মেঘমুক্ত নীলাভ দিঘীর কবোষ্ণতা খুঁজছে মন!
২১ জুলাই,১৯৭৬
ভোরবেলা। দারুন আঁধারে কবোষ্ণ এক সময়। খানিক আগে কার্যকর করা হয়েছে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদন্ডাদেশ। বন্দী ভাইদের শেষবারের মত দেখাবার জন্য তাহেরের মৃতদেহ শুইয়ে রাখা হয়েছে স্ট্রেচারে। জেলের এক মলিন চাদরে ঢাকা।
আনোয়ার, ইউসুফ, বেলাল- ব্রাদার্স প্লাটুনের তিন ভাই বিহ্বল চোখে চেয়ে দেখেন তাদের অপ্রতিরোধ্য বিপ্লবী ভাই কেমন নিশ্চুপ শুয়ে আছেন।
মাত্র ৫ দিন আগের এই মৃত্যুদন্ডাদেশ ঘোষণার সময়টা তাদের স্মৃতিতে তখনও স্পষ্ট। সে স্মৃতি তারা সারা জীবন বয়ে বেড়াবেন সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তিন দশক পরেও সে স্মৃতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়তে হবে তা হয়তো তারা ভাবেননি।
১৭ জুলাই শনিবার রায় ঘোষিত হয়, বিশেষ সামরিক ট্রাইবুনালে সৈনিক সংস্থার বন্দীদের নানা মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়। ঢাকা জেলের ডিআইজির ছোট্ট একটি রুমকে বানানো হয় আদালত, অধ্যাদেশ জারি হয় ট্রাইবুনালে যে রায় দেবে তার বিরুদ্ধে কোন আপিল করা চলবে না, বিচার হবে রুদ্ধদ্বার কক্ষে, আইনজীবীদের শপথ করানো হয় ৭ বছর পর্যন্ত এ বিচারের ব্যাপারে কেউ মুখ খুলবে না আর খুললে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ! শুরু হল আইনের নামে আশ্চর্য হঠকারী এক খেলা!
কর্নেল তাহেরর রায় ঘোষণার পর স্তব্ধ হয়ে যায় সেই আদালত কক্ষ।
সাংবাদিক বি এম মাহমুদ, যার বাসাতে ৭ নভেম্বর বিপ্লবের চূড়ান্ত মিটিংটি করেন তাহের, যিনি রায়ে খালাস পেয়েছেন খানিক আগে, তাহেরে দন্ড শুনে হু হু করে কেঁদে উঠেন। তাহের তার পিঠে হাত রেখে বলেন: কাঁদছেন কেন মাহমুদ ভাই
তিনি বলেন, তিনি কাঁদছেন এজন্য যে কোন বাঙালি তাহেরের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করতে পারলো।
এরা বাঙালি নয়
সত্যি মনে প্রানে কোন বাঙালি হয়তো কোনদিনই সেই কর্নেল তাহেরকে এ দন্ড দিতে পারতো না।
যিনি পাকিস্তান থেকে জীবন বিপন্ন করে পালিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য।
যিনি ময়মনসিংহ, জামালপুর আর নেত্রকোনা নিয়ে গড়ে উঠা গুরুত্বপূর্ণ ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন।
যুদ্ধের পুরোটা সময় যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলগত, সামরিক ও রাজনৈতিক ভিত যাদে সুদৃঢ় হয় তার নিরন্তর চেষ্টা করে যান, অসীম সাহসী রৌমারীর সুবেদার আফতাব, টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী, ভালুকার আফসার, এদের মত স্থানীয় রণকৌশলপটু মানুষদের সাথে তিনিই প্রথম সামরিক লোক যিনি তাদের সাথে যোগাযোগ করে অস্ত্রসহ নানারকম সহযোগীতা দেন।
কামালপুর রণাঙ্গনে শেলের আঘাতে যার বাম পা টি যখন ছিন্নাভিন্ন হয়ে গেছে তখনও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দিয়ে চলেছেন- মাই হেড ইজ স্টিল হাই, গো ফাইট দি এনিমি..আমার কিছু হয়ানি, তোমরা ফ্রন্টে ফিরে যাও।
যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে নির্দেশ দিয়ে যান চিকিৎসাকালীন সময়েও।
যুদ্ধপরবর্তী সেনাঅফিসারদের নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, ক্যান্টনমেন্টের সামনে লুন্ঠিত মাল জড়ো করে পুড়িয়ে দিয়েছেলেন।
নতুন সোনার দেশের স্বপ্নে যিনি বিভোর হয়ে লিখেছিলেন সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে
যিনি দেশের উন্নয়নের জন্য সেনাবাহিনী নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন পিপলস আর্মির, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পুরো বিগ্রেডের দায়িত্ব পেয়ে যিনি তার মডেলও সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরউত্তম খেতাবধারী, আত্মোৎসর্গের চিহ্ন নিজ দেহে বয়ে বেড়ানো অসীম সাহসী, দেশপ্রেমিক এ মানুষটির বিচারের এ রায় কোন বাঙালি দিতে পারে না। যারা এ রায় দিয়েছিল তারা বাঙালি হতে পারে না।
