এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি
কবিতা আমার খুব প্রিয় একটা বিষয়। খুব ছোটবেলা থেকেই কেন যেন কবিতার প্রতি অন্য রকম টান নিয়ে বড় হয়েছি। কবিতা নিয়ে কৈশোর এবং তারুণ্যে যেমন ভয়ংকর কষ্ট আছে, তেমনি ছোটবেলায় মজার স্মৃতিও কম নয়। অনেকদিন আগে, আমার কবিতা লেখার একেবারে গোড়ার দিকে, মনে পড়ছে যতটুকু, বাসায় জনকণ্ঠ পত্রিকা রাখা হত, কার্টুনিস্ট রফিকুন নবী(রনবী) সেখানে শিশুদের জন্য প্রতি সপ্তাহে একটি করে কার্টুন আঁকতেন। নিয়ম ছিল সেই কার্টুন এর বিষয়বস্তু অনুযায়ী ছড়া লিখে পাঠাতে হবে।
সেই প্রতিযোগীতায় কিছু একটা পুরস্কার পেয়েছিলাম, পুরস্কার ছিনিয়ে আনা, ছড়াটার প্রথম দুটা লাইনই আমার মনে আছে-
মন্ত্রী গবু বলেন হেসে, শুনুন মহারাজ!
ব্যাঘ্র শিকার নয়তো সহজ, বড়ই কঠিন কাজ।
৭ বছর বয়সে লেখা আমার প্রথম ছড়াটির কথাও প্রায়ই মনে পড়ে-
আমাদের বাড়িতে আছে কী জানি কী ঘাপলা
পুকুরেতে গোলাপ ফোঁটে, টবে ফোঁটে শাপলা।
মজার ব্যাপার হলো, শৈশবের এই মহান শিল্পকর্মগুলোর কেবল দুটি করে লাইনই আমার মনে আছে, অন্য লাইনগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেল, নিজেও বলতে পারি না।
তখন যেখানে যত পুরোনো ডায়েরী পেতাম, পুরোনো খাতা পেতাম, সব এনে জমাতাম আমার গোপন(!) ড্রয়ারে, মনে হত, সব একদিন কবিতা লিখে ভরিয়ে দিব! ইচ্ছে মহৎ ছিল, কিন্তু বড় হয়ে বুঝেছি, কবিতা লেখা আসলে সহজ নয়, এবং মাত্র ৫৪টি বিশুদ্ধ কবিতা লিখেই বুঝেছি, কবিতা আমার ভেতর থেকে ফুরিয়ে গেছে!
কৈশোরের প্রথমদিকে উপলব্ধি করেছিলাম- হৃদয়ের অনুভূতির ভাষাগত স্ফূরণ হচ্ছে কবিতা। আত্নিক বোধের শব্দগত প্রকাশই হচ্ছে কবিতা।
তখন, আলাদা একটা গাম্ভীর্য নিয়ে চলতাম বন্ধুমহলে, ভাবখানা ছিল ঠিক সুকুমার রায়ের সেই গল্পের উন্নাসিক স্কুল পড়ুয়া বালকের মতো, যে প্রথম ক্লাশে এসেই দম্ভভরে বলেছিল- আমি পোয়েটরি লিখিতে পারি!
কাটছিল দিন খারাপ না, বিভিন্ন ধরণের বিচিত্র কবিতা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ইচ্ছে করত, একটি উদাহরণ দিতে পারি। এই কবিতাটি আমার ক্লাশ টেনে পড়ার সময়ে লেখা। তখন মনে হত, আহা! কী জানি মহাকবি মধুসূদন হয়ে গিয়েছি!
