বলার নেই কিছু।
চোখের কোণ থেকে অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি! তীব্র বেদনায় এস্পারওস্পোর কিশোরীর শীর্ণকায় দেহ। শুষ্ক ঠোট জুড়ে কাঠ ফাটা রোদের তৃষ্ণা আর বুক চিরে হাহাকার! কেন এমন হল? বধু বেশে মেহেদী রাঙা হাতে ভালোবাসার স্পর্শে স্বপ্নের দুনিয়া সাজাবার আগেই তার পরনে বিধবার সাঁজ!
হাতের মেহেদী তখনো মোছেনি। রক্তাক্ত দেহে পড়েছিল অরুণ। কিশোরীর চোখের সামনে ভেসে উঠে স্বামীর লাশ।
সে আর্তনাদে চিৎকার করে উঠে। সেই আর্তনাদ স্বামী হারাবার নাকি প্রসববেদনার ঠিক ঠাওর করা যায় না। সব কষ্ট মিলেমিশে একাকার!
পড়ন্ত বিকেলে সূর্য তলিয়ে যাবার আগে একবার ছুয়ে যায় কিশোরীর মুখ। কষ্টে লাল টকটকে মুখে স্তমিত সন্ধ্যা প্রদীপের ছায়া। তাতে ভেসে আছে প্রতীক্ষা!
যেন এক্ষুনি স্বামী এসে বলবে,
''ঢের হয়েছে প্রিয়তমা, এবার ওঠো।
দেখো আমাদের ভালোবাসার ঘরে আজ ফুটেছে নতুন ফুল।
আজ আমাদের ভালোবাসা পূর্ণ,তোমার মাতৃত্ব পূর্ণ।
হাত দুটো ধরো প্রিয়তমা,
চলো পৃথিবীর এই শ্বাপদ ভরা জংগল ছেড়ে বহু দূরে
অনেক দূরে,
অন্য কোথাও গড়ি আমাদের সুখের নীড়। ''
কিশোরী হাত দুটো ছুঁয়ে দিতে চায়!
মুহূর্তেই ভ্রমো ভাঙে জরায়ুর তীব্র দ্রোহে। শিনশিন ব্যাথা ছিন্নভিন্ন করে দিতে চায় শরীরের প্রতিটি কোষ প্রতিটি টিস্যুগুচ্ছ।
হঠাৎ ভুবন কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে নবজাতকের কণ্ঠস্বর! সদ্য জন্ম নেয়া নতুন মা উথলে উঠে ভালোবাসার প্লাবনে। ''এ আমার নাড়ি ছেঁড়া ধন! আমার জঠোরে দশমাস দশ দিনে বেড়ে উঠা কোমল শিশু। ''
কিশোরী অপলক চোখে চেয়ে থাকে শিশুর দিকে। নরম দেহ, কুঞ্চিত হাত পায়ে গুটিশুটি দেয়া ছোট অবয়ব। কুতকুতে দুটি চোখ, টমেটোর মত লাল গাল! ওমা মাথায় কিছু চিকন নরম ঘাসের মত চুলও আছে।
কিশোরী অবাক হয়ে ভাবে! ঘুমিয়ে গেলে ঠোট দুটো আপনাআপনিই নাড়তে থাকে। যেন ঘুমের ঘোরেও সে মায়ের বুকে দুগ্ধপানে ব্যস্ত। কিশোরী অসংখ্য চুম্বনে ভরিয়ে দেয় শিশুর মুখ। এক চিলতে নরম হাসি ভোরের কুসুম রোদের মত ছুয়ে যায় নবজাতকের ঠোট। কিশোরী উদ্বেলিত হয় মমতার প্লাবনে।
কিন্তু জগতের চোখ রাঙানি? সে কি বুঝবে এই মায়ের মমতা! কিশোরীর মা এসে জানিয়ে যায় শহরের এক উকিলের সাথে সে আবার মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছে। এর আগের বিয়েতে পরিবারের মত ছিল না। শুধু মেয়ের জেদের কারণে বিয়ে। বেশ সুখেরই ছিল সংসার। কিন্তু বড় অকালেই রোড এক্সিডেন্টে মেয়ের স্বামীর মৃত্যু।
''ছেলেটা মরে গিয়েও তার মেয়ের পিছু ছাড়েনি। দিয়ে গিয়েছে আপদ-শিশু সন্তান!'' আক্ষেপে ভাবে কিশোরীর মা। মেয়েকে স্বামীসহ সুখী দেখার তার বড় ইচ্ছা!
