বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তমাদের বাসে তুলে দিল মারুফ। তারপর একটা সি এন জি নিয়ে মোহম্মদপুরে নাবিলদের বাড়ির সামনে চলে এল । তখন থেকে মনটা ভীষণ খচখচ করছে।
ঐশীকে চারদিন দেখবে না ভাবলেই বুকের ভিতরটা কেমন হিম হয়ে আসছে। গত মার্চে দু-বছরে পড়ল ঐশী। শিশু কন্যার ফরসা মুখের দিকে চেয়ে সারাদিন একটা বাইং হাউজের নিরানন্দ পরিবেশে রক্ত পানি করে কঠোর পরিশ্রম করে মারুফ।
সি এন জি থেকে নেমে ভাড়া মিটাল মারুফ। তারপর নাবিলকে একটা মিস কল দিল।
এদিককার রাস্তায় তেমন আলো
নেই। আশেপাশের বাড়িগুলিতে অবশ্য আলো জ্বলে আছে। সামান্য উদ্বেগ বোধ করছে। একা একা তমারা কোথাও গেলেই উদ্বেগ বোধ করে মারুফ। বিয়ের পর থেকে অবশ্য তমা অনেকবারই একা একা খুলনায় বাবার বাড়ি গিয়েছে, কখনও কোনও ধরণের ঝামেলা হয়নি।
তা ছাড়া বাসে থাকতেই অনেকবারই ফোন দেয় তমা। তারপরও উদ্বেগ হয়।
নাবিল এখনও আসছে না। ক্ষীণ উদ্বেগ বোধ করে মারুফ। নাবিলের বড় ভাই সাদাত মারুফের অনেক দিনের পুরনো বন্ধু।
সাদাত এখন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর থাইল্যান্ডে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ করছে; আর নাবিল বি বি এ পড়ছে। এ বছরই এশিয়ান ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হয়েছে।
একটু পর দূর থেকে নাবিল কে আসতে দেখল। ফরসা, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল আর চশমা পরা, হালকা-পাতলা চেহারা নাবিলের। কালো টি-শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে আছে।
বয়সে মারুফের চেয়ে অনেক ছোট হলেও নাবিলের সঙ্গে মারুফের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। তমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে নাবিলকে কিছু দিন গিটার শিখিয়েছিল মারুফ। নাবিলের হাতে একটা কালো রঙের গিটারের ব্যাগ। মারুফ-এর বুকটা ধক করে উঠল। মারুফ জানে ওই ব্যাগের ভিতরে রয়েছে হলদে রঙের একটা ইন্ডিয়ান গিভসন গিটার ।
নাবিল কাছে আসতেই হেসে জিগ্যেস করল মারুফ, কি অবস্থা নাবিল?
নাবিল বলল, ভালো না ভাইয়া। কন্ঠস্বরে কেমন বিষন্নতা জড়ানো।
কেন? কি হয়েছে?
আমাদের ব্যান্ড ভেঙে যাচ্ছে।
ভেঙে যাচ্ছে! কেন?
আমাদের ব্যান্ডের বেসিষ্ট তানিম চলে যাচ্ছে ইউ কে।
ওহ্ ।
শ্বাস টানল মারুফ। ব্যান্ডের এই এক সমস্যা, মেম্বার নিয়ে টানাপোড়েন। ইউনিভারসিটিতে পড়ার সময় মারুফও একটা ব্যান্ডে ছিল। তো, ওদের ড্রামার মুশফিক চলে গেল আমেরিকায়। পরে ‘ইনভিজিবল সেলফ’ ব্যান্ডের রুবেল এসে জয়েন করল।
তার সঙ্গে কারোই অ্যাডজাস্ট হয়নি।
আর কি খবর? মারুফ জিগ্যেস করে।
নাবিল বলল, খবর আর কি। কুরবাণী ঈদে নাকি জুয়েল ভাইয়ের নতুন অ্যালবাম বার হচ্ছে শুনলাম। ইনসট্রুমেন্টাল।
তাই নাকি! মারুফ উচ্ছল হয়ে ওঠে। মাইলসের জুয়েল ওর ফেবারিট গিটারিস্ট।
হ্যাঁ। নাবিল মাথা ঝাঁকায়। আর সাজ্জাদ ভাইদের ডি-ইলুমিনেশন তো কঠিন হিট।
তাই নাকি।
হ্যাঁ। ওদের ‘পারাপার’ গানটা শুনলেই বুঝবেন।
মারুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর এমপিথ্রিটা তমার দখলে।
আরেকটা কিনে অফিসে লুকিয়ে রাখতে পারে । তবে এত লুকোচুরি আর ভালো লাগে না ওর।
নাবিল বলল, শুনলাম কুরবাণী ঈদে ব্ল্যাকের ফোর্থ অ্যালবাম বের হচ্ছে।
ধুৎ, অল্টারনেটিভ আমার ভালো লাগে না। আমার কাছে জনের গলা মরা-মরা লাগে।
অসহ্য। মারুফ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল।
হাঃ হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে নাবিল। ও জানে মারুফ ভাইয়ের ভালো লাগে ‘আর্টসেল’ ।
নাবিল বলল, জানেন তো ব্ল্যাকের জন ভাইয়ের বিয়ে।
মারুফ বলল, হ্যাঁ। সেদিন পেপারে দেখলাম । ফুয়াদ নাকি আবার আমেরিকা চলে যাবে? এখানে নাকি পোষাচ্ছে না?
