বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
মোহনার শ্যামলা শরীর থেকে এক ধরনের মাটি-মাটি গন্ধ বের হয়- সাত বছর ধরে ওই রূপসী মেয়েটির সঙ্গে মিশে মিশে সে গন্ধে ভারি নেশা ধরে গেছে আবিদের। একটি দিনও সে মাটি-মাটি গন্ধ না পেলে মন খচখচ করে প্রাণ ছটফট করে, নিঃশ্বাস আটকে আসতে চায়। অথচ তিনদিন ধরে ফোন রিসিভ করছে না মোহনা ।
কি হল ওর? উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায় আবিদের শ্যামলা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়ে গেছে, মলিন মুখটায় পড়েছে অভিমানে গাঢ় ছাপ । মোহনাকে ঢাকা শহরের যেখানে-যেখানে পাওয়া যেতে পারে সে সব সম্ভাব্য জায়গায় মোহনাকে পাওয়া গেল না। মাস ছয়েক হলো পুরানা পল্টনে একটি কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে জয়েন করেছে মোহনা । ওখানেও ওকে পাওয়া গেল না। পুরানা পল্টনে বড় ভাইয়ের বাসায় থাকে মোহনা ।
তো, সে বাড়িতে আবিদের যাওয়া নিষেধ। রাস্তার পাশে চা-স্টলে বসে এ শহরের লোকজন, গাড়িঘোড়া দেখে আবিদ, আর একটার পর একটা সিগারেট টানে দেখতে দেখতে আষাঢ় মাসের দিনটি কেমন মেঘে ঢেকে যায়। এবং দিনভর শহরটার এদিক-সেদিক ঘুরে অনেক রাত্তিরে সে সেগুন বাগিচায় বড় ভাইয়ের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। বেসরকারি একটা ব্যাংকে চাকরি করেন রায়হান ভাই । দু-ভাইয়ের মানসিকতা সম্পূর্ন উলটো হলেও ছেলেবেলা থেকেই দু-ভাইয়ের মধ্যে ভারি বন্ধুত্ব - একসঙ্গে ভাগাভাগি করে সিগারেট খেয়েছে, এডাল্ট ম্যাগাজিন দেখেছে; এক সঙ্গে ঘুরেও বেড়াত খুব ।
বিশেষ করে পুরনো ঢাকার অলিগলি। শবে বরাতের সময় বাবার পকেট কেটে মালিবাগ থেকে হাঁটতে হাঁটতে চকবাজারে চলে যেত তারাবাতি-পটকা কেনার জন্য। এখন কি করে যে রায়হান ভাই রাত ৮টা/৯টা পর্যন্ত ব্যাংকের ভিতরে কাটায়! আবিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
কাল রাতে মিলি ভাবী চূড়ান্ত নোটিশ দিয়েছে। মির্জাপুর থেকে ভাবীর মা-বাবা আসছেন ঢাকায়, সুতরাং ক’দিনের জন্য আবিদ যেন অন্য কোথাও গিয়ে থাকে।
এর মানে অতি সত্ত্বর ঘর ছাড়তে হবে। আসলে মিলি ভাবীর কাছে তার বেকার দেবরটি দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠছে। মোহনাও, আগে সমর্থন করলেও, আজকাল আবিদের বেকারত্বে বিব্রত। আবিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দু-বছর হল পাস করে বসে আছে।
মীরপুরের দিকে একটা স্কুলে জয়েনও করেছিল। মন টেকেনি। কোথাও বেশি দিন ভালো লাগে না ওর। রেজাল্টও সন্তোষজনক হয়নি। আবিদের ঘর ভরতি কবিতার বই, একটি গিটার ও শ’খানেক গানের সিডি ...ওসব ফেলে এখন কোথায় যাওয়া যায়? আবিদের হাত-পা কাঁপে।
এত বড় শহর ...কিন্তু কে আশ্রয় দেবে? যেখানেই যাই-কবিতার বইগুলি নেব না। স্নেহার জন্য রেখে যাব। স্নেহা বড় হয়ে যদি কখনও পড়ে। ক্লাস টুয়ে পড়ে স্নেহা, আবিদের ভারি ন্যাওটা। স্নেহার যদি কখনও বড় হয়ে বইগুলি ছোঁয় তো ...হে ঈশ্বর ...
