আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: সিঙ্গিং ইন দ্যা রেইন

সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...

পুশ/পুল নির্বাচনের বরাবরের সঙ্কট উৎরে, কেএফসির দরজা ঠেলে, রঙিন রেস্তোরাঁর অটবি-প্রবর্তিত-ফার্নিচার-রীতির একলা টেবিলটিতে বসেই আবার উঠতে হলো আজহারকে। লাইনে এসে দাঁড়িয়ে চিকেন বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর পেপসির প্যাকেজটি ২৫০ টাকায় কিনতে হলো। পকেটে রইলো ৫০ টাকা। বাসায় পৌঁছার জন্য যথেষ্ট তবে সিএনজি অটোরিকশার জন্য অপ্রতুল। অবশ্য ভীতিকর ও যুদ্ধযাত্রা হলেও, বাসযাত্রায় ডরে না আজহার।

গপগপ করেই খাচ্ছিল আজহার। গুলশান অঞ্চলে রোদমাথায় সারাবেলা হাঁটাহাঁটি করে খুব ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত ছিল সে। হঠাৎ আড়াই বর্গফুটের চৌকোণা টেবিলটার সামনের চেয়ারে মায়মুনাকে দেখা গেল, রাগী-চেনা চেহারায়। --আমাকে ছাড়া কেএফসিতে আসছো? --আমি তো চুরি করে ঢুকলাম। তুমি আসলে কখন? --এই চুরি-চামারি কেন? কার আসার কথা? --মুনা, কারও আসার কথা থাকলে তার জন্য অপেক্ষা করতাম, এরকম গপগপ করে খেতাম না।

--নিমাকে ডাকো। প্রিয় কলিগ তোমার! --মুনা, খিদা পেটে এইসব অকারণ সন্দেহের উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না। --কেএফসিতে ঢুকছো কেন? --খিদা লাগছে। --বাংলা খাবার খাইতা। টাকা উড়াচ্ছো কেন? --গুলশানে বাংলা-ইংরাজি সব খাবারের দামই এক।

--এখন যাও, আমার জন্য অর্ডার দাও। --আমার কাছে আর ৫০ টাকা আছে। তোমার কাছে আছে? --তোমার শাস্তি হলো, খিদা নিয়ে বসে থাকবা। খাইতে পারবা না। --তুমি যাওতো! ঘরেও জ্বালাও, এখানে একটু শান্তিমতো খাচ্ছি, অমনি এসে হাজির।

যা ভাগ! মায়মুনার গায়ে পেপসি ছুঁড়ে মারে আজহার। পেপসির সবটাই পড়ে যায় সামনের চেয়ারে। মায়মুনা উধাও। ক্লিনার এসে বিরক্ত মুখে ‘ওকে স্যার’ বলে চেয়ার আর ফ্লোর মুছতে থাকে। আজহার আর কী বলে? ‘সরি’ই বলে।

মায়মুনা চলে যাবার পরে, অদূরে বসা, পোলো টি-শার্টপরা মেয়েটাকে খুঁটিয়ে দেখে আজহার। মেয়েটা একটু আগে লিভাইস জিন্সপরা ছেলেটিকে জাপ্টে ধরে দোতলায় উঠেছে। পোলো-মেয়েটা এখন টেবিলে একা বসে, লিভাইস-ছেলেটা হয়তো নিচে খাবার আনতে গেছে। মেয়েটার বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে। দেখতে শার্প, লম্বাটে ফর্সা মুখ।

স্করসেসির ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’-এর নায়িকা বেটসির মতো দেখতে। ট্রেভিস বিকলের মতোই আজহার মেয়েটির প্রতি দুর্দদমনীয় আকর্ষণ বোধ করে। সরাসরি তাকায়। মেয়েটা অন্যদিকে তাকিয়ে আনমনে কী যেন ভাবে। ওই আনমনা ভাব তার সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে।

আজহার তার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে, মেয়েটির টেবিলের সামনে গিয়ে, ট্রেভিসের মতোই বলে, ইউ আর দ্যা মোস্ট বিউটিফুল গার্ল আই হ্যাভ এভার সিইন। কমপ্লিমেন্ট শুনে বেটসি প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছিল। কিন্তু যেহেতু এটা নিউইয়র্ক নয়, তাই মেয়েটির ডান হাত আচমকা সবেগে আজহারের গালের দিকে ধেয়ে আসে। তবে চড়টা গালে পড়ার আগেই আজহার নিজেকে নিজের টেবিলে সুরক্ষিত আবিষ্কার করে। বেটসির টেবিলে তার বয়ফ্রেন্ডকেও দেখা যায়।

