আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ড্যাপ বাস্তবায়নে ধীর গতি কেন?

গণমাধ্যমকর্মী, চেয়ারম্যান - উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান, সদস্য সচিব - সম্মিলিত জলাধার রক্ষা আন্দোলন।

ড্যাপ বাস্তবায়নে ধীর গতি কেন? কিছুদিন ড্যাপ নিয়ে পত্রপত্রিকায় খুব শোরগোল হয়েছে। তারপর এখন আবার সব চুপচাপ। এখন মনে হচ্ছে এ নিয়ে যেন কারও কোন মাথাব্যথা নেই। কেন? এখানে একটু পেছনে ফিরে যাই।

জুলাই মাসের একটি দিন। শুক্রবার। সেদিন ব্যতিক্রমী এক সমাবেশের আয়োজন করা হয় রাজধানীর চারুকলার সামনে। আয়োজক তাদের সম্মিলিত জলাধার রা আন্দোলন। তাদের দাবি রাজধানীর ঢাকার বসবাসের উপযোগী করার জন্য জলাধার দখলকারী ভূমিদস্যু প্রতিরোধ করার পাশাপাশি দ্রুত নগরীর জলাশয়গুলো রা এবং পরিকল্পিত নগরায়ণ।

বর্ষাকালে বর্ষণই প্রত্যাশিত। এই সময়ে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হলেই বরং জনমনে নানা উদ্বেগ দেখা দেয়। কিন্তু বহুল প্রত্যাশিত সেই বৃষ্টিই আশীর্বাদ না হয়ে রাজধানীবাসীর জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সামান্য বর্ষণেই জলমগ্ন হয়ে পড়ে রাজধানীর বিস্তীর্ণ এলাকা। অচল হয়ে পড়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।

চলতি মৌসুমে মাঝারি বর্ষণেই মারাত্মক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে বহু এলাকায়। পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল রাজধানীর মৌচাক, মিরপুর, যাত্রাবাড়ি, রায়েরবাজার, মেরাদিয়া, খিলগাঁওসহ বেশকিছু এলাকার মানুষ। আর শান্তিনগর রূপ নেয় অশান্তির নগরীতে। বিশেষ করে মিরপুর শেওড়াপাড়া হতে ১১ নম্বর পর্যন্ত ব্যস্ততম সড়কটির বেশকিছু অংশই কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। মাত্র কয়েক ঘন্টা স্থায়ী এই জলাবদ্ধতা তথা জল জটের কারণে সৃষ্ট যানজটের।

রাজধানীর কোন কোন অংশ পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে। ব্যাহত হয় তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম। দীর্ঘসময়ের জন্য বর্ষণ অব্যাহত থাকলে রাজধানীর অবস্থা কী হবে তা কল্পনা করতেও ভয় হয়। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জলাধার দখলকারী ভূমিদস্যু দৈত্যদের রুখে দেয়ার এখনই সময়।

একটি কথা আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে, মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে অস্ত্রোপচার কক্ষের টেবিলে রেখে সময়পেণ মানেই রোগীর মৃত্যুকেই ত্বরান্বিত করা। কাজেই এই মুহূর্তে আর বিতর্ক নয়। আর নয় কালপেণ। উচিত কাজে লেগে পড়া। স্বাধীনতার পূর্বে শুধুমাত্র এই শহরে ৪৭টি খাল ছিল।

বেশিরভাগ খালের প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটের বেশি। স্বাধীনতার পর মাত্র তিন যুগের ব্যবধানে জলাধার দখলকারী ভূমিদস্যু দৈত্যদের থাবায় রাজধানী ঢাকা মহানগরী এলাকার ২৫টি খাল বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানে ২২টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও তা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এছাড়া ঢাকার চারপাশের সীমানা ঘিরে আছে পাচঁটি নদী, দখল আর দূষণে এই জলাধারগুলোর অবস্থা সংর্কীণ। আমরা বিশেষ করে রাজধানীতে যারা বসবাস করছি তারা বেশির ভাগ সময় বলে থাকি ‘রাজধানী ঢাকা বাসযোগ্যতা হারিয়ে দিন দিন নাজুক অবস্থায় যাচ্ছে’।