মোহনপুরে আবিদের এক বৃদ্ধা ফুপু থাকেন।
মোহনপুর জায়গাটা মেঘনা নদীর পাড়ে। ফুপুর নাম আরাফাতুন্নেছা, অবশ্য আবিদরা আরাফাত ফুপু বলেই ডাকে। মোহনপুরে গিয়ে কিছুদিন থাকলে কেমন হয়? অসহায় মুহূর্তে এই ভাবনাটি আবিদকে ভয়ঙ্করভাবে গ্রাস করতে থাকে। আরাফাত ফুপু বিধবা। বহু বছর ধরে বাপের বাড়ি থাকছেন।
স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি তে কী সব ঝামেলা হয়েছিল, আবিদ ঠিক জানে না, আবিদের বাবা গিয়ে বোনকে নিয়ে এসেছিলেন। ... ভাগ্যিস দেশের বাড়ির ভিটেমাটিটুকু এখনও আছে। আবিদ স্বস্তি বোধ করে। এ শহর যখন প্রেমশূন্য হয়ে উঠেছে, তখন আর এই ইটকাঠের খাঁচায় থেকে কি লাভ। দেশে যখন একজন নিকট আত্মীয়া আছেন, তখন তার কাছে চলে যাওয়াই ভালো...
নারায়নগঞ্জ থেকে লঞ্চে উঠল সকাল ন’টায় ।
আষাঢ়ের দিনটা রোদ ভরে ছিল। ছোট লঞ্চ। ভিড়ও আছে। দোতলার কেবিনের পিছনে চিমনি; তার পিছনে নামাজের স্থান। ওখানেই পা-ঝুলিয়ে বসল আবিদ।
মনের ভিতরে ভীষণ অস্বস্তি; ফুপু কি রকম আচরণ করবেন? আরাফাত ফুপু কখনও ঢাকায় আসেননি। বছর পাঁচেক আগে কয়েক জন বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আবিদ একবার মোহনপুর গিয়েছিল । তখন বাবা বেঁচে ছিলেন। আরাফাত ফুপু আন্তরিক আচরণ করেছিলেন। আবিদের বাবা মায়ের নামে একটা প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গ্রামে ।
পাস করে স্কুলে মাস্টারি করতে বলেছিলেন আরাফাত ফুপু । ধুরও-আবিদ হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল।
নদীর বাতাসে আবিদের উশকোখুশকো চুল উড়ছিল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে চশমা, নীলচে টি-শার্ট, কাঁধে ঝুলি, কালো প্যান্ট। বুড়িগঙ্গার কালো পানি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল, অবশ্য এসব ওকে স্পর্শ করছিল না। কেবল স্নেহার মুখটি ভাসছিল মনে।
অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরাল। পাকিস্তান আমলে মোহনপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন বাবা । এসে কি লাভ হল? শেষ বয়েসে এসে ধুঁকতে হল, ছেলের বৌয়ের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হল!
লঞ্চ ছাড়তেই ভটভট শব্দ অসহ্য ঠেকছিল। চিমনি থেকে কালো ধোঁয়া উড়তে লাগল। চারিদিকে এত ধোঁয়া, এত কালো ধোঁয়া ... একটি শিশুর কান্না ভেসে আসে।
দু’পাশে নদীর পাড়ের দৃশ্যগুলি বিচ্ছিরি। নোংরা ডকইয়ার্ড, ওল্টানো নৌকা। দূরে বুড়িগঙ্গা সেতুর আবছা অবয়ব চোখে পড়ে।
একটা লোক এসে ওর পাশে বসল পা ঝুলিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আতরের গন্ধ পেল আবিদ।
বৃদ্ধ লোক। মাথায় খয়েরি রঙের জটা, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। গায়ের রং মিশমিশে কালো, ছোটখাটো শীর্ণ শরীর, পরনে চেক লুঙ্গি আর ময়লা পাঞ্জাবি, কাঁধের ওপর লাল রঙের কাপড় জড়ানো। বৃদ্ধের চোখ দুটে কেমন টলটলে। কত বয়স হবে? ঠিক বোঝা গেল না।
তবে ষাটের কম না । বৃদ্ধ একটু পর বলল, আমার নাম মুজিব বৈরাগী। বলে হাত বাড়িয়ে বলল, দেন, একটা বিড়ি দেন?
