আমার খুব কষ্ট হয়, যখন RAJAKAR বানানটা বাংলা বর্ণমালায় লিখা হয়। এটা বর্ণমালার জন্য অপমান।
ডোন্টমাইন্ড ফ্যামিলি (পূর্বাংশ)
আমরা সবাই একসাথে তাকালাম মোসাদ্দেক ভাইয়ের দিকে।
তিনি কিছুটা দ্বিধা করছেন বলতে, পাছে কেউ হেসে ফেলে কিনা। এক কান চুলকানো নিয়ে সবার সামনে যেভাবে আইটেম হয়েছেন, তাই এই বাড়তি সাবধানতা।
-'তাড়াতাড়ি বল', তাড়া দিলেন খালেদ ভাই।
খালেদ ভাইকেও কিছুটা বিব্রত মনে হচ্ছে। আসলে উনার সোর্সেই এখানে আসা। তার উপর আমরা ফার্স্ট ইয়ারের কয়েকজন থাকাতে, উনার বিব্রতভাবটা যেন কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গিয়েছে। আর আমাদের কথা বলতে হলে, আমরা ব্যাপারটা বেশ উপভোগই করছি! নো টেনশন।
তিনজন সিনিওর আছেন, সুতরাং অনায়াসে আমরা একটা এ্যাডভেঞ্চার এ্যাডভেঞ্চার ভাব নিতে পারি। হু কেয়ার্স? "ছুঁড়েছ কলসীর কানা, তাই বলে কি প্রেম দিবনা?"
যাই হোক, মোসাদ্দেক ভাইয়ের দিকে মনযোগ দিলাম। তিনি প্রস্তাবটা করলেন একটু নাটকীয় ভাবে।
-'প্রথমতঃ যেহেতু আমরা একটা সম্ভ্রান্ত ও প্রতাপশালী পরিবারে দাওয়াত খেতে এসেছি, সেহেতু হিসেবমতে এই এলাকায় আর কোন বিয়ে থাকা উচিৎ না। '
সিদ্ধান্তঃ এই গ্রামে একটাই বিয়ে বাড়ি।
-'বলে যা'; গাল চুলকালেন খালেদ ভাই। উনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে মোসাদ্দেক ভাইয়ের কথা তিনি এক্কেবারে ফেলে দিতে পারছেন না।
মোসাদ্দেক ভাই বলছেন,
-'যেহেতু বিয়ে বাড়ি, সেহেতু আলোকসজ্জা থাকবেই। সুতরাং আমরা আলোর উৎস খোঁজার মিশনে নামতে পারি। আর খুঁজে যদি নাও পাই, ক্ষতি নেই, অন্ততঃ সারারাত স্টেশনে বসে থাকার চেয়ে তো ভালো! খুঁজে খুঁজে রাত পার করে ভোরের ট্রেনে চলে যাব।
'
কথা শেষ করে তিনি সবার মুখের দিকে তাকালেন। বুঝলেন প্রস্তাবটা সবার মনে ধরেছে। সুতরাং, তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হন্টন শুরু করলেন কাউকে কিছু জিগ্যেস না করেই। একসময় লক্ষ্য করলাম, আমরা সবাই উনার পেছন পেছন হাঁটছি।
মরিচবাতির নাচনটা প্রথম দেখল সম্ভবত তুহিন।
-'ভাই, লাইট দেখা যাইতাছে'!
আমরা সবাই আনমনে হাঁটছিলাম। প্রায় ঘন্টা দেড়েক হাঁটার পর, যখন পা চলতে চাইছেনা, তখনই তুহিন কলম্বাসের মত আবিষ্কার করে ফেলল বিয়ে বাড়ি। আমাদের আনন্দ আর দেখে কে! ভাবটা এই, বিয়ের দাওয়াত খেতে যখন এসেছি, যেকোন দাওয়াতেই আমাদের রূচির অভাব নেই! এটা প্রত্যাশিত বাড়ি হোক কিংবা অন্য কারো বাড়ি হোক, বিয়ে বাড়ি-এটাই আপাতত ধ্রুবসত্য। আমরা পা চালালাম।
বাড়িটা নিরব।
মনে হয় সারাদিনের ক্লান্তি শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। দরজায় নক করছি, অথচ কেউ খুলছেনা।
-'এটা বিয়ে বাড়ি নাকি মড়া বাড়ি'! বিস্ময় প্রকাশ করলেন মোসাদ্দেক ভাই।
'বিয়ে বাড়ি থাকবে হুলুস্থুল, এদের মধ্যে শিল্প নাই! ম্যাড়ম্যাড়া। '
এমন সময় দরজা খুললো।
দরজার পিছনে কয়েক জনের মাথা উকি দিচ্ছে। সামনের জনের হাতে আবার লাঠি।
-'কাকে চাই'?
-'এটা কি শাহীন দের বাড়ি'?
