অশরিরী আলোর তীব্র অপেক্ষায় পার করি প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ড !!!
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৩ এর সারাদিন টিই ছিল একদম সাধারন আর দশটা দিনের মত। ক্লাস শেষ করে কম্পিটিশনের প্রস্ততিতে আমার তখন অন্য কিছু ভাববার সময় নেই। তারি ফাঁকে ক্লাসের সপ্তাহান্তের রিপোর্ট তৈরী করে আমি কম্পিটিশন রুমে আড্ডায় ব্যস্ত। হঠাৎই চোখে পড়ল তোমাকে। ধবধবে সাদা কাঁচের চশমার ফাঁক দিয়ে বারবার তুমি ধরে পড়ছিলে আমার কাছে।
তুমি আগ বাড়িয়ে কথা না বললে হয়তো হত না আমাদের কথোপকথন।
তারপর সময় যত গড়িয়েছে, আমাদের কথোপকথন তত গভীরতর হয়েছে। তার সাথে সাথে নীরবতা আমাদের গ্রাস করেছে। অন্ধকারের ভেতরে জড়াজরি করে আমরা ঢুকে গেছি। আর সেখান থেকে বেড়িয়ে আরো গভীরতর হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছি।
দেখা হওয়ার পর থেকেই আমি খুঁজে বড়াতাম আমাদের মিল আর অমিল গুলো। সবকিছু তোমার সাথে এতটাই কাকতালীয় ভাবে মিলে যেত তোমার সাথে যে আমার সেই দূরন্ত কৈশোর, মনের অজান্তেই তোমার নেশায় বুদ হয়ে থাকত সারাক্ষন। আমি বুঝতাম না তোমার অনুভুতিগুলোও আমার মতই ছিল। তবে যখন তুমি সরাসরি এসে ধরা দিলে তখন আমি দু চোখ বুজে কল্পনা করতাম অতি প্রেমময় কোন ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ এ বসে আমি আর অঙ্কের হিসাব মিলাতে পারিনা।
আমি বরাবর ই অঙ্কে কাঁচা হয়তো সে কারনেই সেই সমীকরন আমার কাছে দূর্বোধ্য লাগে। আমি মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলি, নোনতা জলের সমুদ্রে গা ভাসিয়ে অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করি। কল্পনা করতে পারি, সহজ সেই অঙ্ক মিলিয়ে, সব শোধ বোধের পালা শেষ করে তুমি মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকো। মাঝে মাঝে উঁকি মেরে হয়তো সবাই কে দেখো,আমাকেও দেখো, কিন্তু আমার আর দেখা হয় না। প্রবল স্রোতের প্রতিকূলে আমি তীরে ফেরার কঠোর সাধনায় মগ্ন।
মনে আছে সেই সন্ধ্যার কথা?আকাশে মেঘ আর হালকা বৃষ্টির সেই গোধুলীর কথা?বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার আর আমার শোবার ঘরে তখন জলছিল না লাল না কমলা ধরনের বাতি। তোমার ছায়াটা তোমার থেকেও বড় লাগছিল তখন আর সেই সন্ধ্যায় সমস্ত স্বর্গসুখ যেন নেমে এসেছিল ওই ঘরটাতে, তোমাকে মুহুর্মুহূ আলিঙ্গন করে সেই সন্ধ্যাটাকে আমি পাহাড় সমান উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস কর, ওরকম মোহময়, আলোকিত কিংবা প্রেমময় যাই বল, সেরকম দ্বিতীয় কোন সন্ধ্যা আর আসেনি।
পেন্সিলে লেখা আমার জীবনে পাওয়া প্রথম প্রেমপত্রটি আমার কাছে এখনো বাইবেলের মতন পবিত্র। আজ এত বছরেও ভূমিকম্প আশংকার শহরে বাস করেও আমি বুকের কাছে আগলে রেখেছি।
প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আমাকে এখনো উদাসী করে, হাসায়, কাদায়, মাঝে মাঝে কল্পনার জগৎ তৈরী করে সেখান থেকে আমাকে ঘুরিয়ে আনে। কত শক্তিমান ছিল তোমার প্রতিটি শব্দ, ভেবে দেখেছ?
আমার চোখ দিয়ে পেরেছি কিনা জানিনা, তবে তোমার চোখ দিয়ে আমি পুরো একটা পৃথিবী দেখেছি। কিছু ছন্দোবদ্ধ কবিতা শুনেছি। সেলুলয়েডে একটার পর একটা দৃশ্য দেখে তোমার হাতে আমার সাধারন হাতটা রেখে তোমার কাঁধে নিশ্বাস ফেলেছি। কিছু যাদুকরী গান শুনেছি, যার সুর আমাকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে।
আর সবকিছুই আমাকে অনেক শান্ত, বাকরুদ্ধ করতে পারে।
মনে আছে আমাকে নিয়ে একবার ফুল কিনতে গেলে? সাতটা তরতাজা গোলাপ দেখে আমি ভাবছিলাম এ ফুল বুঝি আমার জন্য তোমার অর্ঘ্য, কিন্তু আড়াল থেকে একটা মৃতপ্রায় গোলাপ আমার হাতে দিয়ে অন্য কারো জন্য আগলে রেখেছিলে সাতটি গোলাপ। হঠাৎ করেই কষ্টের মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল মন, তারপরও মৃতপ্রায় সেই জীব টাকে বাঁচাবার আমার অনেক চেষ্টাই বৃথা গিয়েছিল। চলে যে যেতে চায়, তাকে কি বেধে রাখা যায় বল?