আবিদ অবাক হল না। সে রাতবিরেতে একা একা ঢাকা শহরে চক্কর দেয় । তখন কত রাতচরা বাউল-ফকিরের সঙ্গে পরিচয় হয়।
সিগারেট বের করে দিল আবিদ। অনেক কায়দা করে সিগারেট ধরাল মুজিব বৈরাগী । সিগারেটে টান মেরে কাশল কিছুক্ষণ। মনে হল হাঁপানির সমস্যা আছে।
আবিদ বলল, ঢাকায় কই গেছিলেন চাচা?
মহাখালী।
বুকে শ্বাসের কষ্ট আছে। বড় ডাক্তার দেখাইতে গেছিলাম। বইনের ছেলে সাভারে গারমেন্টে চাকরি করে। হাফিজুরের কাছেই ছিলাম।
বুকে শ্বাসের কষ্ট আছে তো সিগারেট খান কেন?
উত্তরে বৃদ্ধ হাসল।
আপনার বাড়ি কই?
কলাকান্দা বাবা। কলাকান্দার নাম শুনছেন নি?
আবিদ মাথা নাড়ে। আপনি কি করেন?
আমি হইলাম বৈরাগী। আমি বৈরাগীর কাম করি। নুরুন নবীর নূরের সন্ধানে আছি।
পাত্র বিশেষে সেই নূর ধরা দেয়, চিত্ত প্রফুল্ল থাকিলে।
বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনের বিষাদ ভাবটা কেটে যাচ্ছিল। ও মাথা নেড়ে বলল, হুম। বুঝলাম। তো বৈরাগীরা তো গানবাজনা জানে শুনছি।
আপনি গান জানেন?
হ, বাবা। জানি। বাবা আজম শাহ্র দোয়ায় আর নুরুনবী উছিলায় আল্লার কিছু শান পাইছি রে বাবা।
নদীর দিকে তাকিয়ে সিগারেটে টান দিয়ে অন্যমনস্কভাবে আবিদ বলল, শোনান।
আবিদ ভেবেছিল মুজিব বৈরাগী নুরুন নবী মোস্তফায়/রাস্তা দিয়া হাঁইটা যায়/ পাখি একটা বইসা ছিল গাছেরও শাখায় টাইপের গান ধরবে।
তার বদলে সিগারেটটা দূরে নদীতে ছুড়ে মুজিব বৈরাগী গলা ছেড়ে গাইতে লাগল-
তোমারে যতন কইরা দিলাম যাহার ঠাঁই
সেই তোমারে দিল ফাঁকি চল লইয়া যাই রে
কান্দো কেন মন পাগলা রে ...
কান্দো কেনে মন, কান্দিয়া কান্দিয়া যাইব তোমারও জীবন রে
কান্দো কেন মন পাগলা রে ...
এক্ষণে নদীর অশান্ত বাতাসের ভিতর আবিদের অন্তরে যেন মোহনার মুখখানি ভেসে ওঠে ...
লঞ্চের যাত্রীরা জড়ো হতে থাকে আর মুজিব বৈরাগী গলা ছেড়ে গাইতে থাকে-
দুঃখ-সুখের দুইটি ধারায় বইছে নদীর জল
সুখে বাইব তোমার ডিঙা করিয়া কোন্ ছল।
তাই তো বলি ওরে ও মন এ যে কঠিন ঠাঁই
কোন্ খানে পাঠাইয়া দিল মওলা মালিক শাঁই রে
কান্দো কেনে মন, মন পাগলা রে কান্দো কেন মন...