জানি না। বলে নাবিল কাঁধ ঝাঁকাল। তারপর বলল, একটা ইয়ামাহা অ্যাকুয়েস্টিক গিটার বিক্রি হবে মারুফ ভাই।
খুব সস্তায়। মাত্র ৮,০০০। কিনবেন নাকি?
ইয়ামাহা অ্যাকুয়েস্টিক?
হ্যাঁ।
কাট অ্যাওয়ে?
অবশ্যই।
নাহ্, নোহ্ ওয়ে ।
বলে মাথা নাড়ে মারুফ।
নাবিল বিষন্ন বোধ করে । ও জানে-বিয়ে করার পর সংসারী হয়ে মারুফ আর আগে মতো নেই । গিটারও লুকিয়ে রাখতে হয়।
নাবিলের হাত থেকে গিটার নিয়ে মারুফ বলে, রোববার রাতে এসে দিয়ে যাব।
তার আগে ফোন করে আসব।
নাবিল মুচকি হাসে। তারপর মজা করে বলে, আপনার গিটার। দিলে কি আর না দিলে কি!
মারুফও কথাটা শুনে হাসে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
বিয়ের পর থেকে গিটারটা নাবিলের কাছেই থাকে। কি কারণে বিয়ের পর তমা চায়নি মারুফ আর গিটার বাজাক । বিক্রি করে দিতে বলেছিল। মারুফ পারেনি। তবে বলেছিল, আচ্ছা, করব।
কাষ্টমার দেখছি। তারপর গিটারটা নাবিলের কাছে রেখে তমাকে ২০০০ টাকা দিয়ে বলেছিল, সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস-এর বেশি দাম উঠল না ... মিথ্যের সেই শুরু। রপ্তানী মেলায় বাংলাদেশ মেলামাইনের ডিনার সেট পছন্দ হয়েছিল। ওটা কেনার জন্য জন্য টাকা জমাচ্ছিল তমা । টাকাটা কাজে লেগেছিল।
গিটারের ব্যাগটা নিয়ে হাঁটতে থাকে মারুফ। ওর ফ্ল্যাটটা এখান থেকে কাছেই- দু-ব্লক পরেই। অফিস অবশ্য গুলশান। অফিস অত দূরে বলেই অফিস থেকে ফিরতে - ফিরতে কখনও অনেক রাত হয়ে যায়। ফ্ল্যাটে ফিরে ঘুমন্ত ঐশীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তখন কী যে এক তরল সুখ বুকের ভিতর তিরতির করে কাঁপে...যদিও বুকের ভিতরে সারাক্ষণ হলদে রঙের একটা ইন্ডিয়ান গিভসন গিটারের জন্য অদৃশ্য কাঁটা বিঁধে থাকে ...