প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই ভেতর থেকে মহিলা কন্ঠের চিৎকার, 'ওরে দরজা খুলিস না, ডাকাত পড়ছে'।
(বলা বাহুল্য, কথোপকথনটা সিলেটি ভাষায় হচ্ছে। বোঝার সুবিধার্থে কথ্য ভাষায়ই লিখলাম।
)
আমাদের তো আক্কেলগুড়ুম! ডাকাত, আমরা ডাকাত! নিজেদের দিকে তাকালাম। সারাদিন ক্লাস করে এক কাপড়ে চলে এসেছি সবাই। ট্রেন জার্নি, হাঁটা এসব কিছু মিলে চেহারার ভদ্রভাবটা উবে গিয়েছে কবেই! মোসাদ্দেক ভাই প্রায় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা, ওজন ৯৬ কেজি, বাশার ভাই যাকে কালো বললে ক্ষেপে যেতেন বলে আমরা ব্ল্যাক ডায়মন্ড ডাকতাম, খালেদ ভাই, আমি-সবারই বিধ্বস্ত অবস্থা...হঠাৎ মনে হল, কেউ যদি আমাদের ডাকাত ভাবেই, তা প্রোটেস্ট করার মত চেহারা কিংবা পোশাক আমাদের নেই। সুতরাং গণপিটুনি কপালে নিশ্চিত!
পেছনে তাকালাম, প্রতিবেশিরা সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। তারমানে পালানোর রাস্তা বন্ধ।
-শাহীন কে চিনেন কিভাবে?
খালেদ ভাই তার লতানো পরিচয় দেবার চেষ্টা করলেন। উনারা সেই পরিচয় চিনলেন না কিংবা চেনার চেষ্টা করলেন না। বললেন,
-শাহীন তো নেই। ও ঢাকায়।
-ওর কাছে ফোন করা যাবেনা?
-ওর বাসার ফোন নষ্ট।
আমরা হাল ছেড়ে দিলাম। বললাম অনেকটা কাতর স্বরেই, 'আমরা খুব ক্লান্ত, একটু থাকার ব্যবস্থা করতে পারবেন'?
-'না। আপনাদের তো চিনিনা। ডাকাতও তো হতে পারেন! থাকার যায়গা হবেনা। ভালোয় ভালোয় চলে যান'।
আমাদের ধড়ে পানি এলো। যাক, চলে যাওয়ার অনুমতি মিলেছে যখন, অন্তত পিঠ বাঁচাই! মনে মনে সেই পেইন রেলস্টেশনটাকে মনে হচ্ছে এখন শেরাটনের লবি। ওখানে যেতে পারলেই বাঁচি! হায়রে দাওয়াত!
চলে আসছিলাম যখন, পেছন থেকে একজন ডাকল,
-'শুনুন, আপনারা কি সিলেট থেকে আসছেন'?
-মোসাদ্দেক ভাই বললেন, হ ভাই। আমরা ডাকাইত না। আমাদের দেখে কি ডাকাইত মনে হয়?
-লোকটা হেসে ফেলল।
বলল, 'শাহীন বলেছিল ওর কিছু বন্ধু আসবে। হঠাৎ বিয়ের কাজেই ওকে ঢাকা যেতে হল বলে, আপনাদের নাম পরিচয় কিছু বলে যেতে পারেনি আমাদের কাছে। বুঝতেই পারছেন, চিনিনা যেহেতু, এটুকু সাবধানতা আমাদের নিতেই হবে। '
-'আমরা তো চইলাই যাইতাছি! তারপরও এতো কথা কেন ভাই? আল্লাহ ওদের সংসার সুখের করুক!' মোসাদ্দেক ভাই উনার অভিমান নিয়ে বললেন। '
-লোকটা বললো, আসুন, এতোরাত্রে কোথায় যাবেন? কমিউনিটি সেন্টারে সোফা আছে, মাদুর আছে, কষ্ট করে রাতটা পার করুন।
দুপুরের দিকেই শাহীন চলে আসবে।
এতো ক্লান্ত ছিলাম, তারও মধ্যে 'ডোন্টমাইন্ড ফ্যামিলি'-বেহায়ার মত প্রস্তাবটা নিলাম। কমিউনিটি সেন্টারে গেলাম উনার সাথে। প্রথমে বুঝতে পারিনি। আমাদের ভেতরে রেখে তিনি যখন বাইরে থেকে তালা আটকে দিলেন, তখন টের পেলাম, আমরা আসলে অতিথি নই, বন্দী।
নিজেদের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি দেয়া ছাড়া কিছু করার ছিলনা। সে যাই হোক, জেল হোক আর যাই হোক আশ্রয় তো মিললো! অনিবার্য নির্যাতনটাকে উপভোগ্য করে তোলার জন্য আমরা তখন নিজেদের অভিযোজন করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কি আর করা!