কান্দিয়া কান্দিয়া যাইব তোমারও জীবন রে
আবিদের চোখ ভিজে ওঠে। এবং সে নগ্ন ও নিরাভরন হয়ে উঠতে থাকে। ও যেন সময় ও দূরত্বের কুয়াশা ভেদ করে আরেকজন তরূনকে দেখতে পায়। যে তরুণ এই জনপদেরই কেউ, বহুদিন আগে, সেও গৃহত্যাগ করেছিল।
উশকোখুশকো চুল, মুখ ভরতি দাড়িগোঁফ, অবিকল আবিদের মতোই দেখতে ... অথচ, অন্য কোনও সময়ের। সে তরুন নির্জনে বসে গাইছে ... দুঃখ-সুখের দুইটি ধারায় বইছে নদীর জল/সুখে বাইব তোমার ডিঙা করিয়া কোন্ ছল ...এই ভেবে সে সান্ত্বনা পেয়েছিল?
গান শেষ করে হাত বাড়িয়ে বিড়ি চায় মুজিব বৈরাগী। আবিদ বাস্তবে ফিরে আসে এবং প্যান্টের পকেটে হাত দেয়। সহসা আতরের গন্ধ তীব্র হয়ে ওঠে। লঞ্চটি তারপর মেঘনায় উঠে এসেছিল।
দু’পাশে ছিল বিপুল বিস্তার। আর রোদ মুছে গিয়েছিল আষাঢ়ের দিন বলেই। মুজিব বৈরাগীর সঙ্গে আবিদের মারেফাত বিষয়ে নানা কথা হয়।
তারপর কখন যে লঞ্চটা কলাকান্দা লঞ্চঘাটে ভিড়ে। মুজিব বৈরাগী বলে, কলাকান্দায় বাবা আজম শাহ্র দরগা আছে।
দরগার জন্য কিছু দেন।
শেষ একটা পাঁচশো টাকার নোট ছিল আর কিছু খুচরা ছিল মানিব্যাগে। অরূপ পাঁচশো টাকার নোট বার করে দিল।
টাকাটা নিয়ে মুজিব বৈরাগী কপালে ঠেকাল। বিড়বিড় করে কি সুরা পড়ল।
তারপর বলল, লঞ্চঘাটে আমার নাম কইলেই যে কেউ আমার বাড়ি দেখায় দিব। একবার বেড়াইয়া যাইয়েন মির্দাবাড়ি। আপনারে জ্বীনের বাদশা মীর লোকমানের লগে পরিচয় করাইয়া দিমু। বলে লাফ দিয়ে নেমে ধীরে ধীরে যাত্রীদের ভিড়ে মিশে যায়।
আবিদ বিচ্ছেদ টের পায় ।
মুজিব বৈরাগীরা টলটলে মানুষ, সংসারে সহজে এমন মানুষে দেখা মেলে না। সংসার-ভরতি কেবল হিসেবি মানুষ, যারা লাভ-ক্ষতির বিষয়ে ভীষণ সচেতন। মাস খানেক আগে মোহনা বলেছিল ওর এক মামাতো ভাইয়ের কথা। সে ভাই বহু বছর জাপানে ছিল। বিস্তর টাকাকড়ি নাকি করেছে।
শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা তোলায় এড়িয়ে গেছে মোহনা। তার বদলে বলল, উত্তরায় ২০০০ স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট কিনেছে সোহেল ভাই।
মোহনা কবিতাপ্রিয়, টিভি-কম-দেখা সংবেদনশীল মেয়ে। ও সহসা এত বদলে গেল কীভাবে?
আবিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেঘনা নদীর উপরে মেঘলা আকাশে মায়ের মুখ ভেসে ওঠে।
মা, আমি এত দুঃখকষ্টে আছি। আমি এখন কার কাছে যাবে? বলো? উত্তর নেই কেবলি লঞ্চের ভটভট শব্দ ...আবিদের বাবা ২০০৭ সালের এপ্রিলে মারা গেলেন। বাবার মৃত্যুর শোক ছ’ মাসও সইল না মার ...