কিন্তু সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের রাজধানী আমাদের প্রিয় ঢাকা মহানগরীকে পৃথিবীর দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ শহর হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। খবরটি রাজধানীবাসীর জন্য নিঃসন্দেহে আতঙ্কের। যার আলামত ইতোপূর্বে টের পাওয়া গেছে। বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে গাড়ি, বাড়ছে অট্টালিকা, বাড়ছে বস্তি। খাল-নদীগুলো ময়লার ভাগাড়Ñদখল দূষণের শিকার।

তার ওপর কদিন বাদে বাদেই আসছে দুর্বিপাকÑঅগ্নিকাণ্ড, ভবন ধস। যার পরিণাম নির্মম ও অসহায় মৃত্যু। আর এই রাজধানীতে কত মানুষের মৃত্যু হলে ঢাকা নিরাপদ হবে? তথাকথিত উন্নয়নের নামে, নগরায়নের নামে ক্রমেই সংকটাপন্ন হচ্ছে ঢাকার অবস্থা। আর এই থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে অবশ্যই চলমান যথেচ্ছাচার থামাতে হবে। পরিকল্পিত নগরায়নের পথে আসতে হবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, আমাদের দেশের কিছু স্বার্থানেষী মহল যেন রাজধানীর মানুষ নিরাপদে জীবনযাপন করুক এটা চান না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার বিশেষ করে ভূমি দখল-দূষণের বিরুদ্ধে গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর আবদুল মান্নান খানের সোচ্চার বক্তব্য একই সাথে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থান ঘোষণা ভুক্তভোগী নাগরিকদের সাধুবাদ পায়। গত ১৩ জুন। গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপ নিয়ে গৃহায়ন ও বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ) এবং রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে স্টেক হোল্ডার এই দুই সংগঠনের প থেকে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়নের প্রবল বিরোধিতা আসে, শুরু হয় বিতর্ক।

তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীসভা বৈঠক থেকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশের জন্য। প্রধানমন্ত্রী জলাধার দখলকারী ভূমিদস্যু দৈত্যদের বিরুদ্ধে তার সরকারের অনড় অবস্থানের কথা তুলে ধরে বলেন, ঢাকাকে বাঁচাতে হলে যে কোন মূল্যে ড্যাপ বাস্তবায়নের জন্য। এদিকে আবাসন ব্যবসায়ীদের সাথে তাল মিলিয়ে ঢাকার সংসদ সদস্যদের তরফ থেকেও ড্যাপ বাস্তবায়নে বিরোধিতার সুর শোনা যায়। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকা নিকটবর্তী গাজীপুর সরকার দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্যরা শুরু আন্দোলন। খোদ ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে আন্দোলনের নামে উষ্কে দিয়ে ভাংচুর করানো হয় প্রায় শতাধিক গাড়ি।

এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী অপর সংসদ সদস্য শ্রমিক নেতা শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপি’র বড় ছেলে ও প্রধানমন্ত্রীর স্নেহভাজন জাহিদ আহসান রাসেল। এব্যাপারে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি ধরা হয়েছে প্রায় ৫কোটি টাকা। জলাধার দখলকারী ভূমিদস্যু দৈত্যদের সাথে আঁতাত করে সরকার দলীয় এই এমপিদ্বয় ঘোষণা করেছিলেন ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না। যে কোন মূল্যে তা প্রতিহত করা হবে।