এ কারনে তাহেরকে হত্যার জন্য যে ট্রাইবুনাল গঠিত হয় তার প্রধান নিয়োগে জটিলতা দেখা দেয়। কোন মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসার এ দায়িত্ব নিতে রাজী হন না। তাহলে এ ট্রাইবুনালের দায়িত্ব নেয় কারা? সে প্রসঙ্গে তাহেরের সাথে বন্দী তার ভাই আনোয়ার আদালতে বলেন
আর যে বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইবু্নালটি জিয়াউর রহমান গঠন করেছিলেন, তার চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছিলেন কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে, যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকায় অবস্থান করেও মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পরিবর্তে পাকিস্তানীদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন।
ট্রাইবু্নালের বাকি ৪ জন সদস্য কেউই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেননি। .....তৎকালীন ডিএফআই প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আমিনুল ইসলাম, ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টিলিজেন্স (এনএসআই)-এর প্রধান এবিএস সফদার, স্বরাষ্ট্র সচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং সংস্থাপন সচিব আব্দুর রহিম ছিলেন তাহের হত্যাচক্রান্তের জিয়াউর রহমানের প্রধান সহচর। উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা তো ছিলেনই।
সফদার, সালাউদিন এবং রহিম ছিলেন আয়ুব সরকারের জ্যেষ্ঠতম বাঙালী গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা। আগরতলা মামলায় সরকারপক্ষকে সকল কাগজপত্র সরবরাহ করেছিলেন এবিএস সফদার।
বস্তুত সামরিক প্রসিকিউটরের ব্রিফকেস বহনকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবিএস সফদার এবং আব্দুর রহিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। বিদেশে অবস্থানরত বহু বাঙালী কর্মকর্তারা যেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, সেখানে এ দুই কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ শেষ করে ১৯৭১-এর জুন মাসে অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে এসে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করেন। এ সময় রাজাকার বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন আব্দুর রহিম। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরপরই এবিএস সফদারকে এনএসআইর প্রধান করা হয়।
আব্দুর রহিম হন খুনী মুশতাকের অন্যতম পরামর্শদাতা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘ সময় দায়িত্বপালনকারী জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এসব দালালদের যোগসাজশে দেশের প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধাদের সমূলে বিনাশ করার চক্রান্তের ফসল হচ্ছে কর্নেল তাহের ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে গোপন সামরিক আইন ট্রাইবু্নাল।
লরেন্স লিফশুলৎস
তাহের যখন সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন তার কিছুদিন পর জেনারেল ওসমানীর প্রস্তাবে তিনি নারায়ণগঞ্জ ড্রেজিং সংস্থার ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব নেন। কিছুদিনের মধ্যেই ড্রেজিং সংস্থাকে একটি লাভজনক সংস্থায় পরিণত করেন তাহের। সেসময় ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ের মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎস এদেশের বন্যার উপর ফিচার লিখতে আসেন।
আলাপ হয় তার তাহেরের সাথে। উদ্যমী এ প্রাক্তন সেনাকমকর্তার চিন্তা-ভাবনা মুগ্ধ করে লরেন্সকে।
তারা তখনও জানেন না, তাদের এ পরিচয় একদিন একটি ঐতিহাসিক এক সত্যকে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে পরিণত হবে। বাংলাদেশের হাইকোর্ট যখন তাকে অনুরোধ করবে কর্নেল তাহেরের গোপন বিচার নিয়ে বক্তব্য প্রদান করতে তখন তিনি বলবেন
'৩০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি এই অনুরোধটি পাওয়ার প্রত্যাশা করেছি। '
হলফনামা
