প্রায়ই শোনা যায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। অর্থাৎ হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলুর হয়ে কারও মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও প্রতিনিয়ত হার্ট ফেইলুরের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দশ থেকে বিশ বছর পর হৃদরোগীদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোগী হার্ট ফেইলুরে আক্রান্ত হবে। কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে আধুনিক চিকিৎসার ফলে হৃদরোগীরা যদিও অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন।
বিশেষ করে হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীর রোগ থেকে তবে পরবর্তীতে তারাই হার্ট ফেইলুরে আক্রান্ত হয়ে থাকবেন। হার্ট প্রতিমুহূর্তে প্রয়োজন অনুযায়ী সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে থাকে । যদি কোনো কারণে হার্ট শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্ত সঞ্চালন করতে ব্যর্থ হয় এ অবস্থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় হার্ট ফেইলুর বলা হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষ কোনো কারণে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াকে হার্ট ফেইলুর বলে থাকে। আসলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং হার্ট ফেইলুর দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।
এখানে তিনটি বিষয়ে কিছু ধারণা দেওয়া যেতে পারে_ হার্ট ফেইলুর, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট অ্যারেস্ট।
ফেইলুরের কারণ : হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা যে কোনো ভাবে যদি এমন পর্যায়ে কমে যায়, যাতে হার্ট শরীরের প্রয়োজনীয় পরিমাণ রক্ত সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় তখন উপরোক্ত অবস্থাকে হার্ট ফেইলুর বলা হয়। বহুবিধ কারণে হার্ট ফেইলুর হয়ে থাকে যেমন_ হার্ট দুর্বল হয়ে যাওয়া, শরীরের রক্ত প্রবাহের চাহিদা অত্যাধিক পরিমাণে বেড়ে যাওয়া এবং খুব বেশি রক্ত শূন্যতা, হার্ট ফেইলুরের অন্যতম তিনটি কারণ।
হার্ট দুর্বলের কারণ : যেমন হার্ট অ্যাটাক, হার্টের ভাল্বের সমস্যা, হার্টের মাংসপেশী দুর্বল হয়ে যাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এসব কারণে হার্ট দুর্বল হয়ে যেতে পারে। কারণ সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ (হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীর রোগ)-৬০%, তারপর উচ্চ রক্তচাপ-১১%, ধূমপান-১৬%, হৃৎপিণ্ডে ভাল্বের সমস্যা (বাতজ্বরজনিত)-১২%।
ফেইলুরের উপসর্গ : সাধারণভাবে হার্ট ফেইলুর খুব ধীরে ধীরে হার্টের অবস্থার অবনতি ঘটায়, যার জন্য রোগী অনেক সময় পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে থাকে। এ অবস্থায় রোগীর হার্ট ফেইলুরের উপসর্গগুলো অনুভূত নাও হতে পারে। ধীরে ধীরে যে সব উপসর্গগুলো রোগীর শরীরে দেখা দেয় তা হচ্ছে শারীরিক দুর্বলতা অনুভূত হওয়া, অল্প পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া, পরবর্তীতে স্বাভাবিক কাজকর্মে ক্লান্তি বোধ করা এবং অবশেষে অল্প পরিশ্রমে রোগী ক্লান্ত হয়ে যাওয়া। রোগীর শ্বাসকষ্ট হওয়া আরেকটি উপসর্গ। প্রাথমিক অবস্থায় রাতে শোয়ার সময় শ্বাসকষ্ট হওয়া তার সঙ্গে হালকা কাঁশি থাকতে পারে।
অনেক সময় ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে যার ফলে রোগীর ঘুম ভেঙে যায়। রোগী ঘুম থেকে উঠে বসে যায়, অনেকে শ্বাসকষ্টের জন্য ঘরের জানালা খোলে বসে থাকে।
বুক ধড়ফড় করা : রোগীরা প্রায়ই বুক ধড়ফড়ের কথা বলে থাকে, পরিশ্রমের সময় বুক ধড়ফড় বেড়ে যায়।
শরীরে পানি জমে যাওয়া : প্রাথমিক অবস্থায় রোগীর পেটে পানি জমতে থাকে। পেটে পানি জমার জন্য রোগীর পেট ফেঁপে যায়, হজমে সমস্যা দেখা দেয়, অল্প খেলে পেট ভরে যায়, ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়, পেটে অত্যাধিক গ্যাস উৎপন্ন হয়ে থাকে।
হার্ট ফেইলুরের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর হাত, পা ও মুখে পানি জমে_ হাত, পা ও মুখ ফুলে যায়। দ্রম্নত রোগীর শারীরিক ওজন বাড়তে থাকে। এসব উপসর্গের সঙ্গে সঙ্গে রোগীর প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়। হার্ট ফেইলুরের তীব্রতা আরও বেশি বাড়লে রোগীর ফুসফুসে পানি জমে যেতে পারে, হার্টের চতুর্দিকেও পানি জমে যেতে পারে, এমতাবস্থায় রোগী সারাক্ষণ শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকে, রোগীর চলাফেরা উঠা-বসা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। যদি হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীর অসুখের জন্য হার্ট ফেইলুর হয়ে থাকে তবে হার্ট ফেইলুরের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে রোগীর বুকে ব্যথার তীব্রতা বাড়ে।
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা : হার্ট ফেইলুরের কারণ নির্ণয় হলো_ তীব্রতা নির্ধারণের জন্য, জটিলতা দেখার জন্য এবং সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। যেমন_ ইসিজি, বুকের এঙ্রে, ইকোকার্ডিওগ্রাম, রক্তে লবণের পরিমাণ নির্ধারণ, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, সিরাম ক্রিয়েটিনিন, রক্তে চর্বির পরিমাণ নির্ধারণ (লিপিড প্রোফাইল), রক্তের শর্করা নির্ণয় (ব্লাড সুগার), ইটিটি ইত্যাদি।
চিকিৎসা : খাদ্যে লবণ গ্রহণের পরিমাণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসা। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা; এর সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রোগীর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা। যেমন_ হালকা ব্যায়াম, যোগব্যায়াম, ব্রিদিং এঙ্ারসাইজ (শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম) ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ এবং হার্ট ফেইলুরের জন্য মেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করা।
যার জন্য অবশ্যই কার্ডিওলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে খুব অল্প সংখ্যক রোগী ছাড়া বাকিদের হার্ট ফেইলুর কোনো চিকিৎসার মাধ্যমেই সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব হয় না। তবে আশার কথা হলো সুচিকিৎসার মাধ্যমে হার্ট ফেইলুর নিয়ন্ত্রণে রেখে রোগী তার স্বাভাবিক জীবন যাপন অব্যাহত রাখতে পারেন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল
কলেজ ও হাসপাতাল। ফোন : ০১৯৭১-৫৬৫৭৬১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।