মোহনপুর লঞ্চঘাট থেকে উঁচু রাস্তা চলে গেছে গ্রামের ভিতরে। সে রাস্তায় রিকশাও চলে। রিকশার বদলে খালপাড়ে গিয়ে নৌকায় উঠল।
খালের কালো পানি, কচুরি পানার গন্ধ, পাড়ের অন্ধকার অন্ধকার ডুমুর হিজল গাছ ... কেমন এক ঘোর তৈরি করে। মাঝির অনেক বয়স, পাকা দাড়িতে বৃদ্ধ দরবেশের মতন দেখতে। গলুয়ের কাছে বসে মাঝির সঙ্গে টুকটাক কথা হল। বাবা কে চিনত মোজাম্মেল মিঞা। বাবার সঙ্গে আশ্বিনপুর স্কুলে পড়ত।
আবিদের বুকটা কেমন টলটল করে ওঠে।
খালপাড়ে তালগুঁড়ি ফেলে ঘাটলা তৈরি করেছে। নৌকা ভিড়ল। মাঝি চাচা কিছুতেই পয়সা নিল না। নৌকা থেকে নেমে আবিদ কতক্ষণ স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
মাঝি চাচাও নাও ঘুরিয়ে নেয়।
স্তব্দ দুপুরটি মেঘলা। দু’পাশে বাঁশঝাড়। তার মাঝখান দিয়ে বাঁকানো সরু পথ। আবিদ হাঁটতে থাকে।
ভেজা ভেজা গাছ পালার গন্ধ পায়। মেঘনা নদীর দিক থেকে ছুটে আসা বাতাস ওকে ধাক্কা মারে। বাঁশঝারে দাদীর কবর। এদিকে একটা টলটলে কালো পানির ছোট পানা পুকুরও আছে। জাম্বুরা গাছ ঘেঁষে গোয়াল ঘর।
ওপাশে একটা তেঁতুল গাছ। তারপর উঠান। মেঘলা উঠান। উঠানে আরাফাত ফুপুর দাঁড়িয়ে কাপড় তুলছেন।
আবিদ এগিয়ে যায়।
আরাফাত ফুপুর পরনে সাদা শাড়ি। বয়স ষাট ছাড়িয়ে গেছে। পায়ের শব্দে ঘুরে তাকালেন। পাকা চুল। কী ফরসা মুখ আর কাটা কাটা চোখ-নাক।
চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। একপাশের কাঁচ ফাটা। আবিদকে দেখে হাসলেন। আবিদ ঝুঁকে সালাম করে। ফুপু বললেন, আয়, ঘরো, আয়।
রায়হান কেমন আছে?
ভালো।
বউ-বাচ্চা?
ভালো।
হায়, তর মায়ের কত শখ আছিল শেষ বয়সে মোহনপুরে আইসা থাকব। আল্লায় কি আর সকলের মনের মর্জি পূরণ করে।
প্রশস্ত মাটির দাওয়া।
দাওয়ায় ওপর একটি কাঠের বেঞ্চ। টিনের ঘর, মাটির মেঝে, টিনের দেয়াল। বাবার শখ ছিল পাকা দালান করবে, কিন্তু স্কুলের পিছনে সব টাকা খরচ হয়ে গেল। এই নিয়ে মিলি ভাবী শেষ জীবনে বাবাকে কম অপমান করেনি। বিয়ের পর মিলি ভাবী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবর নিয়েছিল দেশের বাড়িতে কি আছে না আছে ...