সরকারের কর্মকাণ্ডে বিরোধী এই প্রথম কোন সংসদ সদস্য বা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এমন অবস্থান পরিলক্ষিত হল। তাদের বক্তব্য ড্যাপ বাস্তবায়িত করতে হলে অনেক লোককে বাস্তচ্যুত করতে হবে; এর বিরূপ প্রভাব পড়বে তাদের নির্বাচনী এলাকায়। যার প্রেেিত গত ২১ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে ড্যাপ পর্যালোচনায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত, ভূমি, যোগাযোগ, পানিসম্পদ, নৌ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। এরই মধ্যে ১৫ জুন ড্যাপের চূড়ান্ত গেজেট জারি করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এ ত্বরিত তৎপরতা অনেকের কাছে প্রশংসা পেলেও, অপরদিকে তা বিরোধিতার আগুনে নতুন করে ঘি ঢালে জলাধার দখলকারী ভূমিদস্যু দৈত্যদের পক্ষ নিয়ে।

এদিকে জলাদার দখলকারী ভূমিদস্যূ দৈত্যদের পক্ষ নিয়ে এসব সংসদ সদস্যরা কি যে প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন তা তারা নিজেরাই জানেন না। গত ১৭ জুলাই। রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি রিসার্চ আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলে ছিলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতেই ড্যাপ’। সরকারকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে যারা তথাকথিত ড্যাপ করতে চান তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলেও মনে করেন ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যাতে না হয় সে জন্য অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির পরিকল্পনা থেকে ঘাপটি মেরে থাকা গোষ্ঠী ড্যাপ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে।

সূত্র : ১৮জুলাই বাংলাদেশ প্রতিদিন। ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও গাজীপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার বুঝা উচিত ছিল, ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশের জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রীই গৃহায়ণ ও গনপূর্ত প্রতিমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মন্ত্রীসভার বৈঠক থেকে। তার পরই ১৫জুল ড্যাপ’র চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ পায়। অথচ আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতেই ড্যাপ। তাহলে আমরা কি ধরে নেব? সাধারণ জনগোষ্ঠিই বা কি বুঝবে? তাই কথা বলার আগে একটু ভেবে নেয়া দরকার।

¯¦ার্থলোভীরা ড্যাপ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান। আবাসন শিল্প মালিকদের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেন, ‘জনগণের স¤পদ দখলকারীদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। সরকারি জমি দখলকারী কেউ পার পাবে না; কেউ পালাতে পারবে না। কোন ¯¦ার্থাšে¦ষী দুর্বৃত্তের কাছে সরকার মাথা নত করবে না। ’ তিনি বলেন, ¯¦ার্থলোভী কিছু মানুষ ছাড়া দেশের বেশির ভাগ মানুষ গেজেট আকারে প্রকাশিত ডিটেইল্ড এরিয়া প্যানের (ড্যাপ) ব্যাপারে একমত পোষণ করেছে।

কিন্তু ¯¦ার্থলোভীরা ড্যাপ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। তিনি বলেন, নগরায়ণের দরকার আছে। কিন্তু এলোমেলো নগরায়ণ জীবনযাত্রাকে অসহনীয় করে তোলে। ঢাকা তার বড় প্রমাণ। আবদুল মান্নান খান বলেন, শহরে অনেক খাসজমি আছে।

তবে সেগুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে। মুষ্টিমেয় লোক এগুলো গ্রাস করছে। যারা মানুষের স¤পদ পুঁজি করে বড়লোক হওয়ার লালসা ধারণ করে, তারাই ড্যাপের বিরোধিতা করছে। যারা নদী-নালা ও খাল-বিল দখল করে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে জনগণকে প্রতারিত করে। ড্যাপের গেজেট হওয়ায় তাদের হƒৎক¤পন শুরু হয়েছে।

যদিও ড্যাপ একটি টেকনিক্যাল বিষয়। এটা বিশেষজ্ঞদের দিয়েই প্রণীত। রাজধানী ঢাকার নগরায়নকে একটি মহাপরিকল্পনার আওতায় আনার মহৎ ল্য নিয়ে ‘ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)’ বলে ঢাকা শহরের মাস্টার প্ল্যানের একটি কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল সেই ১৯৯৫ সালে, যা আজ পর্যন্ত ঝুলে আছে। দীর্ঘদিন পর গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ড্যাপ নিয়ে আবার কাজে উদ্যোগী হয়। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃতে ড্যাপ পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়।

