অস্থির
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট চালু হলে সরকার বছরে অন্তত এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার রাজস্ব পাবে।
ভারত, নেপাল ও ভুটানের পণ্যবাহী কনটেইনার বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পরিবহনের কারণে শুল্ক হিসেবে এ রাজস্ব পাবে সরকার। তবে তার জন্য প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। ট্রানজিট কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চললে ১৫ বছর পর এই রাজস্ব দাঁড়াবে অন্তত সাত হাজার কোটি টাকা। 'সাবরিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি' নামে বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া একটি ঋণ প্রকল্প প্রতিবেদনে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এ হিসাব তুলে ধরেছে।
ট্রানজিটে বাংলাদেশের লাভ বিষয়ে এডিবি সম্প্রতি একটি গবেষণা পরিচালনা করে। ওই গবেষণায় এ ধরনের ফলাফল পাওয়া গেলেও এডিবি এখনো তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। তবে এডিবির তথ্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশের গবেষকরা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক হিসাবে বলা হয়েছে, ট্রানজিট থেকে রাজস্ব আয় বছরে ৪০০ কোটি টাকা হতে পারে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কোনো গবেষণা বা স্টাডি ছাড়াই চলতি অর্থবছরের বাজেটে ট্রানজিট ফি ঘোষণা করা এবং ট্রানজিট থেকে লাভের হিসাব না করা প্রসঙ্গে গতকাল এনবিআর চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদের কাছে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে এ বিষয়ে তিনি সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে বলেন, ট্রানজিট থেকে লাভের বিষয়টি শুধু শুল্ক বিভাগ নয়, অন্যান্য সরকারি সংস্থাও পাবে। শুল্ককর একটি মাত্র খাত। তবে আগামী ১০ নভেম্বর একটি সেমিনারে এ সংস্ক্রান্ত একটি স্টাডির ফলাফল তুলে ধরা হবে জানিয়ে তিনি বলেন,
লাভ তো অবশ্যই হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১৪টি করিডোর রয়েছে, যেসব স্থান দিয়ে ট্রানজিট হতে পারে। এসব বিষয়সহ বাংলাদেশের লাভ-লোকসানের বিষয়টি ওই দিনের ওই স্টাডিতে তুলে ধরা হবে।
ওই সেমিনারে আন্তর্জাতিক ট্রান্সপোর্ট বিশেষজ্ঞ ড. এম রহমতুল্লাহ ট্রানজিটের লাভ-লোকসান নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন। গতকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তা স্বীকার করেন। তবে সেমিনারের আগে বিস্তারিত কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এর আগে তিনি গত ১৭ অক্টোবর কালের কণ্ঠের সঙ্গে ট্রানজিটের লাভ-লোকসান নিয়ে কথা বলেন। তখন তিনি কোনো রকম স্টাডি ছাড়া এনবিআর কর্তৃক ঘোষিত ট্রানজিট ফি নির্ধারণের সমালোচনা করে বলেন, কোন রুটে কত ফি হবে তার কোনো পর্যালোচনা করেনি এনবিআর।
সব রুট তো এক রকম নয়। একেক রুটে একেক রকম দূরত্ব । তাই ফিও হবে ভিন্ন ভিন্ন। এসবের আলোকেই ফি নির্ধারিত হবে। এ সময় তিনি এডিবির স্টাডির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এডিবি রুট অনুযায়ী হিসাব করেছে।
সেই হিসাবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট হলে ভারতের অন্তত ৭০ শতাংশ ব্যয় সাশ্রয় হবে। আর এ সাশ্রয়ের ভাগ পাবে বাংলাদেশ। তাই ফি নির্ধারণ হবে উভয় দেশের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষ। এডিবির স্টাডি অনুযায়ী তিনি মনে করেন, ট্রানজিট কার্যক্রম ভালোভাবে চললে ১৫ বছর পর এ থেকে বাংলাদেশের বাৎসরিক আয় প্রায় সাত হাজার কোটি টাকায় পেঁৗছতে পারে।
এডিবি ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে 'সাবরিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি' নামে একটি ঋণ প্রকল্প প্রস্তাব করেছে।
এ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এডিবির প্রেসিডেন্ট হারুহিকু কুরুদার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। এতে ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের লাভের হিসাবসংক্রান্ত এডিবির অপ্রকাশিত একটি স্টাডি ফলাফল উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ট্রানজিট চালু হলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারত, নেপাল ও ভুটানে বছরে প্রায় ১৮ মিলিয়ন টন বা এক কোটি ৮০ লাখ টন পণ্য পরিবহন হবে। এডিবির ওই প্রতিবেদনে টাকার অঙ্ক প্রকাশ না করলেও চলতি বাজেটে এনবিআরের পক্ষ থেকে যে ট্রানজিট ফি ঘোষণা করা হয়েছে, তার সঙ্গে সম্ভাব্য পণ্যের হিসাব করে দেখা গেছে বাংলাদেশ শুধু ট্রানজিট ফি বাবদ রাজস্ব পাবে বছরে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। প্রতি টন পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট ফি হিসেবে এক হাজার টাকা আদায়ের নির্দেশনা রয়েছে এনবিআরের। এডিবির গবেষণায় ট্রানজিট শুরুর বছরে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের কথা বলা হলেও ১৫ বছর পর এ খাত থেকে সরকার বছরে অন্তত সাত হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারবে বলে জানিয়েছেন এডিবির স্টাডির সঙ্গে জড়িতরা।
