আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাথা খারাপ মায়ের গল্প

“মানুষ প্রায়ই সুশীলতার ভান করে। একজন লম্পট তার বক্তৃতায় নারীর নিরাপত্তা আর স্বাধীনতার কথা বলে। নারীর নিরাপত্তা বিধানে সমাজ, প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে। কামনা করে প্রতিটি নাগরিক যেন সচেতন হয়ে ওঠেন। আদতে যার বিপরীত ভাবনাটিই সে লালন করে মনে মনে।

যেমন একজন ধর্মের লেবাস-ধারী পুরোহিত যখন নারীর পর্দার কথা বলে, আসলে যা সে মনে মনে কামনা করে না। যার ভাবনার নিভৃতে ঘাপটি মেরে বসে থাকে চলমান নগ্ন নারী দেখবার প্রত্যাশাটিই। কিন্তু সে বাইরে সুশীল ভাব ধারণ করে আছে বলেই কথাটি প্রকাশ্যে বলার সাহস রাখে না। যে কারণে বাধ্য হয়েই বিপরীত ভাবনাটির প্রকাশ ঘটায়। আর তাই আমরা নানা গল্পে ধর্মের পাণ্ডাদের একাধিক স্ত্রী আর সেবাদাসী থাকার ঘটনা দেখি।

অন্যদিকে যারা নানা সেমিনার সিম্পোজিয়ামে নারীদের নানা উন্নতি, নিরাপত্তা আর উতিকল্পে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের কথা জোরেশোরে প্রচার করেন। একদিন হুট করেই কোনো নারী কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে যায় তার নাম। ফাটা বেলুনের মতই চুপসে যায় তার মান-মর্যাদা। আমেরিকার সরকার ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না বলেই হয়তো ডলারের গায়ে ছাপার অক্ষরে লিখে জানায়, তারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। সেই সঙ্গে অমানবিকতা আর শিশু হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার বলেই, বছরের পর বছর নানা দেশে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে গায়ের জোরে।

আজকের যেই নারীটি তার কন্যার প্রেমের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ান এ কারণেই যে, যৌবনের ভুল দিনগুলোতে তিনি যেমন ভাবে ভণ্ড প্রেমিকের কাছে প্রতারিত হয়েছিলেন, তেমন করে যেন কন্যাটিও প্রতারণার ফাঁদে না পড়ে। আসলে মনে মনে তিনিও চান যে, একই অভিজ্ঞতা মেয়েটির ও হোক। বিপরীত ভাবনায় পরিচালিত হয়েই হয়তো তিনি কন্যার আগ্রহ নষ্টে তৎপর হয়ে ওঠেন। শোনা কথা যে, যৌন জীবনে অসুখী নারীরাই পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। যে কারণে পুরুষদের কোনোভাবে হেনস্থা করতে পারলে বা তাদের প্রতি কোনো অপ্রীতিকর শব্দের প্রয়োগ ঘটাতে পারলে ভেতরে ভেতরে পুলক বোধ করেন।

অবাধ যৌনতার দিকে ঝুঁকে পরেন বলেই কি নারীটি প্রগতিশীল চেহারার আড়ালে আত্মগোপন করতে ব্যকুল থাকেন সব সময়? যদি বিপরীত ভাবনার প্রকাশ হয়েই থাকে বা এটিই মানুষের প্রকৃত স্বভাব হয়ে থাকে তাহলে ধর্ষক, লম্পট, চোর-চোট্টা-বদমাশ সবাই ভেতরে ভেতরে একজন শুদ্ধ মানুষ। আর প্রতিটি সুশীল মানুষই তাহলে ভণ্ড। সে অর্থে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাই দেশদ্রোহী আর রাজাকারগুলো সব মহা দেশপ্রেমিক। ” ‘বালছাল ভাবনা। আসলে কিছুই হয় নাই।

তর মতন আবালেরা লেখালেখি বাদ দিয়া ঝালমুড়ি বিক্রি করা উচিত!’ বলেই কাগজটা দু হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেললেন তিনি। তাকে আরো একটু রাগিয়ে দিতেই আমি বলি, ‘মা, তুমি না কলেজে মাস্টারি করতা, এইসব নোংরা কথা কি তোমার মুখে মানায়? ক্লাসে ও কি ছাত্রগো লগে এমনে কইতা?’ মায়ের কথা শুনে আমার ভাবতে ইচ্ছে হয় যে, তিনি খুব ভেবেচিন্তেই আমার লেখাটিকে বাতিল করে দিলেন। আসলে এটি একটি উদ্দেশ্যপূর্ণ লেখা। মা-কে কোনোভাবে রাগিয়ে দিতে পারলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া সহজ হয়। কিন্তু যতটা রাগবেন বলে ভেবেছিলাম, ততটা রাগাতে পারলাম না বলে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের হতাশা আমাকে চেপে ধরে যেন।