এক প্যাকেট বেনসন লাইট কিনল মারুফ।
বিয়ের পর তিনটে জিনিস রাতারাতি ছাড়তে হয়েছে। (ক) সিগারেট। (খ) কয়েকজন ঘনিষ্ট বন্ধু। এবং (গ) গিটার।
এই তিনটে জিনিসের বদলে অবশ্য তমার ভালোবাসা পেয়েছে। ... এক ঝিরঝিরে বৃষ্টির সন্ধ্যায় নাসিম ভাইয়ের কলাবাগানের ফ্ল্যাটে তমাকে প্রথম দেখেছিল মারুফ। নাসিম ভাইরা অনেকদিন পর জাপান থেকে দেশে ফিরেছেন। সে উপলক্ষ্যেই পার্টি । তমাও এসেছিল।
রোজি ভাবীর কী রকম বোন হত তমা। রোজি ভাবীর গানের গলা অসাধারণ । খাওয়াদাওয়ার পর রোজি ভাবী সাবিনা ইয়াসমীনের কিছু মারাত্মক সেনসেটিভ গান গেয়ে শোনালেন । ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’ ...আর, ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই, আমি হলেম কলঙ্কিনী’ ...আর, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’ ...গিটার বাজালো মারুফ । ওর বাজনার হাত দেখে তমা এবং অন্যরা ভারি মুগ্ধ।
তমা সম্ভবত সেই প্রথম বুঝতে পেরেছিল গিটারে যাদু আছে, যে যাদুবলে সূরের আশ্চর্য সূক্ষ্ম সব পরিবর্তন হতে পারে। ভিড়ের মধ্যে মুগ্ধ দৃষ্টিতে বারবার মারুফের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল তমা; ইডেনে পড়ত তমা, সমাজবিজ্ঞানে। তমাই আগ বাড়িয়ে মারুফের সেল নম্বর চেয়ে নিল। সে সময় মারুফ অবশ্য বেকার ছিল। তমার সঙ্গে দেখা হওয়ার ঠিক এক মাসের মধ্যেই চাকরি পেয়ে গেল।
নাসিম ভাই এক বন্ধুর সঙ্গে বাইংহাউস দিলেন, মারুফকে জয়েন করতে বললেন ... তার আগে দু’জনে মিলে ঢাকা শহরটায় খুব চক্কর মেরে বেড়াল, একেক দিন একেক রেস্তোঁরায় খেল, মোতালেব প্লাজায় ঘুরে মেবাইল সেট দেখল, সিনে কমপ্লেক্সে সিনেমা দেখল। একদিন রিকশায় ফিসফিস করে তমা বলল, আমাদের মেয়ে হলে নাম রাখব ঐশী। কথাটা শুনে মারুফ কেমন ভিজে যায়। সেসব দিনে তমাই সিগারেট-টিগারেট কিনে দিত মারুফকে । মারুফ কখনও তমাকে দিলু রোডে মোরশেদের বাড়িতে নিয়ে যেত ।
স্কুললাইফের ফ্রেন্ড মোরশেদ, ভীষণ ছন্নছাড়া, ছন্নছাড়া এবং বেকার, মাথায় পথিক নবীর মতন জটাধরা চুল; কানে রিং, চোখে নীল সানগ্লাস, অবশ্য গানের গলা আর গিটারে হাত চমৎকার; ‘পাওয়ার অভ সেভেন’ নামে একটা পোগ্রেসিভ রক ব্যান্ডের গিটারিস্ট কাম ভোকাল। মারুফ আর মোরশেদ বসে অনেকক্ষণ ধরে জ্যাম করত। তন্ময় হয়ে শুনত তমা। তমার অবশ্য ইংরেজি গান তত ভালো লাগত না, তমার ভালো লাগত সামিনা নবীর গান ... পথিক নবীর একটা গানও খুব পছন্দ করত তমা, আসলে, তমার শরীরে গানের জিন নেই, মারুফ অনেক পরে টের পেয়েছে। বিয়ের পর তমা বেঁকে বসল-মোরশেদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না।
ঐশীর প্রথম জন্মদিনে মোরশেদকে ইনভাইট করার কথা ভেবেছিল মারুফ। তাতে ভেটো দিল তমা । বলল, না, না। অনুষ্ঠানে কত গেষ্ট আসবে। তোমার বন্ধু মোরশেদ কানে রিং পড়ে, নখে নেইল পালিশ দেয়।
বিচ্ছিরি!