তারপর মহাজোট মতায় আসার পর তারাও অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকেই প্রধান রেখে ড্যাপ পর্যালোচনায় ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করে ২০১০ সালের ৭ মার্চ। এ সরকার আমলে আবারো ড্যাপ চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ স্বাভাবিকভাবেই জনমনে এক ধরনের আশাবাদ সৃষ্টি হয় যে, অন্তত কিছু একটা করা হচ্ছে। বর্তমান মহাজোট সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছে জলাধার দখলকারী ভূমিদস্যু দৈত্য দানবদের নির্দিষ্ট কিছু পোষিত মহল ছাড়া দেশের সর্বস্তরের জনগণ। উন্নয়নের নামে জলাধারগুলো ভরাট করে ড্রেনে, ইমারত কিংবা যেকোন স্থাপনায় রূপান্তরের কার্যক্রম পরিবেশ আইন ১৯৯৫, পরিবেশ নীতিমালা, বেঙ্গল ক্যানেল এ্যাক্ট ১৮৬৪, মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উম্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরণ আইন ২০০০ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিন্তু গুটিকয়েক ব্যক্তি ও আবাসন কোম্পানিগুলো অপ্রতিরোধ্য।

কঠোরভাবে শহরের জলাধারগুলো রা না করতে পারলে আগামী কয়েক বছরেই ঢাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। মহানগরের আগামী দিনের জলাবদ্ধতা, পরিবেশ-প্রতিবেশ, পানি সংকট মোকাবিলার বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে উন্মুক্তস্থান, কৃষি এলাকা, বন্যাপ্রবাহ এলাকা, জলাশয়, জলাধার রার মাধ্যমে ড্যাপ বাস্তবায়নের জরুরি। আমরা সাধারণ নাগরিকরা ড্যাব’র খুঁটিনাটি বিষয় বোঝার কথা নয়। তবে সাধারণভাবে যা জেনেছিÑ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজধানীকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট জোনে ভাগ করে অবৈধভাবে দখল করে নির্মিত ১৬টি আবাসিক প্রকল্প ও স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঢাকাকে বাঁচাতে নূন্যতম যেটুকু না করলেই নয় সেটুকুই সুপারিশ করা হয়েছে।

১৯৯৭ সালে অনুমোদিত ঢাকা নগরীর উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় ২০০৪ সালে ড্যাপ প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। এতে ঢাকাকে ২৬টি স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং জোনে ভাগ করা হয়েছে। এছাড়া ২১ শতাংশ এলাকা জলাশয় হিসেবে নির্ধারণের পাশাপাশি শহরকে জলাবদ্ধতা ও যানজটমুক্ত করতে ১৬টি সরকারি-বেসরকারি আবাসিক প্রকল্প ও স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার সুপারিশ করেছে ড্যাপ পর্যালোচনা কমিটি। এর মধ্যে ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের স¤প্রসারিত অংশ, পানগাঁও কন্টেইনার পোর্ট, কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দার বিসিক শিল্পনগরী, সাভারের বলিয়ারপুরে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)’র বর্জ্য ফেলার জায়গা, কেরানীগঞ্জে ১৪ ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেডের প্রস্তাবিত স্বতন্ত্র প্রশিণ এলাকা এবং কেরানীগঞ্জে প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় কারাগার প্রকল্পসহ মোট ৬টি সরকারি প্রকল্পকেও সরিয়ে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশকৃত ১০টি বেসরকারি প্রকল্প হচ্ছে-সাভারের বিলামালিয়ায় মধুমতি মডেল টাউন, ইস্টার্ন মায়াকানন, দণি রামচন্দ্রপুরের অ্যাডভান্সড অ্যাঞ্জেল সিটি, আশুলিয়া মডেল টাউন, কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ আবাসিক প্রকল্প, গাজীপুরের প্রবাসী পল্লী আবাসিক প্রকল্প, টঙ্গী পৌর এলাকার প্রত্যাশা আবাসিক প্রকল্প, উত্তরখানের শতাব্দী হাউজিং, সাভারের উত্তর কাউন্দিয়া মৌজার প্রস্তাবিত আদর্শ শিক আবাসন প্রকল্প এবং সাভারের রামচন্দ্রপুরের ঢাকা উদ্যান ও অন্যান্য আবাসিক প্রকল্প।