বেটসির পেছনের টেবিলটা ফাঁকা। তারও পেছনে বড়ো একটা টেবিলে কয়েকজন স্থূলকায় মাতা তাদের খাদ্যগ্রহণে-অনীহ বাচ্চাদের নিয়ে অথবা বাচ্চাদের স্কুলের ক্লাসটেস্ট নিয়ে অথবা স্বামীদের পরনারীর প্রতি আসক্তি নিয়ে অথবা জিটিভির চলমান সোপ নিয়ে অথবা শাশুড়িদের বিদ্বেষ নিয়ে বকবক করে চলেছেন। তাদের বকবকানি চাপা পড়ে যাচ্ছে তাদেরই বাচ্চাদের চিৎকারে -- রাইডে চড়লে সব বাচ্চাই চিল্লায়। আর বাচ্চাদের চিৎকারও প্রায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সনি ব্রাভিয়া এলসিডি মনিটরে প্রদর্শিত এবং প্যানাসনিক স্পিকারে প্রচারিত হেভি মেটাল কোনো গানের ঝনঝনানিতে। এইসব চিৎকার-চেঁচামেচি বাড়তে বাড়তে চরমে পৌঁছে, রঙিন-শীতল কেএফসি রেস্তোরাঁর টকটকে লাল দেয়াল আগুনের হল্কা হয়ে ফ্লোরময় হঠাৎ বয়ে যায়।

সেই নরকের তীব্র তাপে স্থূলকায় মাতারা ঝলসে যান, শিশুদের চিৎকার দপ করে থেমে যায়, বেটসি আর তার বয়ফ্রেন্ডের কঙ্কাল পরস্পরের দিকে তাকিয়েই থাকে। কাঁচা রক্ত-মাংসের পোড়া গন্ধে আজহারের বমি পায়। অথচ কেনটাকি ফ্রায়েড চিকেন উদ্ভাবনকারী বুড়ো কর্নেল হারল্যান্ড স্যান্ডার্স হাসতেই থাকেন। আজহার হাস্যোজ্জ্বল বুড়ো কর্নেলকে পেছনে ফেলে চলে আসে গুলশানের রাজপথে। রাজপথে তখন তুমুল বৃষ্টি।

বৃষ্টির মধ্যে কেএফসির নরক জ্বলছেই। প্রবল বৃষ্টিতে আগুন কীভাবে জ্বলতেই থাকে, আজহার সেই অসম্ভাবনা নিয়ে ভাবে। একটা টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রচণ্ড হর্ন দিয়ে আনমনা আজহারকে রাজপথ থেকে ফুটপাথে আছড়ে ফেলে। আজহারের মনে পড়ে যায়, তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ছোটবেলায় স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলার সময়, বলের দখল আনতে গিয়ে, ঘাসে-পানি-কাদায় ঠিক এভাবেই পিছলে দূরে পড়তো। এই যে ভাই, বল ধরেন, উঠে দাঁড়ান, গোল দিতে হবে -- সমস্বরে কারা বলে উঠে।

আজহার পেছনে ফিরে দেখে বাংলালিঙ্কের বিলবোর্ড থেকে সুন্দর ছেলে আর সুন্দরী টিনএজাররা নেমে এসেছে। তাদের হাতে ফোনের বদলে নাইকি ফুটবল। তারা এত নিচে যখন নামতে পেরেছে, তখন আজহার আর পিছলে শুয়ে থাকে কেন? গুলশানের ফুটপাতেই খেলা শুরু করে দেয়, মডেলদের সাথে। বৃষ্টির কারণে ফুটপাতে পথচারী নেই, ভিখিরি নেই, ভেন্ডররা নেই। তবে কোত্থেকে একপাল টোকাই এসে জোটে, খেলায় যোগ দেয়।

খেলা জমে উঠে। নারী-মডেলদের গায়ে অনেকের গন্ধ লেপ্টানো ছিল -- অ্যাড নির্মাতা, চ্যানেলপ্রধান, ব্র্যান্ডম্যানেজারের -- বহু শাওয়ারেও প্লেবয় বডি স্প্রে আর ঘামমেশানো বোঁটকা গন্ধ যায়নি শরীরের অলিগলি থেকে। ফুটবল খেলতে খেলতে তুমুল বৃষ্টি আজ তা নিয়ে চলে যায়। অল্পাহারে শীর্ণ পাকস্থলীতে চাউরে ওঠা খিদেও মুছে যায় টোকাইয়ের। আর আজহারের পকেটে নোকিয়া সেটটি বৃষ্টিতে ভিজে মরে যেতে থাকে।