কর্নেল তাহেরের গোপন বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তার ভাই আনোয়ার হোসেন, তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের এবং সামরিক আদালতের বিচারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ গত ২৩ আগস্ট হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে তাহেরের বিচারের জন্য সামরিক আইনের মাধ্যমে জারি করা আদেশ এবং এর আওতায় গোপন বিচার ও ফাঁসি কার্যকর করাকে কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানাতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। তারই প্রেক্ষিতে গত ২০ জানুয়ারি হাইকোর্ট তাহেরের গোপন বিচার সম্পর্কে বক্তব্য দিতে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎসকে অনুরোধ জানান। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও পররাষ্ট্রসচিবকে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় লরেন্স লিফশুলৎস ই-মেইলে রাষ্ট্রপক্ষের বরাবরে তাঁর বক্তব্য পাঠান।
১৯৭৬ সালে তাহেরসহ অন্যদের যখন গোপন বিচার চলছিল তখন তিনি ঢাকায় ছিলেন, ট্রাইবুনালের সদস্যদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন, ছবি তুলেন গেটের বাইরে থেকে। পরে এক আর্মি অফিসার তার ক্যামেরাটি কেড়ে নেয়, ফিল্ম খুলে নেয়। তারপর তাকে কিছুদিন নজরবন্দী করে রাখা হয় এবং শীঘ্রই দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
লিফশুলৎস তার হলফনামায় বলেছেন, ‘নির্মোহভাবে আমি বিশ্বাস করি, বিচার শুরুর আগেই এ রায় নির্ধারিত হয়েছিল। যে তথাকথিত রায়ে তাহেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, সে রায়কে বাতিল করার এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত তখনই ছিল।
তাহেরের ফাঁসিকে শুধু “বিচার বিভ্রাট” বললেই যথেষ্ট হয় না, এটিকে “রাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত অপরাধ” হিসেবেও আখ্যায়িত করা উচিত। ’
লরেন্স লিফশুলৎস-এর হলফনামা | বাংলায় | ইংরেজীতে
তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ
কী ছিল তাহের আর তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ?
খুবই আশ্চর্য আর বিদ্রুপাত্মক সে অভিযোগ। তখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিল সেটা মূলত ৭ নভেম্বরের বিপ্লবজাত সরকার। ৭ নভেম্বরকে পরবর্তীতে বিপ্লব দিবস হিসেবেই পালন করবে এ সরকার। অথচ তাহেরের বিরুদ্ধে প্রথম এ অভিযোগই তারা তুলে ধরে - কেন তিনি সেদিন বৈধ সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করেন!!
যদিও ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত কোন বৈধ সরকারই ছিল না।
খালেদ মোশারফ যে বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়েছিলেন, ৭ নভেম্বরের পরও সায়েমই প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকেন। তারমানে সরকার উৎখাতের পুরো বিষয়টা এক রসাত্মক দাবি।
দ্বিতীয় অভিযোগটা আরও গোলমেলে। অভিযোগ করা হয় সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির। অভিযুক্তদের আইনজীবী আদালতকে স্মরণ করিয়ে দেন 'ভুলে যাবেন না তাহেরের নেতৃত্বেই ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন জিয়া এবং জিয়াই তাহেরকে এরকম একটি উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেছিল ( জিয়া তাহেরকে ফোনে অনুরোধ করে তাকে বাঁচাতে)..জেনারেল জিয়াই এই দিনটিকে ঘোষণা করেন সংহতি দিবস হিসেবে।
বলেছেন এই দিনে জনগণ দেশের সার্বভৌমত্ব সংহত করেছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে একই দিনে বিশৃঙ্খলা আর সংহতি হয় কি করে? এ বড় অদ্ভূত, অসাড় অভিযোগ। '
...আদালতে দাড়িয়ে রাজসাক্ষীরাও নানা গোঁজামিল বক্তব্য দিতে থাকে। একজন বলেন তিনি কর্নেল তাহেরকে দেখেছেন ড. আখলাকের বাড়ি থেকে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা ভোরার সাথে কথা বলছেন। অথচ জানা যায় যে ড. আখলাকের বাড়িতে কোন কালে কোন ফোনই ছিল না।
