সব কিছুরই একটা শুরু আর শেষ থাকে। আবার সব শুরুর পেছনেই থাকে এক একটা নেপথ্য ইতিহাস। আমার লেখা সে তো জলের মতই সহজ, যাকিছু সব গড়গড় করে বলে দেওয়া। কাজেই আমার লেখার নেপথ্য ইতিহাসও তাই জলের মতই তরলং। শুধু আংশিক সত্য লেখার ক্ষেত্রে পাত্রপাত্রীর নামগুলোএকটু বদলে দেওয়া, এই যা।
কিন্তু অবাক হলাম কদিন আগে কাজী নজরুল ইসলামে কিছু গানের নেপথ্য ইতিহাস জেনে। খুব ছোটো থেকে রবীন্দ্রপ্রেমী হিসাবে খ্যাত আমি। সে আমার বাড়ির রবীন্দ্রমুখী আবহাওয়ার কারণেই হয়তোবা। তবে একটু বড় হবার সাথে সাথে আমি নজরুলের প্রেমেও পড়ে যেতে থাকি।
বিশেষ করে আমাদের কলেজের নং ওয়ান গায়ক-হিরো মিথুনভাইয়ার দরাজ কন্ঠে প্রথম যখন শুনি।
Click This Link
মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী , দেবো খোঁপায় তারার ফুল......
কর্ণে দুলাবো তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল......
আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে জ্যোস্নাস্নাত মায়াবী নীলাকাশ। যার জমিনে হাজারো রুপোলী তারার ঝিকিমিকি। নিঝুম রাত। বারান্দায় দাড়িয়ে একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা। প্রেমিকটি প্রেমিকাকে সাজিয়ে চলেছে অসম্ভব দূর্লভ কিছু মনোমোহিনী রুপকথাময় সাজ সজ্জায়।
যে সাজ ও সজ্জা ইহজগতে সহজ লভ্য নয়, সে শুধু রুপকথার রাজকুমারীদেরই প্রাপ্য। এমন সব দূর্লভ সাজেই যেন সাজিয়ে চলেছে সেই প্রেমিক প্রবর তার ভালোবাসার দেবীকে।
আমি সেসময় নজরুলের এই গানের মধ্য দিয়ে আর একটু হলে মিথুন ভাইয়ার প্রেমে পড়ে যাই আর কি । ভাগ্যিস রক্তচক্ষু মোনাআপা মিথুন ভাইয়াকে সদা ও সর্বদা পাহারা দিয়ে রাখতেন।
যাইহোক কদিন আগে জানলাম কাজী নজরুল ইসলামের এই গানটি লেখার আদি উৎসরুপ।
আব্বাসউদ্দীন তার 'আমার শিল্পী জীবনের কথা' বইটিতে লিখেছেন একদিন কবি ও আরো কয়েকজন শিল্পী গ্রামোফোন কম্পানীতে বসে গল্প করছিলেন। এমন সময় কথাচ্ছলে প্রশ্ন উঠলো যদি কেউ একলাখ টাকা লটারীতে পেয়ে যায় তবে কে কার প্রিয়াকে কেমন ভাবে সাজাবেন। কেউ কমলালয় স্টোর্সে যেতে চাইলেন, কেউ আবার সুইৎজারল্যান্ড। কিন্তু কবি খাতা কলম নিয়ে বসে গেলেন তার প্রিয়াকে সাজাতে। মুগ্ধ হলাম আমি এতদিন পরেও কবিমনের এ পরিচয় পেয়ে।
সত্যিই এ সাজ কি লক্ষ কোটী টাকাতেও হয়? হয়না । এ সাজের জন্য চাই একটি রুপকথা রুপকথা মন।
এবার বলি আমার মায়ের কথা। আমি যখন খুব ছোট তখন মাকে প্রায়ই হারমোনিয়াম বাজিয়ে বিকেলবেলা গান গাইতে দেখতাম ও শুনতাম। এর মাঝে দুটি গান আমার কখনও ভোলা হলোনা।
এক আমারও ঘরের মলিন দ্বীপালোকে
জল দেখেছি প্রিয় তোমারি চোখে।
খুব ছোট ছিলাম আমি কিন্তু গানটির বাণী আমার চোখে জল টলোমল সরবোর বানিয়ে দিতো।
আর একটি গান ছিলো-
আসে বসন্ত ফুলবনে সাজে বনভুমি সুন্দরী।
চরনে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুন্জরী।
গানটি শুনে আমার মত সবার মনেই নিশ্চয় এমনি একটি দৃশ্যই ফুটে ওঠে যে, ফুলমন্জরী বিভুষিত বনভুমিতে নুপুর পায়ে রুমঝুম নেচে চলেছে কোনো রুপসী অথবা কোনো ছায়া ছায়া রহস্যে ঘেরা অপরুপা বনদেবী।
যাকে দেখা যায়না চর্মচক্ষুতে, ছোঁয়াও যায়না, শুধু মনের চোখে পুরো বনভুমি জুড়েই অনুভব করা যায়।
Click This Link
আশ্চর্য্যের বিষয় হলো গানটির আদি ইতিহাসও ঠিক এমনটাই। ১৯৩৩ সালে অগ্রহায়নের এক সন্ধ্যায় মিশরীয় নর্তকী মিস ফরিদা আলফ্রেড রঙ্গমন্চে নাচ দেখাতে আসেন। উর্দূ গজল 'কিস কি খায়রো ম্যায় নাজনে,কবরো মে দিল হিলা দিয়া' গানটির সাথে নাচটি নজরুলের মনে যে ভাবের সন্চার করে তারি প্রতিফলন এই 'আসে বসন্ত ফুলবনে' গানটি। আসলেই তো চোখের সামনে গানের মধ্য দিয়ে নেচে যায় রঙ্গমন্চের সেই মনমোহিনী নর্তকী।