এডিবির এ প্রতিবেদনে ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের লাভের সম্ভাব্যতা তুলে ধরে আরো বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের অন্যতম উদীয়মান অর্থনৈতিক অঞ্চল হলেও এখানে বিশ্ববাণিজ্যের অংশীদারি রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। বাণিজ্যিক গুরুত্ব বিবেচনায় এ অঞ্চলের ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্টের কেন্দ্র হতে পারে বাংলাদেশ। একদিকে বঙ্গবন্ধু সেতু অন্যদিকে প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে সড়কপথে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল, ভুটান, নেপালে পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি দেশগুলোতে নিজস্ব ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়বে। এতে আরো বলা হয়, ভৌগোলিক কারণে সাবরিজিওনাল ট্রানজিটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বাংলাদেশ। এ অঞ্চলের ১০টি সড়কপথ করিডোরের মধ্যে ছয়টিই বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে গেছে।
পাঁচটি রেলপথ করিডোরের মধ্যে দুটিই বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। আর জলপথে বাংলাদেশের রয়েছে চট্টগ্রাম ও মংলার মতো দুটি আন্তর্জাতিক বন্দর। বাংলাদেশের এখন প্রয়োজন এসব অগ্রাধিকার করিডোরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এ খাতে বিনিয়োগ শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে না, এর ফলে সমগ্র সাবরিজিওনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যের উন্নতি হবে। এসব বিবেচনায় এডিবি বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার করিডোরের অবকাঠামো নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইবিষয়ক এক প্রকল্পে প্রায় ২৮ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে।
এ প্রকল্পের আওতায় সাবরিজিওনাল ট্রান্সপোর্টের সম্ভাব্যতা ও নকশার কাজ করা হবে। এর অংশ হিসেবে ২০১২ সালের মধ্যে ৩০০ কিলোমিটার এবং ২০১৩ সালের মধ্যে এক হাজার ৭০০ কিলোমিটার সড়কের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা হবে। এর পাশিপাশি ২০১২ সালের মধ্যে ৩৪০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের টেন্ডার আহ্বানের সম্ভাব্যতাও যাচাই করা হবে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ট্রানজিট থেকে লাভ-লোকসানের কোনো স্টাডি পরিচালিত হওয়া বা এর ফলাফল সম্পর্কে কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) পলিসি রিসোর্স প্রোগ্রাম থেকে সম্প্রতি একটি স্টাডি করা হয়েছে যা প্রকাশিতও হয়েছে। তবে ওই স্টাডিতে যে লাভের হিসাব দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে এডিবির হিসাবে ব্যাপক ফারাক রয়েছে।
এডিবি ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা লাভের কথা বললেও বিআইডিএসের স্টাডিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ হয়ে বছরে সর্বোচ্চ ৪ মিলিয়ন টন পণ্য ভারতে যাবে। এর মধ্যে আগরতলায় ৩ মিলিয়ন টন আর শিলচরে ১ মিলিয়ন টন। এতে সরকার ঘোষিত ফি অনুযায়ী রাজস্ব দাঁড়ায় বছরে ৪০০ কোটি টাকা।
এডিবির স্টাডি প্রতিবেদনের ফলাফলের ব্যাপারে একবারেই ভিন্নমত পোষণ করেছেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. কে এ এস মুরশিদ। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা জানি না কিসের ভিত্তিতে এডিবি বিশাল পরিমাণের পণ্য ট্রানজিটের হিসাব করেছে।
আমি ওই হিসাবের সঙ্গে মোটেও একমত নই। এ বিষয়ে আরো দায়িত্ব নিয়ে গবেষণা করা উচিত হবে। ' তিনি বিআইডিএসের পরিচালিত গবেষণার হিসাবটিকে অনেকটা যৌক্তিক দাবি করে বলেন, 'ভারতের বর্তমানে পণ্য পরিবহনে যে খরচ হয়, আর ট্রানজিট হলে তাদের যে সময় ও ব্যয় কম হবে তার ভিত্তিতে হিসাবগুলো করতে হবে। '
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।