পেশা তাদের মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা। মূলত সাজার মেয়াদ কমানোর আশায় একজন অপরাধী বন্দী থেকে 'জল্লাদ' হয়ে ওঠেন। তবে জল্লাদ হলেও আসামিদের মতো চার দেয়ালের মধ্যে থেকেই অন্য আসামির মতো নিয়ম মেনে চলতে হয় তাদের। কিন্তু পেশার কারণে হোক আর অন্য যে কারণেই হোক একজন জল্লাদকে নিয়ে সাধারণের মধ্যে কোনো সহানুভূতি নেই। জীবনের পুরোটাই জেলে কেটে যাওয়ায় নতুন করে আর বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন না জল্লাদরাও।
অভিযুক্ত কয়েদিদের মৃত্যুদণ্ড ফাঁসিতে যেসব দেশে কার্যকর হয় এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কেন্দ্রীয় ছাড়াও অন্য কারাগারগুলোয় ফাঁসি দেওয়ার জন্য আছেন কয়েক ডজন জল্লাদ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জল্লাদরা হলেন নরসিংদীর শাহজাহান ভূঁইয়া, কঙ্বাজারের বাবুল মিয়া (মুক্ত), সাভারের কালু মিয়া, গোপালগঞ্জের শেখ মো. কামরুজ্জামান ফারুক, ঢাকার মো. মাসুম, মনির হোসেন প্রমুখ। কারাগারে কীভাবে কাটছে জল্লাদদের জীবন- জানতে চাইলে কয়েকজন মানবাধিকার কর্মী, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ কর্মকর্তা এবং ছাড়া পাওয়া জল্লাদরা জানান, কারাগার থেকে বন্দীদের জন্য সাধারণত যে ধরনের খাবার দেওয়ার কথা তা দেওয়া হচ্ছে না। মোটা চালের ভাতে প্রায়ই ইটের খোয়া পাওয়া যায়।
এ ছাড়া ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বন্দী রাখার কারণে এখানকার বাসিন্দাদের গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। হাজার হাজার বন্দীর পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নাজুক। ফলে কারাগারে পানির অভাব লেগেই থাকে। এ ছাড়া কারাগারে প্রতি মুহূর্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। খুনের দায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ভাগ্যবান বাবুল মিয়া জল্লাদের দায়িত্ব পালন শেষে এখন মুক্ত।
তিনি জানান একজন অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করার প্রস্তাবের মাধ্যমে দুই মাসের সাজা কমানোর প্রস্তাবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জল্লাদ হন। বাবুল জানান, ফাঁসি কার্যকরের প্রতিটি ঘটনায় কষ্ট পেলেও ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের ফাঁসি কার্যকরের সময় তার ডাক পড়ে। এ ঘটনায় তিনি খুশি হয়েছিলেন। সে সময় সাবেক পাঁচ সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিলেন তিনি।
তবে বাবুলের মতো ভাগ্যবান নন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া।
তিন দশকের বেশি সময় কারাগারেই কেটেছে তার। তিনি দেশের কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানীর ফাঁসি কার্যকর করেছেন। তিনি এক রাতে দুই কারাগারে চারজন আসামিকে ফাঁসি দিয়েছেন। শাহজাহানের নামে ৩৬টি মামলা হয়। এই আসামি ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ১৭ বছর হাজতি হিসেবে কারাগারে থাকেন।
'৯৫ সালে তার সাজা হয় ১৪৮ বছরের। পরে ১০০ বছর মাফ করে তাকে ৪৩ বছরের জেল দেওয়া হয়। সেই হিসেবে শাহজাহান বের হবেন ২০৩৫ সালে। সে সময় তার বয়স হবে ৮৫। কিন্তু শাহজাহান ভাবছেন এত দিন তিনি বাঁচবেন তো? জল্লাদ হিসেবে কাজ করলে সাজার সময় কিছু দিনের জন্য কম হবে।
সে কারণে জেল সুপারের কাছে জল্লাদের খাতায় নাম লেখানোর জন্য শাহজাহান আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯৮৯ সালে প্রথম এক অপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে তার জল্লাদ জীবনের শুরু। শাহজাহানের যোগ্যতা দেখে তাকে জেল কর্তৃপক্ষ ১৯৯৭ সালে প্রধান জল্লাদের দায়িত্ব দেয়।
সাধারণত একটি ফাঁসি দিতে প্রধান জল্লাদের সঙ্গে ছয়জন সহযোগী লাগে এবং ফাঁসির রায় কার্যকর করলে প্রত্যেক জল্লাদের ২ মাস ৪ দিন কারাদণ্ড মওকুফ করা হয়। এ ছাড়া কারাগারে যারা জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকেন কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রধান জল্লাদ তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
শাহজাহানের মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। তিন বোন থাকলেও তারা তাকে দেখতে আসেন না। জেলে তিনি 'জল্লাদ শাহজাহান' নামেই পরিচিত। তার এ পরিচয় লেখা তার ব্যবহৃত জগ, বালতি ও প্লেটে। তিনি নতুন হাজতিদের থাকা-খাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা করে থাকেন।
এর বিনিময়ে তিনি টাকা পান। এতে আরাম-আয়েশ করেন তিনি। তবে এ টাকার ভাগ পান সিট বিক্রেতা, সুবেদার, জমাদার, জেলারও। এ টাকা ভাগের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়ে তিনি ভালো কিছু সবজি কিনে খান। বর্তমানে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দায়িত্বে আছেন।
ভোর ৬টার আগে 'ফাইল'-এ অংশগ্রহণের জন্য ঘুম থেকে ওঠেন। নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা ২২ জনকে নিজ হাতে বেড়ে নাশতা ও দুপুর-রাতের খাবার খাওয়ান। দুপুরে কোনো কাজ থাকলে করেন না হলে ঘুরে বেড়ান। বিকাল ৫টার আগে ঘরে ফিরে আসেন। রাতের খাওয়া শেষে ৬০ জনের ধারণ ক্ষমতার কক্ষে আড়াই শ জনের বেশি মানুষ নিয়ে ঘুমান।
সম্ভব হলে এই জল্লাদ রাতে বিটিভির খবর দেখেন। না হলে রেডিওতে নিয়মিত রাত সাড়ে ১০টার বিবিসির খবর শোনেন। রাতে ঘুম না হলে দাবা অথবা তাস খেলে সময় কাটান। কখনো রেডিওতে গান শোনেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।