গত কয়েকদিন আগে মন্ত্রমুগ্ধের মত একটা বই পড়লাম- শাহাদুজ্জামান-এর লেখা 'ক্রাচের কর্নেল'। কর্নেল তাহেরকে নিয়ে লেখা প্রায় সাড়ে তিনশ পৃষ্ঠার বিশাল বই। ল্যাপটপ বা পিসির যুগে ছাপা অক্ষরে লেখা বই পড়ার অভ্যাস এমনিতে কমে গেছে। এই বইটা পড়লাম কয়েকজনের কাছে খুব সুনাম শুনে। অনেক ভালো লাগলো এই বইটা পড়ে; সাথে সাথে খারাপও লাগলো কর্নেল তাহেরের জন্য; একজন বীরের জন্য।
কয়েকদিনের আগের ট্রাইব্যুনালের রায়ে গোলাম আজমের ফাসি হয় নাই তার বয়সের কথা বিবেচনা করে; কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে বা পা হারানো তাহেরকে এই দেশেই ফাসিকাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে এক প্রহসনের ট্রাইব্যুনালে। সেই বইয়ের কিছু চুম্বক অংশঃ
১। কর্নেল আবু তাহের প্রথম বাঙালি হিসেবে নর্থ ক্যারোলিনার ফোর্ট ব্রেগের স্পেশাল ফোর্সেস অফিসার্স ট্রেনিং ইন্সটিউটে ট্রেনিং-এর জন্য সিলেক্টেড হয়েছিলেন। ট্রেনিং শেষে তাকে যেই সার্টিফিকেট দেয়া হয় তাতে উল্লেখ ছিল- 'Abu Taher is fit to serve with any army under any condition in the world'.
২। তাহেরের পাশের কোয়ার্টারে থাকে ক্যাপ্টেন পারভেজ মোশাররফ।
ফুর্তিবাজ মানুষ, নতুন বিয়ে করেছেন। স্ত্রী ইংরেজী সাহিত্যের তুখোর ছাত্রী। ক্যাপ্টেন পারভেজের স্ত্রী মাঝে মাঝে সঙ্গ দেন লুৎফাকে। এদিক ওদিক বেড়াতে নিয়ে যান; শহরে একসাথে কেনাকাটা করতে যান। তাহের পারভেজের বস কিন্তু তাদের সম্পর্ক বন্ধুর মতোই।
বহু বছর পর রাজনীতিতে অনুৎসাহী; ফুর্তিবাজ এই ক্যাপ্টেন পারভেজ মোশাররফই হয়ে উঠেন পাকিস্তানের প্রধান কুশীলব। তিনি হন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।
৩। ১১ নাম্বার সেক্টরে এক এক করে যোগ দেন আনোয়ার, সাঈদ, বেলাল, বাহার। আরও কিছুদিন পর সৌদি আরব থেকে পালিয়ে বড় ভাই আবু ইউসুফও লন্ডন হয়ে চলে আসেন ভারতে।
যোদ্ধা হিসেবে যোগ দেন ১১ নাম্বার সেক্টরে। একমাত্র বড় ভাই আরিফ ছাড়া সবকটি ভাই তখন যুদ্ধক্ষেত্রে, তাহেরের অধীনস্থ যোদ্ধা। লোকে বলে ব্রাদার্স প্লাটুন। কিছুদিন পর ভাইদের মত তাহেরের কিশোরী বোন ডলিও যোগ দেয় তাহেরের সেক্টরে। কামালপুর অপারেশনে যখন তাহেরের নিকট একটা সেল ড্রপ হয় তখন তার সবচাইতে কাছেই ছিল বেলাল আর বাহার।
স্ট্রেচারে করে যখন তাহেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখনো জ্ঞান হারাননি তাহের, রক্তে মাটি ভিজে যাচ্ছিল। ঐ অবস্থায় মুখটা সামান্য হেসে হারুন হাবীবকে বলেনঃ জার্নালিস্ট আমি বলিনি ওরা কখনো আমার মাথায় আঘাত করতে পারবে না। এই দেখো পায়ে লাগিয়েছে। মাই হেড ইজ স্টিল হাই; গো ফাইট দা এনিমি; ওকুপাই কামালপুর বিওপি।
৪।
প্রহসনের এক বিচারে তাহেরকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। বিষ্ময়ের ষোলকলা পূর্ণ হয় যখন জানা যায় যে অপরাধের জন্য তাহেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে সে অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেবার মতো কোনো আইনই নেই। রায় ঘোষনার ১০ দিন পর আইন মন্ত্রনালয় সামরিক আইনের বিশতম সংশোধনী জারি করেন। এবং তাতে ১ম বারের মত বলা হয়, সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতবাদের প্রচার নিষিদ্ধ ও বেআইনী এবং সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। সত্যি সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ।
৫। ঢাকা জেলের কোন জল্লাদ রাজি হননি তাহেরের ফাসিতে যোগ দিতে। জল্লাদ আনা হয় অন্য জেল থেকে। তাহের যখন ফাসি মঞ্চের দিকে রওয়ানা দিবেন তখন কারা কর্তৃপক্ষের একজন প্রতিনিধি তাহেরের কাছে জানতে চানঃ আপনার শেষ ইচ্ছে কি? তাহের একটু থামেন। মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠে তার।
বলেনঃ ইচ্ছে তো একটাই। আমার মৃত্যুর বিনিময়ে এ দেশের সাধারন মানুষের জীবনে শান্তি আসুক। মঞ্চের কাছে পৌছে তাহের জিজ্ঞেস করেনঃ আর একটু সময় কি আছে?
‘আছে”
‘আমি একটা কবিতা পড়তে চাই’। বলে তাহের পড়েনঃ
‘জন্মেছি সারা দেশটাকে কাপিয়ে তুলতে
কাপিয়েই গেলাম।
জন্মেছি তাদের বুকে পদচিহ্ন আকবো বলে
একেই গেলাম।
জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করবো বলে
করেই গেলাম।
জন্ম আর মৃত্যুর দুইটা বিশাল পাথর
রেখে গেলাম।
সেই পাথরের নিচে শোক আর শাসকের
কবর দিলাম।
পৃথিবী অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম।
এরপর তাহের বলেন, এলরাইট গো এহেড,ডু ইউর ডিউটি, এই এম রেডি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।