এক সময় তিনি লেখালেখির পেছনে অনেক সময় ব্যয় করেছেন। এমন কি লেখালেখির জন্য বড় বাধা মনে করে শিক্ষকতার চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছেন। বাবা এসব বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না বলে, বাবার সঙ্গ ত্যাগ করেছেন অনেক বছর হয়ে গেল। আগে কিন্তু তিনি এমনটা ছিলেন না। টানা দু বছর লাগিয়ে তিনি একটি বই লিখেছিলেন।

আশা করেছিলেন বেশ কাটতি হবে বইটির। কিন্তু কোনো প্রকাশক ছাপাতে রাজি হন নি মায়ের সেই বই। শেষে তিনি নিজেই প্রেসে ছুটোছুটি করে বইটি ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু বইটি বিক্রি তো দূরের কথা, বিনে পয়সাতেও কাউকে গছাতে পারেন নি। সেই থেকে ধীরে ধীরে তিনি কেমন যেন হয়ে গেলেন।

অবশ্য তিনি আমাকে বেশ উৎসাহ যোগাতেন যাতে লেখালেখি করি। কিন্তু এ কর্মটি আমার কোনো কালেই ভাল লাগে নি। এ কাজটি অলস আর বেকার বন্ধুগুলোকে করতে দেখেছি সব সময়। যে বন্ধুগুলো দু হাতে টাকা কামাচ্ছে, তারা এসবের ধারেকাছেও আসে না। আমার দুর্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছিল।

যে করে হোক আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে মা-কে। নয়তো সপ্তাহ পার হওয়ার আগেই হয়তো তাকে বেঁধে রাখতে হবে শিকলে। খানিকটা অস্থিরতা নিয়েই বললাম, ‘মা, তুমি তো ভাল মতোই জানো যে, এইসব লেখালেখি আমার ভাল লাগে না। এ অকাজের চাইতে ঝালমুড়ি বিক্রি করে বাঁচাটা অনেক আনন্দের। কিন্তু তোমার সমাজ তো সমর্থন করবে না।

’ ‘দেখরে ফাজিল, আমাকে চেতানোর কোনো দরকার নাই। আমি ভাল আছি। ডাক্তারের কাছে সময় মতোই যাব। তার আগে তোর বাবাকে রিং দে!’ আমি অবাক আর খুশি হলেও তা প্রকাশ করি না। যেহেতু কম-বেশি বিদ্যা আমার পেটেও আছে, সে কারণে ভান ব্যাপারটিও আমার মজ্জাগত হয়ে গেছে অনেক আগেই।

তাই বলি, ‘বাবাকে কোথায় পাবো? কত বছর হয়ে গেল বাবাকে দেখি না। আর তুমি না বলেছিলে বাবার নাম যেন মুখে না আনি?’ অকস্মাৎ হেসে উঠে মা বললেন, ‘হারামজাদা, তোর মুখের কথা বলেছি। আমার মুখে উচ্চারিত হবে না তা তো বলি নাই!’ ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠি আমি। তিনি যেদিন সুস্থ মানুষের মতো আচরণ করেন, সেদিন রাতেই তিনি ঘরের জিনিস-পত্র ভাঙচুর করেন। বাধা দিতে গেলে আমাকে মারতে আরম্ভ করেন।

মার খেতে খেতে আমি কৌশলে সরতে সরতে মা-কে নিয়ে যাই আসবাব-শূন্য ঘরটিতে। আমার দিকে গ্লাস-প্লেট, ফুলদানী জুতো-স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারার চাইতে মায়ের কিল-চড়-লাথি অনেক নিরাপদ মনে হয়। কিন্তু আজ কেন হঠাৎ বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন সেটিই বুঝতে পারছিলাম না। তা ছাড়া বাবার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে তা-ই বা কী করে টের পেলেন? ‘কি ভাবিস এত? তোর বাবাকে ফোন লাগা!’ ঘটনাটি বাবাকে জানানো প্রয়োজন ভেবে কালক্ষেপণের সুযোগ খুঁজি। তাই বলি, ‘আচ্ছা, নাম্বারটা খুঁজে দেখি আগে।

’ কিন্তু তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ফোনটা দে! নাম্বার আমি জানি। ’ আমি অবাধ্য হতে সাহস পাই না। ফোন এগিয়ে দিতেই তিনি নাম্বার টিপে টিপে পুরোপুরি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফোনটি কানের পাশে ধরে ইঙ্গিতে আমাকে সরে যেতে বলেন। মায়ের ইঙ্গিত মতো আমি একেবারেই সরে যেতে ভরসা পাই না। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকি কান পেতে।

অপেক্ষা করি, কখন তিনি ফোন সেটটি দেয়ালের গায়ে বা মেঝেতে ছুঁড়ে মারবেন। কিন্তু তখন বা তার কিছুক্ষণ পরও ব্যাপারটি ঘটে না। এক একটি সেকেন্ড দীর্ঘ মনে হতে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে অস্থিরতা। মনে হয়, আমি যেন গল্পের সেই মেথুসেলা- যে অপেক্ষায় আছে অনন্তকাল ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.