কিশোরী চিৎকার করে বলে ,''মা গো আমার দুধের শিশু! কি করে বাঁচবে সে মাকে ছাড়া? আমিও হৃদয় অর্ঘ্য থেকে কি করে মুছে দিব এই নিষ্পাপ মুখ? কেমন করে আবার নতুন সংসারের জল মুখে দেব এই নিষ্পাপকে তৃষ্ণার্ত রেখে? তুমিও তো মা। বোঝ একটি বার!''
কিন্তু মা থাকেন অনড়। এত ভালো প্রস্তাব কিছুতেই ফিরিয়ে দেয়া যায় না।
আর আবেগ দিয়ে কি পৃথিবী চলে? যখন তিনি থাকবেন না, কিশোরীর বাবা থাকবেন না এই একলা পৃথিবীতে কে দেখবে কিশোরীকে? বুড়ো বয়সে কে হবে হাতের সম্বল? আর তাছাড়া এই জগত সংসার বড় নিষ্ঠুর! এরা মেয়েদের একাকী বেচে থাকতে দেয় না।
মাসখানেক পরে বিয়ে হয়ে যায় কিশোরীর। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে শিশুর মুখে তাকিয়ে বলে ,''সোনামনি আমাকে ভুল বুঝিস না। তোর মাকে ভুল বুঝিস না। আমি আমার মায়ের জন্য তোকে ছেড়ে যাচ্ছি।
''
কিছুদিন পর নিউমোনিয়ায় মারা যায় কিশোরীর শিশু।
মেয়ের নতুন সংসারে প্রভাব ফেলবে ভেবে কিশোরীর মা শিশুর মৃত্যু সংবাদ গোপন করে রাখেন।
এদিকে কিশোরীর মাতৃত্ব মন সদা অস্থির! কেমন আছে শিশুটি। তার ফুলের মত শিশু। রান্না ঘরে বসে রান্নার সময় হঠাৎ মনে হয় বিছানায় শুয়ে কেঁদে উঠেছে তার নাড়ি ছেড়াধন।
কিশোরী দৌড়ে যায়। পরক্ষনে মনে পড়ে সে তো এখন অন্যের ঘরে। এখানে তার শিশু আসবে কোথা থেকে! আবার বাহির থেকে ভেসে আসে কিসের যেন শব্দ। ছলাৎ করে উঠে মায়ের মন! হামাগুড়ি দিতে দিয়ে বিছানা থেকে পরে গেল না তো তার ছোট্ট সোনাটি!
ঘুমের ঘোরে কিশোরীর স্বপ্নেও কেঁদে উঠে শিশু ,''মা গো আমায় কেন ছেড়ে গেলে! তিড়িংবিড়িং করে কাঠবিড়ালির মত তোমার কোলে নেচে উঠার আগেই আমাকে পর করে দিলে!''
সফেদ কাফনে মোড়ানো শিশুটি আস্তে আস্তে কিশোরীর থেকে দূরে চলে যায়। কিশোরী ঘুমের ঘোরে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে।
পাশে শুয়ে থাকা স্বামী ঘুম থেকে উঠে সান্ত্বনার হাত রাখেন স্ত্রীর কাঁধে।
আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেতে থাকে কিশোরী। মায়ের বাড়িতে খোঁজ পাঠিয়েও জানতে পারে না তার শিশুটির খোঁজ। অজানা শংকায় মন কেঁপে উঠে বারে বারে। এভাবেই পার হয় দিন।
চোখের নিচে জমা হয় মোটা কালি। বুকের খাঁজের পাঁজরগুলো দিন দিন হয় স্পষ্ট। কি যেন বেমো হয়েছে কিশোরীর। ডাক্তার রোগ ধরতে পারে না।
কিশোরীর স্বামী গ্রাম থেকে খবর দিয়ে ডেকে আনে তার মাকে।
তার মা কিশোরীকে জানায় তার শিশুটি আর নেই!
কিন্তু কিশোরী নিঃস্পৃহ। তার চোখে খেলা করে তার শিশুর ছলাৎছল হাসি, নিটোল লাল টোল পড়া গাল, স্বচ্ছ জলের মত টলটলে চোখ। এক সময় সে চোখ ঘুমিয়ে পড়ে কিশোরীর বুকে। কিশোরীও ঘুমিয়ে পড়ে ঐ নিষ্পাপ চোখের সীমানায়। ঘুম পাড়ানী গান গেয়ে উঠে মৃত্যু! তাদের ঘুম আর কেউ কোন দিন ভাঙাবে না।
কেউ বলবে না দুনিয়া বড় নিষ্ঠুর! তারা এখন নিজেদের দুনিয়ায়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।