আর, সিগারেট ছাড়তে হল বিয়ের পরপরই।
আর গিটারটা বিক্রির কথা বলে নাবিলের কাছে রেখে আসতে হল বিয়ের এক মাসের মধ্যে ...
সিঁড়িতে মোবাইল বাজল। তমা। এই শোন। ডিপফ্রিজে না একটা বক্সে আইসক্রিম আছে, স্ট্রবেরি।
মনে করে খেও কিন্তু...
ঠিক আছে খাব।
একটু খুঁজতে হবে। মাংসের প্যাকেটের নিচে আছে।
ঠিক আছে, আমি খুঁজে নেব।
অ্যাই, তুমি এখন কোথায়?
এইমাত্র ফ্ল্যাটে ঢুকছি।
এখন? কী বলো! এত দেরি যে!
জ্যামে আটকে পড়েছিলাম।
কই, আজ তো তেমন জ্যাম ছিল না।
আমি কী করব। সিএনজিঅলা পান্থপথ দিয়ে না এনে ঘুরপথে নিয়ে এল।
সত্যি?
সত্যি।
আচ্ছা এখন রাখি তাহলে।
ঠিক আছে।
ফ্ল্যাটে ঢুকে আলো জ্বালাল মারুফ। হালকা নীল নীল রঙে ছিমছাম করে সাজানো ড্রইংরুম । এ ব্যাপারে তমার রুচি আছে।
কলেজে পড়ার সময় ইন্টিরিয়রের কোর্স করেছিল তমা । যে কারণে সুন্দর করে নিজের সংসারটা সাজিয়ে নিতে পেরেছে। সোফার ওপর গিটারের ব্যাগ রাখল মারুফ। এই মুহূর্তে পুরো ফ্ল্যাটে কেউ নেই। কী শান্তি! এরকম একা একা জীবন কাটিয়ে দিতে পারলে এমন কী হত ।
ভাবতেই ঐশীর টলটলে মুখটা ভেসে উঠল। আর মনটাও খচখচ করে উঠল। মেয়েটাকে চারদিন দেখবে না ভাবলেই বুকের ভিতর হিম হয়ে আসে।
ঐশীকেই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মনে হয়।
আর গিটার?
সারা শরীরে ঘাম আর ডিজেলের গন্ধ ।
এখন একবার গোছল করে নিলে হয়। খাওয়ার ঝামেলা নেই। ফ্রিজে পাউরুটি আছে, বক্সে রান্না করা মাংস আছে, গরম করে নিলেই হবে । যাওয়ার আগে বারবার এসব দেখিয়ে গেছে তমা। মারুফের ভীষণ যতœ নেয় তমা, ভীষণ .. যেন মারুফ অরেকটা শিশু ... ভীষণ অবোধ এক শিশু ...এত পাগলের মতো ভালোবাসে তমা ...
পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে মারুফ।
মানিব্যাগের ভিতরে একটা গিটার বাজানো ‘পিক’ আছে। (পিকটা জুয়েল ভাই গিফট করেছিল) ...তমার সামনে কতবার মানিব্যাগ খোলে মারুফ... তারপরও তমা জানে না-ওই পিকটা মারুফের কত প্রিয়। মারুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় বসল । তারপর পরম যতেœ ব্যাগ থেকে গিটার খুলে কোলে তুলে নেয় । যেন ঐশীকে কোলে নিচ্ছে।
আদর করে গিটারে হাত বুলায়। মারুফের প্রিয় কর্ড ডি-মাইনর। সেই কর্ডটা ধরে, অনেক দিন পর বলেই আঙুলের ডগায় অল্প ব্যাথা হয়, তিন মাস আগে তমারা একবার খুলনা গিয়েছিল, তখন একবার দু’দিনের জন্য নাবিলের কাছ থেকে গিটারটা এনেছিল; পিক দিয়ে ধীরে ধীরে তারগুলিতে স্পর্শ করে মারুফ... ২ আর ৫ নম্বর তার সামান্য ডিসটিউন ছিল। কি ঘুরিয়ে ঠিক করে নিল। তারপর প্রিয় একটা গান গাইতে লাগল: এই নীল মনিহার/ এই স্বর্ণালী দিনে/ তোমায় দিয়ে গেলাম/ শুধু মনে রেখ ... ডি মাইনর - এফ - সি - ডি মাইনর ... এতকাল পর একা একা মারুফের কেমন কান্না পায়।
লাকি আখন্দের এই গানটা শিখিয়েছিলেন রকেট ভাই । রকেট ভাই থাকতেন সিদ্ধেশ্বরীর একটা সরু গলির ভিতরে অস্তরহীন একটি বাড়ির দোতলায়। মারুফরা তখন শান্তিনগরে থাকত। আজম খানের সঙ্গে লিড গিটার বাজাতেন রকেট ভাই। ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’...গানগুলি সে সময় খুবই জনপ্রিয়।