তোমার কাছে শুনে কলেজের প্রথম পরীক্ষার রাতে জেগে জেগে “সাতকাহন” উপন্যাসটা পড়েছিলাম। দীপাবলী’র মত করে কষ্টগুলো আমাকেও পীড়া দিয়েছিল।
কিন্তু আজ বুঝি দীপাবলী’র কষ্টগুলো আমার মতই। পার্থক্য এখানেই যে ও মেয়ে আর আমি ছেলে।
মনে আছে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর আমাদের সেই সন্ধ্যার কথা? তোমার আবদারে, তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম শহর থেকে দূরে এক নদীর ধারে। সেই নদীর ওপর শতবর্ষী ব্রীজ যখন আমরা পার হই,হৈ হৈ রৈ রৈ করে সে কি বৃষ্টি! তোমার হাত শক্ত করে ধরে, আমরা দৌড়ে পার হয়েছিলাম সেই অতিদীর্ঘ,লোহা কাঠের মিশেলে তৈরী ব্রীজটাকে। ভিজে চুপসে গিয়ে তোমাকে আমি আগলে রাখার প্রানান্তকর চেষ্টা করেছিলাম।
ফিরবার পথে বৃষ্টিতে ভেজা, কষ্টে পোড়া আর বিরহে কাতর আমি যখন তোমাকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিলাম তোমার তৈরী করা দেয়ালের গায়ে আঘাত পেয়ে আমি তখন রক্তাক্ত। তুমি বোধ হয় দেখনি, এ জন্যই আমার রক্তক্ষরন বাড়তে বাড়তে আমি মূমুর্ষ এক রোগীতে পরিণত হয়েছিলাম। তুমি আর আমাকে জাগানোর চেষ্টা করনি, বরং কায়মনে আমার মৃত্যু অথবা পঙ্গুত্ত্ব কামনা করছিলে।
এরপর ৪ বছর বাদে যখন কাকতালীয়ভাবে তোমার সাথে দেখা হল, সেই অমবস্যার রাতে ধানমন্ডি লেকের নোংরা পানিতেও আমি দেখছিলাম তোমার চোখের জল। মূহুর্তেই আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের নষ্ট অতীত।
জীবনের জোয়ারভাটা কে বিশ্বাস করে ফিরতে চেয়েছিলাম আমাদের নষ্ট নীড়ে। যেখানে এক সময় ভালোবাসা ছিল, সুখ ছিল, জীবনের অর্থ ছিল, যেখানে পৃথিবীর ভেতর আমাদের আরেকটা কল্পনার পৃথিবী ছিল। তোমার পরিবর্তন আমাকে আবার শৃঙ্খলিত করেছিল। তারপর কাটানো তোমার সাথে কয়েকদিন মুঠোফোনের ব্যালেন্সের মত কখন শেষ হতে লাগল জানি না, তবে তোমাকে আমি আবার আবিষ্কার করলাম কোন এক পুর্নিমার রাতে আমার বাহুবন্দি অবস্থায়। তারপর সমুদ্রের ঢেউ এর মত সারারাত প্রেম এল,স্বর্গের সব সুখ ঈশ্বর আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন কিন্তু রাতের হালকা অন্ধকার সরে যাবার পর আমার কাছে এক তীব্র পাপবোধ আমাকে কুন্ঠিত করল।
আমার সমস্ত ক্রোধ আমার নিজের দিকে প্রবল বেগে ধেয়ে আসছিল।
আমার আবারো ভুল ভাঙল, যখন তোমাকে আবার হারিয়ে ফেললাম। যে হাতে হাত রেখে ভুল স্বীকার করে ফিরে এসেছিলে, ক্ষনিক সময় আমার সাথে অভিনয় শেষে আবার ফিরে গেলে সেখানেই। ভুল অঙ্ক কষে আবারো অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম। তবে কি জানো(?), কিছু সমীকরন মিলে না, কিছু সমীকরন অসমাপ্তই রয়ে যায়।
আমাদের সেই গরল সমীকরনও আমি সমূদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছি। আমার সব ঘৃণা, অভিমান, তুলে রাখা অনুযোগ, আবদার সবকিছুই এখন কূলহীন সমূদ্রে। শুধু স্মৃতিকাতরতার উতল হাওয়ায় আমি মাঝে মাঝে ভাসি, হাল্কা বৃষ্টিতে ভিজি আর চলে যাবার আগে শেষ যে গান টি শুনিয়েছিলে, সেই গান টা শুনি।
♫♫♫"আমি চাঁদ নহি , চাঁদ নহি অভিশাপ ,
শুন্য গগনে আজো নিরাশায় আধারে করি বিলাপ "♫♫♫
© সাইক চৌধুরী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।