বাশার ভাই ব্যাগ থেকে প্লেয়িং কার্ড বের করলেন। এরমধ্যে আমরা কমিউনিটি সেন্টারের প্রায় সব ক'টি পর্দা খুলে মেঝেতে বিছিয়েছি। সোফার কুশন গুলোকে বালিশ বানিয়ে মোটামুটি রাজকীয় ভাবে নিয়ে এসেছি।
প্রচন্ড ক্ষিধে লেগেছে। সেই ক্ষিধে ভোলার জন্য অনবরত সিগারেট টানছি। এমন সময় হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামলো। সেন্টারের ভেতর দিকে উঁচু পাঁচিল ঘেরা একটা ছোট্ট খোলা যায়গা, আমরা সবাই সেখানে গিয়ে ইচ্ছেমত ভিজলাম।
(এই ফাঁকে একটা কথা বলে রাখি, আমি বাংলাদেশের যেখানেই গিয়েছি, চেষ্টা করেছি সেখানকার বৃষ্টি ভেজার অভিজ্ঞতাটা নিতে।
এমনিতেই কৌতুহলে। আমার সব বৃষ্টি ভেজার অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বলতে পারি-সিলেটের বৃষ্টির মত এতো স্বচ্ছ, নির্মল আর ব্যাক্তিত্ববান বৃষ্টি আমি আর কোথাও পাইনি। )
যাই হোক, ভেজার পর একটু আগের গ্লানিরা সব ঝেঁটিয়ে বিদেয় হয়েছে। খুব ভালো লাগছে। ফ্রেশ।
ভেতরে এসে দেখি, বাশার ভাই অভাবনীয় কাজ করে ফেলেছেন। কমিউনিটি সেন্টার তন্ন তন্ন করে খুঁজে, লেবার দের জন্য ফ্রিজে রাখা ২টা আস্ত মুরগির রোস্ট আর প্রায় আধাডিশ পোলাও খুঁজে বের করেছেন। সোনায় সোহাগা! তারপরের ২টা মিনিটের বর্ণনা দিতে পারবনা, কিন্তু ২ মিনিট পরের কথা বলতে পারি; সেখানে বেড়ালকে খাওয়ানোর জন্যও এমনকি একটুকরো হাড়ও ছিলনা।
কিছুক্ষণ কার্ড খেলে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম। খুব কম সময় ঘুমিয়েছি, অথচ এতো গাঢ় ঘুম...মনে হল এমনটা অনেকদিন ঘুমাইনি।
আমাদের কষ্টার্জিত ঘুম!
ঘুম ভাঙ্গলো আশ্রয় দাতা সেই ভদ্রলোকের ডাকে।
-'আসুন, আপনাদের নাস্তার জন্য রুটি কাবাব করা হয়েছে। বাড়িতে চলুন।
মোসাদ্দেক ভাই দুদিনের চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা সশব্দে ছেড়ে বললেনঃ
-অতঃপর আমরা আমাদের হারানো সম্ভ্রম ফিরিয়া পাইলাম। লে হালুয়া'!
আমরা হৈ হৈ করতে করতে নাস্তা খেতে গেলাম।
ডোন্টমাইন্ড ফ্যামিলি না!
নাস্তা খেয়ে সোজা রেললাইন ধরে হেঁটে কুশিয়ারা'র পারে। নদীর উপর বাঁশের ভেলা; তার পিঠে সওয়ার আমরা ক'জন। বসে আছি, এমন সময়
মাইজগাঁও(ফেঞ্চুগঞ্জ) সেতুর উপর দিয়ে যাওয়া ট্রেনটার দিকে আঙ্গুল তুললেন মোসাদ্দেক ভাই। ট্রেন যখন মাঝ সেতুতে, তখন তিনি আঙ্গুলের ট্রিগার টেনে দিলেন। হিসেবমত ব্রীজটা তখন বিকট শব্দে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ার কথা, কিন্তু তার বদলে গগনবিদারী অট্টহাসি শোনা গেল।
বিরক্ত চোখে তাকালেন মোসাদ্দেক ভাই;
-'দিলি তো টার্গেট নষ্ট কইরা!'
এই বলে আঙ্গুলে ফুঁ দিয়ে ধোয়া সরালেন। হাতটা কেতাবী ভঙ্গিতে পকেটে ঢুকিয়ে উদাস হয়ে গেলেন। পেছনের হাসির রোল তখনো থামেনি। কুশিয়ারা নদীর উপর ভাসতে থাকা বাঁশের এই ভেলাটার উপর বসে সাত তরুণ যেন মিশে গিয়েছিল ঢেউয়ের সাথে। পলাশ, তুহিন, সজীব, সাইফুল, খালেদ (ভাই), মোসাদ্দেক (ভাই), বাশার (ভাই)।
সদ্য নদী থেকে স্নান করে ওঠা এদের কয়েকজনকে দেখে বোঝাই যাচ্ছেনা গত রাতের ক্লান্তির কথা।
(আগ্রহী পাঠক আবার প্রথম পর্ব থেকে পড়া শুরু করতে পারেন। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।