মারুফ তখন উইলস লিটিল ফ্লাওয়ার স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ত । রকেট ভাই সন্ধ্যার পর শান্তিনগর মোড়ের একটা মিস্টির দোকানে আড্ডা দিতেন। মারুফ রকেট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে বলল, গিটার শিখব। রকেট ভাই রাজী হলেন শেখাতে ... মাকে বলতেই মা গিটার কেনার টাকা দিয়েছিল। প্রথমে ৩টি কর্ড শেখালেন: ডি মাইনর, সি আর এফ ।
কী কষ্ট! আঙুল বসে না, নড়ে না, আঙুলের ডগায় রক্ত বেরিয়ে গেল! তবে কর্ডগুলি শিখে ধীরে ধীরে চেঞ্জ করতে পারল মারুফ। রকেট ভাই তারপর একটা প্লাকিং শেখালেন। ৪ (ডাউনস্ট্রোক) -১-২-৩ (আপস্ট্রোক) ... ৪-১-২-৩ ...মাস খানেকের চেস্টায় রিদম আর টেমপো স্টেডি রেখে কর্ড চেঞ্জ করতে পারল মারুফ। রকেট ভাই খুশি হলেন। বললেন, লাকি ভাইয়ের ‘এই নীল মনিহার’ গানটা তো জান? না?
মারুফ মাথা নাড়ে।
তাহলে ডি মাইনর কর্ডটা ধর তো।
মারুফ ধরল।
এবার প্লাকিং কর ... ৪-১-২-৩ ... ৪-১-২-৩ ...
মারুফ প্লাকিং করে ।
হ্যাঁ। এই বার ‘এই নীল মনিহার’ গানটা গাও।
যেখানে যেখানে কর্ড চেঞ্জ করার দরকার কর। ডি মাইনর-সি-এফ।
মারুফ প্লাকিং করে, গানটা গায়, কর্ড চেঞ্জ করে। তারপরই শরীরে প্রবল এক শিহরণস্রোত টের পায়, ক্লাস এইটে জীবনে প্রথমবার আত্মমৈথুনের চেয়েও গভীর সে শিহরণ । সেই প্রথম ঢাকা শহরের এক কিশোর গিটারের গভীর প্রেমে পড়ে যায় ... এর বহু বছর পর ওর জীবনে আরেক প্রেম এসে প্রথম প্রেমকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল ... এই ঘটনার বহু বছর পর দিলু রোডে ফারহানের নির্জন ঘরে তমার স্তন আর পেলব নাভীমূল প্রথম স্পর্শ করেছিল মারুফ।
ফারহানকে ইঙ্গিত দেওয়াই ছিল। ও বাড়ি ছিল না। মারুফকে শারীরিকভাবে পেতে ভীষণ উৎসাহ ছিল তমার । মারুফ অবশ্য নার্ভাস ছিল। তারপরও কী ভাবে যেন এক ঘোরের মধ্যে হয়ে যায়।
বিছানার এক কোণে ফারহানের ইয়ামাহা অ্যাকুয়েস্টিক গিটারটা পড়ে ছিল। শরীরে মধুর ক্লান্তি নিয়ে গিটারটা ছুঁয়েছিল মারুফ-তমাকে নয় । তমা তখন প্রায় অচেতন।
নীচ থেকে গড়ির তীব্র হর্ণের শব্দে মারুফের তন্ময়তা ঘুচে যায় ।
মারুফ টের পায় ওর হাতের তালু ভিজে গেছে।
আজকাল এমন হচ্ছে। অফিসে কাজের এত চাপ। হাতের তালু ভেজা নাকি ভালো না. হার্টের সমস্যা ইন্ডিকেট করে। কোলে গিটার রেখেই প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট ধরালো মারুফ। ন’টার মতন বাজে।
সিগারেট শেষ হতেই কারেন্ট চলে যায়। ড্রইংরুম জুড়ে অন্ধকার নামে । অন্ধকারেই আর্টসেলের ‘পথচলা’ গানটা গাইতে থাকে মারুফ। গানটা ওর ভারি প্রিয় । আসলে আর্টসেলের অনেক গানেই ভীষণ একটা ডেপথ থাকে।
বুকে গেঁথে যায়। জান, তমা। ওদের প্রথম দিককার লিরিসিস্ট রূপক, অকালে মারা গেল। রূপক চমৎকার লিরিক লিখত। যেমন এই গানটা:
আমি জন্মাতে দেখেছি
জীবনের সব ভুলগুলি
জীবন ভুল না হতেও পারে
হয়তো সময় ভুল ছিল
মারুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
ঘরে তো তমা নেই। কী এমন হত যদি ওই সোফায় বসে থাকত তমা? ওর গান শুনত ... কেন তমার গিটার পছন্দ নয়।
মোবাইল বাজল। তমা।
কী করছ?