তা যাক, গুলশানের ফুটপাতে তখন নারী-পুরুষ-মডেল-টোকাইয়ের সাম্যবাদ। কোত্থেকে নিমা এসে হাজির। --আজহার ভাই চলেন একসাথে বৃষ্টিতে ভিজি, আর গান গাই: আই এ্যাম সিঙ্গিং ইন দ্যা রেইন জাস্ট সিঙ্গিং ইন দ্যা রেইন হোয়াট আ গ্লোরিয়াস ফিলিং আই অ্যাম হ্যাপি এগেইন ... --এই থামো, তুমি কোত্থেকে? --অফিস থেকে দেখলাম আপনি বৃষ্টিতে পোলাপানের সঙ্গে খেলছেন। তাই আমিও নেমে আসলাম। --পোলাপান কোথায় গেল? --আমাকে দেখে ভাগছে।

ঠিক তাই, বাংলালিংকের ছেলেমেয়েগুলো ফুটবল ছেড়ে ফোন কানে বিলবোর্ডে হাসছে, আবার। অবশ্য এখনও তারা বৃষ্টিতে ভিজছে। কেএফসি এখনও জ্বলছে, দাউ দাউ করে। কিন্তু টোকাইগুলো কোথায় লুকালো? --তুমি কি একটা অশুভ শক্তি, আমার জন্য? খেলা নষ্ট করতে এলে? --ছিঃ! কী বলেন? আপনার জন্য আমার জগজ্জোড়া সমস্ত শুভকামনা। --আপাতত ভাগো।

একটু আগে মুনা আসছিল। আশপাশেই কোথাও আছে। --বউকে এত ভয় পান কেন? আপনার বন্ধুবান্ধব থাকতে পারেনা? আমি তো আর উটকো কেউ না। আপনার দীর্ঘদিনের সহকর্মী। --বন্ধু থাকতে পারবে, বান্ধবী নয়।

--মি তো কলিগ। --মুনা আমার মেয়ে কলিগদের আমার বান্ধবী বলেই ডাকে। আচ্ছা, তোমার স্বামী তোমাকে ভয় পায়না? --তা খানিকটা পায় বটে। --তোমার হাজবেন্ডকে তার সেক্রেটারির সঙ্গে রাস্তায়-রেস্তোরাঁয় দেখলে তুমি ছেড়ে কথা কইবে? যা ভাবা! শরীফ ছাতা মাথায় দিয়ে মায়মুনা এদিকেই এগিয়ে আসছে। সর্বনাশ! নিমাও অপ্রস্তুত।

মুনা ওদের কাছে পৌঁছানোর আগেই চিৎকার করে উঠে, এই নিমা, তুমি এখানে কী কর? ভিজে যাচ্ছো তো! আমার ছাতার নিচে আসো। মুনা কাছে এসে নিমাকে তার ছাতার ভেতরে নিয়ে নেয়। তারপর দুজনে কোমর জড়াজড়ি করে এক ছাতার নিচে, উভয়েই সামান্য ভিজে, সামান্য নিজেকে বাঁচিয়ে, চলে যায়। যেন প্রাণের বান্ধবী দুইজন। আজহার যে এখানে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তা তাদের নজরেই পড়েনি।

যে যার গন্তব্যে, যাক। এতক্ষণে ফোনটা আসার সময় হয়েছে। ইউনিলিভারের ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজার বলেছেন দু’ঘণ্টা পরে চেকটা রেডি হলেই ফোনে জানাবেন। আজ সকালেই চেকটা হবার কথা ছিল, কিন্তু চিফ অ্যাকাউন্টেন্টের স্ত্রী রাতে আত্মহত্যা করায় সকালে আর আসেননি। বিশেষ ব্যবস্থায় দু’ঘণ্টার মধ্যে চেক রেডি করা হবে, ম্যানেজার সাহেব জানিয়েছেন।

এজন্যই আজিমপুর থেকে এসে, দু’ঘণ্টা ধরে, আজহার গুলশান এলাকায় ঘুরঘুর করছে। আজহারের চেকটা পাওয়াও অতীব জরুরি। ডায়গনসিস করতে করতে কালকেই হাতের সব টাকা শেষ হয়েছে। আজ যদি চেকটা পাওয়া যায়, সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে তবে তা জমা দিতে হবে। কাল সকালে টাকা উঠিয়ে স্কয়ার হাসপাতালে দৌড়াতে হবে।

দুপুর একটায় রাতুলের অপারেশন। সেখানে ছুরি-কাঁচি নিয়ে অপারেশন টেবিলে ডাক্তাররা বড়োজোর এক ঘণ্টা অপেক্ষা করবেন। নয়তো ওটি থেকে রাতুলকে বের করে দেয়া হবে। রাতুল আজহার আর মায়মুনার একমাত্র ছেলে। বয়স চার।

ব্রেন টিউমার হয়েছে রাতুলের। বৃষ্টি থেমে গেছে। এবার আজহারের মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। ইউনিলিভার থেকে ফোন আসবে কীভাবে? নোকিয়াটা যে বৃষ্টিতে ভিজে মৃত্যুবরণ করেছে! ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১০। প্রথম প্রকাশ: Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.