বেসরকারি এ প্রকল্পগুলো রাজউকের তালিকাভুক্ত অনুমোদনহীন ৫৬টি প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম। এ প্রকল্পগুলো ড্যাপে বর্ণিত মূল বন্যাপ্রবাহ এলাকা, উপবন্যাপ্রবাহ এলাকা অথবা কৃষিভূমির মধ্যে গড়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে রাজউক’র দাবি অধিকাংশই অনুমোদনহীন, ল্যান্ড ডেভলপাররা যে লে-আউট প্ল্যানগুলো সাবমিট করেছে তা থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৫টা প্ল্যানের প্রাথমিক অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তাও তাদের ফেজ ওয়াইজ, পূর্ণাঙ্গভাবে না। সেগুলো বাদে অন্যগুলোর মধ্যে দুইটা জিনিস আছে তার মধ্যে একটা হলো, আপনি একটা ব্যবসা করবেন তার জন্য সিটি করপোরেশন থেকে একটা ট্রেড লাইসেন্স করতে হবে, এটা হলো সেই রকম।

তার মানে এই নয় আপনি লে-আউট অনুমোদন করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঢাকাকে বাঁচানোর সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। শেষ রা করতে কমপে এ প্রকল্পগুলো সরিয়ে নিয়ে বন্যার পানি যাওয়ার জায়গা করে না দিলে খুব সামান্য বর্ষাতেই ঢাকা তলিয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞদের এ বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপ (রাজউক) ও বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। সোজা কথা, ড্যাপের ল্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কারো কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়।

আগেই বলেছি, ড্যাপের সক্রিয় বিরোধিতা আসছে মূলত দুটি প থেকেÑ আবাসন ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি। অবশ্য বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউও ড্যাপের ত্র“টি-বিচ্যুতি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লিখছেন। এটা স্বীকৃত যে, ঢাকা মহানগরীর এ নাজুক অবস্থা তৈরির পেছনে এক শ্রেণীর আবাসন ব্যবসায়ীর বড় ভূমিকা রয়েছে। যারা ঢাকার আশপাশের জলাভূমি গ্রাস করে নির্বিচারে ভরাট করছেন। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে, গড়ে তুলছেন বহুতল ভবনের বস্তি।

আর যার ফলে নগরজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে আতংক। আর আমরা ও আমাদের নতুন প্রজন্ম জেনেশুনেই ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন। কেননা সমস্যাপীড়িত, বসবাসের অযোগ্য রাজধানী শহর ঢাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। একের পর এক ভবন হেলে পড়ছে। ঘটছে ভবন ধসের মতো ভয়াবহ ঘটনা।

নির্বিচারে প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন অনেকে। গত ১ জুন রাজধানীর তেজগাঁস্থ বেগুনবাড়িতে একটি অবৈধভাবে নির্মিত পাঁচতলা ভবন ধসে পড়ে ২৫ জনের প্রাণহানি হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে পাশের আরেকটি অননুমোদিত ৭তলা ভবন হেলে পড়ে। ফাটল দেখা দেয় শান্তিনগর কনকর্ড গ্র্যান্ড নামে ২৩ তলার বহুতল একটি ভবনে।