ফুপু আমি এখানে কিছুদিন থাকব।
আবিদ বলল।
থাকলে থাকবি। তর নিজের বাড়িঘর। আমারে জিগ্যাস করস কেন।
কথাটা ভীষণ শান্তি দিল আবিদ।
বুকের ওপর থেকে ভারী একটা পাথর নেমে গেল। ভাগ্যিস ভাবীর কঠিন চাপেও বাবা ভিটেমাটি বিক্রি করে দেন নি। বোনের কথা ভেবেছেন। আশেপাশে কয়েক কানি সম্পত্তি নাকি এখনও আরাফাত ফুপুর দখলে আছে।
ঘরে বড় একটা বিছানা পাতা।
একটা চেয়ার। একটা আলনা। জানালা। পিছনের পুকুর আর গাছপালা দেখা যায়। আবছা আঁধারে ডুবে আছে সব ...
আলনায় তর আব্বার লুঙ্গি আছে।
পরলে পর।
আব্বার লুঙ্গি ! কথাটা যেন ভীষণ ধাক্কা মারল। মারা যাওয়ার আগে আব্বা ঘন ঘন মোহনপুর আসতেন। পালিয়ে আসতেন। এসে শান্তি পেতেন।
দেশের জমি বিক্রি করার জন্য মিলি ভাবীর অত্যাচার চরমে উঠেছিল।
যা, এখন গোছল কইরা আয়। আমি ভাত বাড়তেছি। তোর কপাল আইজ ভালো।
কেন?
আইজ বাইল্লা মাছের তরকারী দিয়া গেছে আফিয়া ।
কে?
আফিয়া। মির্দা বাড়ির ছোট মেয়ে। মাইয়াটার রান্ধনের হাত খুব ভালো। খাইলে বুঝবি।
ও।
আহা, মির্দাগো মাইয়াটা কী সুন্দর - এই বয়সে স্বামী তাড়ায় দিল।
আবিদের ভ্রুঁ কুচঁকে ওঠে। সারা বাংলাদেশ জুড়ে যেন এই একই কাহিনী, বড় করুন কাহিনী ...প্রতিকারহীন?
গোছল সেরে এসে খেতে বসল আবিদ। বেলে মাছের তরকারীর স্বাদ সত্যিই অপূর্ব ঠেকল। ডালও।
ফুপুর হাতের রান্না আগেও খেয়েছে। সত্যি চমৎকার।
ফুপু?
ক।
আব্বায় না একটা স্কুল দিছিল, সেই স্কুলের কি খবর?
খবর আর কী - মাস্টর থাকে আবার চইলা যায়। বেতন দিতে পারি না।
কেন?
পোলাপাইন ঠিক মতন আসে না।
খেতে খেতে আবিদ ভাবল, স্কুলটা দাঁড় করালে হয়। বাবার এত শখ যখন।
খাওয়ার পর দাওয়ার ওপর কাঠের বেঞ্চিতে এসে বসল আবিদ। ফুপু এঁটো বাসন-কোসন নিয়ে পুকুরের দিকে গেলেন।
আবিদ সিগারেট ধরাল। খানিক বাদে ফুপু ফিরে এলেন। আবিদের পাশে বসলেন।
তুই স্কুলটা দেখবি রে আবিদ?
হ্যাঁ।
তাইলে বড় ভালো হয়।
তর আব্বার ইচ্ছা ছিল মায়ের নামে স্কুলঘরটা বড় কইরা তুলব।
তোমার শ্বশুরবাড়ি কি কলাকান্দায় ছিল ফুপু?
হ। কলাকান্দার মির্দা বাড়ি। ক্যান?
ফুপা মারা যাওয়ার পর তোমার শ্বশুরবাড়ি তে কি নাকি ঝামেলা হইছিল? আব্বায় তোমারে নিয়া আসল।
ঝামেলা আর কী।
তোর ফুপার বুকের অসুখ ছিল। তে ঠিক মতন সংসার করতে পারে নাই। আমিও মা হইতে পারি নাই। তার ছোট ভাই আমারে বড় শ্রদ্ধা ভক্তি করত। আমি আর কী কমু।
তোর ফুপা মারা গেলে দেখি দেবরে কেমন কেমন করে। আমি তর আব্বারে খবর দিলাম আমারে নিয়া যাইতে। মনের দুঃখে আমার সে দেবর বৈরাগী হইয়া গেল।
কি নাম ছিল তোমার দেবরের? আবিদের বুকটা ঢিপঢিপ করছে।
মুজিবর মির্দা।
শুনছি পরে নাম নিছে মুজিব বৈরাগী।
আবিদের শরীর মুহূর্তেই জমে যায়। খুব কাছে কে যেন গেয়ে উঠল ... দুঃখ-সুখের দুইটি ধারায় বইছে নদীর জল/সুখে বাইব তোমার ডিঙা করিয়া কোন্ ছল ...আরাফাত ফুপুকে ভালোবেসেছিল মুজিব বৈরাগী? আরাফাত ফুপুর বিরহে বৈরাগী হয়েছে মুজিব মির্দা?