মন্চ তার পুরো ফুলভুমি সজ্জিত বনতল। বিমোহিত করে তার রুপ ও নৃত্যের ছন্দে আমাকেও চুপিচুপি।
আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। আন্তঃজেলা প্রতিযোগিতায় কি করে যেন নৃত্য বিভাগে প্রথম হয়ে গেলাম। নাচের গানটি ছিলো স্নিগ্ধ শ্যাম বেণী বর্ণা , এসো মালবিকা।
গানটি এখনও যখন রেডিও টিভিতে বাজে আমার চোখে ঘোর ঘনায়। আমি এক নিমিষে ফিরে যাই সেই ছোট্ট বেলার নৃত্য মন্চে। ধুপ জ্বালা ধোয়া ধোয়া সেই আলোছায়া। চোখ জ্বলে যাচ্ছিলো তবুও এক অপার্থীব ঘোরের মাঝেই নেচে চলেছিলাম সেদিন। নকল চুল জোড়া দিয়ে ইয়া বড় এক বেনী ।
কানে গুঁজে দেওয়া একগোছা গন্ধরাজ ফুল আর নীল মেঘরঙ শাড়ী। মা সাজিয়ে দিয়েছিলেন সব। আমি মনে হয় মেঘের দেশেই চলে গিয়েছিলাম সেদিন হতে । আজও ফিরিনি ।
এই গানটার আদি ইতিহাসটা মাঝে মাঝে আমার আরেক প্রিয় বৃষ্টি প্রেমি প্রিয় বন্ধুর ভাবাবেগের সাথে মিলে মিশে যায় মানে তার বৃষ্টি প্রেম আর সেই নিয়ে কাব্য রচনার গল্প শুনে শুনে।
সে যাই হোক, ইতিহাসটা বলি, একদিন জৈষ্ঠের এক শেষ বিকেলে আকাশ কালো করে মেঘ জমে উঠলো। গ্রামোফোন রুমের হৈহুল্লোড়ের মধ্যে এক মুহূর্তে কবি গম্ভীর হয়ে গেলেন। অল্পক্ষনের মধ্যেই লিখে ফেললেন এই অপূর্ব গানটি । আসন্ন বর্ষার আহ্বান গীতি। সঙ্গে সঙ্গে সূরোযোজিত হলো।
১৩৪০ সালের পৌষ সংখ্যায় গানটি প্রকাশিত হয় ও পরে 'গানের মালা' গ্রন্থে সংকলিত হয়।
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই
কেনো মনে রাখো তারে?
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে....
কুমিল্লার দৌলতপুর নিবাসী আলী আকবার খানের ভাগ্নী নার্গিস খানমের সাথে নজরুলের বিয়ে হয়েছিলো ১৩২৮ সালের ৩ আষাঢ়। এ বিয়ে সফল হয়নি একেবারেই। বিয়ের দিন রাতেই কবি পায়ে হেটে চলে আসেন সে বাড়ি হতে। এরপর তার সাথে কবির আর দেখা হয়নি তবে ষোলো বছর পরে নার্গিস কবিকে একখানি চিঠি লিখেন।
১০৬ আপার চিৎপুর রোডে গ্রামোফোন কম্পানীর রিহার্সেল রুমে বসে বন্ধু শৈলজানন্দ মুখপাধ্যায়কে কবি চিঠিখানি পড়তে দেন। বন্ধুর অনুরোধে কবি চিঠিখানির উত্তর লিখতে গিয়ে লিখে ফেলেন এই গানটি।
Click This Link
একদিন একজনের চিঠির উত্তরে আমারও এই গানটিকেই লিখে দিতে ইচ্ছে হয়েছিলো সে চিঠির যোগ্য উত্তর হিসেবে। তখন আমি অবশ্য জানতাম না এ গানের পেছনের ইতিহাস।
দারুন পিপাসায় মায়া মরীচিকায়....
চাহিতে এলি জল বনের হরিণী
দগ্ধ মরুতল, কে তোরে দেবে জল,
ঝরিবে আঁখি নীর তোরই নিশিদিনই।
শান্তিপদ সিংহের সাথে একদিন বিকেলে মনোমোহন থিয়েটারে যাবার সময় ইন্টালী মার্কেটের কাছে এক অপরুপা রুপসী ভিখারিনীকে দেখে কবি অবাক হয়। শান্তিপদ জানান এক বড় পুলিশ অফিসারের ছেলের প্রেমে পড়ে মেয়েটি ঘরছাড়া। মেয়েটির ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া আর এখন কিছুই করার নেই।
কবির মন ব্যাথায় মুচড়ে ওঠে । সেদিন রাতে ঘরে ফিরেই তিনি রচনা করেন এই গানটি।
কেন তুই বনফুল, বিলাস কাননে করিয়া পথভুল এলি অকারণে...
সন্ধ্যা গোধুলীর রাঙা রুপে ভুলি আসিলি এ কোথায় তমসার কূলে...
আমার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে আর সাথে লেখাটাও অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। মাত্র পাঁচটা গানের নেপথ্য ইতিহাস লিখতেই এই অবস্থা! আরো অন্যান্য গানের ইতিহাস লিখতে গেলে তো দিন পেরিয়ে রাত ভোর হবে। থাক বাবা আজকের মত এতটুকুই থাকুক। অন্য কখনও আবার জানা যাবে অন্য ইতিহাস অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।