এ ছাড়া পূর্ব নাখালপাড়ার রাজউকের অনুমোদনহীন একটি ৫তলা এবং মধ্য বেগুনবাড়িতে একটি ৪তলা অবৈধভাবে নির্মিত ভবন হেলে পড়ে। বেশ ক’বছর আগে সাভারের একটি বহুতল গার্মেন্টস ভবন ধসে বহু কর্মীর প্রাণহানি ঘটে। সম্প্রতি বেগুনবাড়ি ট্র্যাজেডি এবং একের পর এক ভবন হেলে পড়ার ঘটনায় রাজউক নড়ে চড়ে বসে। অবৈধভাবে নির্মিত ভবন চিহ্নিত করে ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নেয়। ইতোমধ্যে হেলে পড়া ভবনগুলো ভাঙ্গার কাজ শুরু হয়েছে।

রাজধানী ও এর আশেপাশে নিচু জমিতে এ ধরনের অসংখ্য বহুতল বিশিষ্ট ভবন রয়েছে যা নির্মাণে রাজউকের কোন অনুমোদন নেয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে রাজউকের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা তো রয়েছেই। তাদের পিয়ন থেকে কর্মকর্তাদের দুর্নীতি সুযোগেই রাজধানী ঢাকা মহানগরী বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এমনকি রাজউক নিজেও বৈআইনি ভূমি ব্যবহার-দখলে সম্পৃক্ত বলে জোর অভিযোগ আছে। তাই বলে রাজউক কোন ভাল উদ্যোগ নিতে পারবে না, বা নিলে তা প্রতিহত করতে হবেÑতা নিশ্চয়ই সঠিক হবে না।

যাই হোক, ড্যাপ-এ ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জলাভূমি ও জলাশয় সংরণে বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আঘাতের আবাসন ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণী বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, রাজধানী ঢাকার সর্বাঙ্গেই এখন ব্যথা। ঢাকাকে এবং ঢাকার মানুষকে বাঁচাতে সবাইকে আন্তরিকতার সাথে রাজনৈতিক ও মানসিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। কোনো প্রতিহিংসা চরিতার্থ বা ব্যক্তি স্বার্থ নয়- সব সিদ্ধান্তই আসতে হবে জনগণের স্বার্থে।

বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী রাজধানী ঢাকাকে সবার জন্য বাসযোগ্য একটি আধুনিক, পরিকল্পিত, ঝুঁকিমুক্ত এবং পরিবেশ ভারসাম্য মহানগরীতে গড়ে তোলার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তা দ্রুত বাস্তবায়িত হবে। সেখানে অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও দেশের কোটি সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের জীবন নিরাপত্তা, সামাজিক এবং পরিবেশগত বিষয় অধিক গুরুত্ব পাবে। রাজধানীর প্রায় দেড় কোটি মানুষ মৃত্যুঝুঁকি থেকে মুক্তি পাবে। পবিশেষে বলবো, বিষয়টিকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ, আবেগ বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে না দেখে বৃহত্তর পরিসরে দেখতে হবে। বিশেষ করে বিষয়টি যেহেতু টেকনিক্যাল, সেখানে বিশেষজ্ঞদের মতামতই প্রাধ্যান্য পাওয়া উচিত।

দেশের জনগণের প্রত্যাশা-নিশ্চিন্তে দৈনদিন কাজকর্ম সেরে আতংক নিয়ে নয়, একটু নিরাপদে, চিন্তামুক্ত হয়ে একটু ঘুমুতে পারবে। ড্যাপ যদি বাস্তবায়ন করা না হয় তাহলে রক্তের হোলিখেলা হয়তো দেখবে বিশ্ববাসী। দৈত্যদের থাবায় এ নগরের কোটি মানুষ যেদিন রক্তস্নান করবে হয়তো সেদিনই রক্তের পিপসা মিটবে ভূমিদস্যু এ দৈত্যদের। এ সমাজে দৈত্যদের সংখ্যা অতিনগণ্য। তাদেরকে সবাই চিনেন এবং জানেন।

যদি তারা নিজেরাই এ দৈত্যবৃত্তি ছেড়ে না আসে তাহলে দেশের সর্বস্তরের জনগণ তাদেরকে পরাস্ত করবেই। কেননা পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায়ের জয় অনস্বীকার্য আর দৈত্যরা সর্বদাই পরাজিত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।