আবিদ জানে এখন থেকে সে এরকম অলৌকিক রূপকথা আরও শুনতে পাবে। ও শিকড়ে পৌঁছে গেছে, আর শিকড় রূপকথাময়।
ফুপু উঠে দাঁড়ালেন।
তারপর বললেন, তুই ঘুমাইলে ঘুমা রে আবিদ। আমি পূব পাড়ায় যাই রাহিলাগো বাইত । মাইয়াটার বাচ্চা হইব। বাচ্চার জন্য কেথা বানাইছিলাম, দিয়া আসি।
পরদিনটিও মেঘলা।
সকাল বেলায় দাওয়ায় বেঞ্চির ওপর বসে গুড়-মুড়ি খাচ্ছিল আবিদ। সারা শরীরে গত রাত্রিতে দেখা স্বপ্নের ঘোর ছড়িয়েছিল। স্বপ্নের ভিতরে মোহনা বলছিল, আমার শরীর থেকে এক ধরনের মাটি মাটি গন্ধ বেরয়- সাত বছর ধরে আমার সঙ্গে মিশে মিশে সে গন্ধে তোমার নেশা ধরে গেছে। তুমি পালাবে কি করে আবিদ? আবিদ চিৎকার করে বলার চেষ্টা করছিল, তোমার শরীরের গন্ধে শহরের ডিজেল-পেট্রল মিশে আছে মোহনা! সে গন্ধ কবে বাসী হয়ে গেছে! আমি কেবল জানতে পারিনি! হাঃ হাঃ করে হেসে উঠেছিল মোহনা। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আবিদের।
তখন শেষ রাত, পুকুর পাড়ের গাছগাছালির উপর বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ ... অনেক ক্ষণ ধরে শুনেছিল । আর খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল। অন্ধকারে ভেসে উঠছিল স্নেহার কচি মুখটি। বুক ঠেলে চাপা কান্না উঠে আসছিল। বাবার স্বপ্নের স্কুলঘর আর মোহনপুরের অগনিত শিশুর কথা ভেবে কান্না চেপেছিল আবিদ।
হঠাৎ মুখ তুলে চমকে ওঠে আবিদ। মেঘলা উঠান একটা মেয়ে। শ্যামলা মতন, সবুজ শাড়ি পরা, লাল ব্লাউজ, আঁচলে কি যেন ঢেকে রেখেছে ... কাদা এড়িয়ে সাবধানে এদিকেই আসছে। আফিয়া? আবিদের শরীরে শিহরণস্রোত বয়ে যায়। ... মেয়েটি অবিকল কৃষ্ণকায় দেবীর মতো দেখতে, কী ভীষণ গম্ভীর ...আবিদ জানে ওই কৃষ্ণকলির দেহমাটিতে কোনও খাদ নেই ...এ দেবী পলি মৃত্তিকার কন্যা, জলজ এবং সর্বংসহা, আর এ মৃত্তিকার কন্যা অল্পতেই তুষ্ট হন এবং গভীর শান্তির উৎস ... আবিদ ওই কালো দেবীর নাম দিল কৃষ্ণকলি ... এই মাটির তৈরি দেবীকন্যার সান্নিধ্য লাভের জন্যই যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করছিল আবিদ ... নিজস্ব শিকড়ের এই কৃষ্ণনারীর অমোঘ টানেই নিজের ঘরে ফিরে এসেছে আবিদ ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।