মাত্র গোছল করলাম।
এখন খেতে বসব। মারুফ বলে।
ফ্রিজে একটা বক্সে গোশত আছে। ওটা বের করে গরম করে নিও। দেখ আবার বেশি আঁচ দিও না চুলায়।
ওকে।
কারেন্ট যায়নি?
না, যায়নি। ঐশী কি ঘুমাচ্ছে?
হু। এই শোন, কাল দুধওয়ালাকে বলো শনি আর রোববারের দুধ যেন কাকলী ভাবীর ফ্ল্যাটে দিয়ে যায়।
ওকে, বলব।
আর, কাকলী ভাবী একা এলে বেশিক্ষণ কথা বলো না যেন।
হাঃ হাঃ হাঃ ...
হেসো না। দেখ, কাকলী ভাবী কাল সকালেই ঠিকই আসবে নাস্তা বানিয়ে।
এখনও আসেনি।
সত্যি?
সত্যি।
রাখি।
ওকে।
ফোন অফ করে অন্ধকারে নিথর হয়ে বসে থাকে মারুফ। সারা শরীরে ঘামও ডিজেলের গন্ধ পাক খায়। গলার কাছে তৃষ্ণা।
খিদে অবশ্য পাচ্ছে না। হঠাৎই কী কারণে অন্ধকারে মায়ের মুখটা ঝলসে উঠল। গিটার খুব পছন্দ করত মা । কলেজে ওঠার পর রকেট ভাই আমেরিকা চলে গেলেন। অবশ্য তার আগেই মারুফের অনেকগুলি গান তোলা শেষ।
গিটার বাজিয়ে গান গাওয়ার সময় মা আড়াল থেকে শুনত। মারুফের বড় বোন নীলা আপাও শুনত। কলেজে পড়ার সময়ই মার ক্যান্সার ধরা পড়ল। মা মারা গেল ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার সময় । তার আগেই অবশ্য নীলা আপার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।
(নীলা আপা এখন কোরিয়ায়) ... মা মারা যাওয়ার এক বছরের মাথায় বাবা গ্রামে গিয়ে আবার বিয়ে করে দ্বিতীয় স্ত্রীটিকে নিয়ে এলেন ঢাকায়। সৎ মায়ের সঙ্গে থাকে কি করে মারুফ ? ছোট খালার বাড়ি চলে গিয়েছিল। ছোট খালা মোহম্মদপুরে থাকতেন। মারুফকে ভীষণ আদর করতেন । মায়ের মৃত্যু আর বাবার বিবেকহীনতা দেখে বিষন্ন ছিল মারুফ।
ছোট খালাই তখন মারুফের জন্মদিনে এই হলদে রঙের ইন্ডিয়ান গিভসন গিটারটি কিনে উপহার দিলেন। ছোট খালার বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা শেষ করেছে মারুফ। মারুফের বিয়ের ক’দিন পর ছোট খালা মারা গেলেন। ক্যান্সারে ...
ফোন বাজল।
তমা।
ফোন রিসিভ করল না মারুফ । বরং অন্ধকারে গিটার কোলে নিয়ে বসে থাকল ...
তারপর একটা সিগারেট ধরালো ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।