এটি যে নেহাত এক প্রহসনের বিচার তা আর আসামীদের কারো বুঝতে বাকী থাকে না। ( ক্রাচের কর্নেল, লেখক-শাহাদুজ্জামান,পৃষ্ঠা ৩১৯-৩২০)
১৭জুলাই,১৯৭৬
আবার আমরা ফিরে যাই রায় ঘোষনার সেই দিনে। ট্রাইবুনাল চেয়ারম্যান ইউসুফ হায়দার রায় দিলো।
ড. আখলাক, বি এম মাহমুদ সহ ১৫ জন বেকসুর খালাস। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কয়েকজনকে এক থেকে সাত বছর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড।
আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেনকে দশ বছর, মেজর জীয়াউদ্দীনকে বারো বছর সশ্রম কারাদন্ড। অব. মেজর এম এ জলিল এবং আবু ইউসুফকে বলা হয় তাদের জন্য নির্ধারিত শাস্তি মৃত্যুদন্ড, তবে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড।
তখন শুধু একজনের রায় ঘোষণা বাকি। যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বোচ্চ বীরউত্তম খেতাবধারী, নিজ দেহে যুদ্ধের ক্ষতি বহনকারী। তার রায় হল মৃত্যুদন্ড, ফাঁসিতে খুলিয়ে তা কার্যকর করা হবে।
একজন বীরউত্তমকে রায় দিলো মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পক্ষাবলম্বনকারী একলোক।
বিস্ময়ের আরও এক পর্ব বাকি ছিল। যে অপরাধে তাহেরকে অভিযুক্ত করা হয় সে অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেবার মত কোন আইন তখনও নেই। রায় ঘোষণার দশদিন পর ৩১ জুলাই ১৯৭৬ আইন মন্ত্রনালয় সামরিক আইনের বিশতম সংশোধনী জারি করে। তাতে প্রথমবারের মত বলা হয় সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতবাদ প্রচার নিষিদ্ধ ও বেআইনী এবং সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
একটি ভাল চাদর
লেখাটা শুরু করেছিলাম সেই সময়ে যখন তাহের শুয়ে আছে জেলের স্ট্রেচারে। তার তিনভাই বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার নিষ্প্রাণ বিপ্লবী ভাইয়ের দিকে। ইউসুফ হঠাৎ লক্ষ্য করেন তার ভাইয়ের পায়ের কাছে কয়েক ফোঁটা রক্ত লেগে আছে। ইউসুফ তার পাঞ্জাবি দিয়ে রক্তটুকু মুছে দেন। পরে সেলে ফিরে গেলে সে রক্ত ছুঁয়ে দেখেন বন্দী সহযোদ্ধারা।
দুপুরের দিকে তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের ও তাহেরর মা আশরাফুন্নেসা লাশ দেখতে পান। লুৎফা দেখেন প্রাণবন্ত এক মানুষ শুয়ে আছেন স্টেচারে। জেলের সেই মলিন চাদরটা তখনও তাহেরর গায়ে।
হঠাৎ আশরাফুন্নেসা হৈ চৈ করে উঠেন ' এটা কেমন চাদর দিয়েছেন আপনারা ছেলেটার গায়ে, আমার ছেলে কি একটা ভাল চাদরও পেতে পারে না?'
আজ অনেক বছর কেটে গেছে- তাহের, বীরউত্তম কর্নেল তাহের মৃত্যুবরণ করেছেন,অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছে যাকে। দেশের সামাজিক রাজনৈতিক অনেক পরিবর্তন হয়েছে, আমরা আমাদের দেশপ্রেমিকদের অনেককে আজও মূল্যায়ন করতে পারি নি তবু।
আমার এ পোষ্টে অনেকে রাজনৈতিক নানা উদ্দেশ্য খুঁজে বের করবে কিনা আমার জানা নেই। গত শুক্রবার পত্রিকায় যখন আবারও তাহেরের প্রসংঙ্গ দেখি তখনই এ পোষ্ট লেখার সিদ্ধান্ত নেই। এত বছর পেরোবার পরও কেন একটি পরিবারকে আবার আদালতের সরনাপন্ন হতে হয়-তাদের পরিবারের একজন বিপ্লবী মানুষের সম্মান ফিরে পাবার জন্যে। ভেবে পাই না।
শুধু কর্নেল তাহেরের পরিবার, বন্ধুবান্ধবই নয়, তার সম্মান প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
আমাদেরই ব্যবস্থা করতে হবে একটা ভাল চাদরের, জাতির সে লজ্জা-অধ্যায় ঢাকবার জন্য বড় প্রয়োজন সে চাদরের।
তথ্যসূত্র:
১. কর্নেল তাহেরকে নিয়ে ওয়েবসাইট
২.কর্নেল তাহেরের দীর্ঘ ছয় ঘন্টার জবানবন্দি
৩. সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎস-এর হলফনামা | বাংলায় | ইংরেজীতে
৪. উইকিপিডিয়ার ফিচার
৫. নিউজ Taher's fate fixed before trial
৬. সত্য উদ্ঘাটিত হবে: ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন
৭. নিউজ: তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জিয়া
৮. ক্রাচের কর্নেল- শাহাদুজ্জামান, মাওলা ব্রাদার্স
৯. অসংখ্য নিউজ, ৭ নভেম্বর নিয়ে লেখা কিছু আর্টিকেল
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।