গে একটিবার দেখা করা দরকার। যাদবদাই ছিল সৌম্যের সুখ-দুঃখের একমাত্র সঙ্গী।
বিশ্বামিত্র সড়কের এক সংকীর্ণ গলিপথের সম্মুখে রথ থামাইল সৌম্য। গলিপথ সংকীর্ণ বলিয়া ভিতরে রথ যাইবে না। রথ হইতে নামিয়া সৌম্য হাঁটিতে লাগিল।
দুই পাশে পুরনো প্রাচীর, নর্দমা। প্রাচীরের ওপাশে দরদালান। দালানের অলিন্দ ও আলসেতে বানর ছোটাছুটি লাফালাফি করিতেছে। বাঁ পাশে একটি শিবালয়। প্রবেশ পথে একটি বট গাছ।
একটি সাদা রঙের ষাঁড়।
দরজা খুলিলেন বিনোদিনী মাসিমা।
আজ সৌম্য নগর পরিত্যাগ করিবে। ঝুঁকিয়া মাসিমার পদধূলি গ্রহন করিল। তাহার পর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, যাদবদা কই মাসিমা?
যাদব তো তিন দিন হইল বাড়ি আসে নাই।
কেন তাহার সঙ্গে কি তোমার সাক্ষাৎ হয় নাই?
যাঃ! যাদবদার সঙ্গে দেখা হইল না!
হতাশ বোধ করে সৌম্য। বিমর্ষ বোধ করিলে গঙ্গার ঘাটে আসিয়া বসিয়া থাকে সৌম্য। আজও অন্যমনস্ক হইয়া পায়ে পায়ে গঙ্গার ঘাটের কাছে আসিয়া পড়িল। কী করিবে বুঝিতে পারিতেছে না। ভীষণ অস্থির লাগিতেছিল।
সূর্য অস্তগামী হইতেছিল। তাহার রক্তিম কিরণ চওড়া ঘাটের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। সিঁড়িতে ভিড়। সিঁড়ি নামিয়া গিয়াছে জলের কিনারায়। ঘাটে নৌকার ভিড় ।
সহসা একটি নৌকায় যাদবদাকে বসিয়া থাকিতে দেখিল সৌম্য।
দ্রুত নামিয়া আসিল সৌম্য। উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, যাদবদা, তুমি কোথায় যাইতেছ?
আমি পশ্চিমে যাইব।
পশ্চিমে?
হ্যাঁ, পশ্চিমে। মথুরার শ্রীকৃষ্ণধামে।
বলিয়া যাদবদা হাসিল।
আমিও যাইব।
তুমি কি গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত লইয়াছ?
সৌম্য মাথা নাড়িল।
আমি জানিতাম। চল, তাহা হইলে ... ভালোই হইল।
মথুরায় যজ্ঞ নাই, পশুহত্যা নাই, কেবল প্রেম আছে, গান আছে। শ্রীকৃষ্ণ চমৎকার বাঁশী বাজান, সেই সুরময় ধ্বনিময় স্থানই তোমার উপযুক্ত হইবে।
সৌম্য নৌকায় উঠিল।
ভালো করিয়া তাকাইয়া দেখিল নৌকার ছইয়ের নীচে এবং উপরে অন্ধ খঞ্জ ব্যধিগ্রস্থ বিমর্ষ শোকার্ত বঞ্চিত নরনারী।
বিস্মিত হইয়া যায় সৌম্য।
নৌকা ছাড়িল।
যাদবদা গোপালকৃষ্ণের বালকবেলার ইতিবৃত্তটি বলিতে লাগিল- যে উপাখ্যানে যজ্ঞের রক্তপাত নাই, বরং প্রতিবাদ আছে।
প্রেম ও মৈত্রীর সম্পর্ক ঘনিষ্ট বলিয়া সৌম্য মন দিয়া শুনিতে লাগিল।
যাদবদা বলিল, শ্রীকৃষ্ণধামে আমি বিদিশার বিশাল একখানি মর্মরমূর্তি গড়িব সৌম্য । সেই মনোরম মূর্তিখানি দেখিতে আর্যবর্তের শতসহস্র মানুষ আসিবে।
তাহাদের মধ্যে বিদিশাও কি থাকিবে না? থাকিবে। আমি তখন হয়তো বৃদ্ধ ...বৃদ্ধ হইলে কি? প্রেম তো আর ফুরাইবে না ...
শুনিতে শুনিতে সৌম্যের চোখ দু-খানি আধবোজা হইয়া আসে।
ততক্ষণে গঙ্গাবক্ষে ও চরাচরে ভাদ্রের প্রগাঢ় জোছনা ফুটিয়া উঠিয়াছে।
নৌকা ভাসিয়া চলিল ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।