অবগ্রহ নয়, অপ্রত্যাশিত সুখও নয়;
আটপৌরে জীবনের ছন্দপতনও নয়,
ইমারতের পাদদেশে বসে অলীক কল্পনাও নয়,
ঈথর কাঁপারো ছন্নছাড়া সৃষ্টিও নয়,
উচ্ছিষ্ট মানবতার নীরব ক্রন্দনও নয়,
ঊষর হৃদয়ের আজন্ম তৃষিত নয়নও নয়;
ঋদ্ধ শহরের বিবর্তিত প্রান্তে দাঁড়িয়ে-
একান্তে প্রতীক্ষারত স্মৃতিহারা আমি,
ঐহিক স্বাচ্ছন্দ্য বিবর্জিত চেতনায়
ওজস্বী প্রত্যাশার রাশ ধরে-
ঔপাধিক আনন্দের মুখোমুখি হতে।
নিজেকে মধুসূদন মনে করার যৌক্তিক কারণ ছিল বৈকি! দেখুন তো, কবিতাটির প্রতিটি লাইনের প্রথম অক্ষরগুলো উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পড়ে! ঐ বয়সে এটা নিজেকে বিশ্বকবি যে ভাবায়নি- এটাই বেশি।
কবিতা ডোবাল আমাকে বন্ধুমহলে।
সাহিত্যিক হিসেবে ততদিনে ব্যাপক খ্যাতি পেয়ে গিয়েছি বন্ধুমহলে, গুরুগম্ভীর ভাব বজায় রাখার জন্য চশমাও একটা যুতসই পেয়ে গেছি; এই সাহিত্যিক জীবনের প্রথম ধাক্কাটা খাই এই সময়েই।
আমার স্কুল এর বন্ধু, একদিন বলে বসে তাকে একটা প্রেমপত্র লিখে দিতে হবে! আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কি ব্যাটা! মানপত্র টানপত্র দু'চার লাইন যাও লিখি, প্রেমপত্র রচনায় আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি একেবারেই শূণ্য। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। অগত্যা রাজী হলাম।
দু'রাত জেগে লিখলাম ৬২ পৃষ্ঠার প্রেমপত্র! আমার সমস্ত সাহিত্য প্রতিভা ঢেলে দিয়ে লেখা সেই প্রেমপত্র ভয়াবহ কাজ করেছিল। আজও সেই প্রেম অটুট, খুব সম্ভবত, আসছে জানুয়ারিতেই, আমার সেই দুই স্কুলবন্ধু বিয়ে করতে যাচ্ছে-শুভকামনা ওদের জন্য।
কয়েকদিন পরেই আবার নিজের জন্য লিখতে হল মহাপ্রেমপত্র, স্কুলের অন্য এক রূপসীকে দেখে আমার কবিতার স্ফূরণ তখন তুঙ্গে ছিল! যতদূর মনে পড়ে, ৭৫/৭৬ পৃষ্ঠার সেই প্রেমপত্র নিবেদন করে আমার সাহিত্যের মর্যাদা পাইনি, হৃদয়হীনা প্রতিদিন ঝালমুড়ি খেয়ে এক পৃষ্ঠা করে সেই বিষাদ-সিন্ধু ছিঁড়ে ছিঁড়ে হাত মুছত। মনে হয়, আমার সাহিত্যের মর্মন্তুদ ব্যবহার দেখেই সেই প্রেম দুই সপ্তাহের মাঝে ফিকে হয়ে গিয়েছিল!
কলেজ লাইফে আনন্দের ঘটনা কবিতা নিয়ে তেমন আর নেই, তখন আসলেই অনেক বদলে গিয়েছিলাম, অন্য একজনের কবিতার গল্প বলা যাক।
আমাদের কলেজে বাংলার ম্যাডাম ছিলেন দু'জন।
একজন বুলডোজার ম্যাডাম (উনি হাঁটলে কলেজ বিল্ডিং সত্যি সত্যি কাঁপত, নামকরণের সার্থকতা এটাই!) অন্যজন আরেক সেকশনের নাভি ম্যাডাম। নাভি ম্যাডামকে আমি ভয়াবহরকম অপছন্দ করতাম, তার কারণ- বাংলা বইয়ের একটি কবিতা ছিল "পাঞ্জেরি" শিরোনামে। একদিন বুলডোজার ম্যাডাম না আসায়, নাভি ম্যাডাম বরাবরের মতোই নাভি থেকে একহাত নিচে শাড়িটাকে কোনমতে গুঁজে আমাদের ক্লাশ নিতে আসলেন। আবৃত্তি করলেন-
রাত ফোহাবার কত দেরি, ফাঞ্জেরি?
বলা বাহুল্য, কবিতা আবৃত্তির যতটুকু শখ আমার বুলডোজার ম্যাডামকে দেখে হয়েছিল(ম্যাডাম সত্যি সত্যি ভাল আবৃত্তি করতেন), নাভি ম্যাডামের মুখে ফাঞ্জেরি শুনে সেই সখ উবে গেল মূহুর্তে। নোয়াখালীর লোকজনের বাংলা সাহিত্য পড়া একদমই উচিৎ না।
অনেক বড় হচ্ছে লেখা, এখনই থামা উচিৎ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।