আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবিতার কথা-১

শব্দশিখা জ্বলে...

আবদুর রব সাম্প্রতিক এক জরিপ থেকে জানা যায় আমেরিকার জনগণ সারাদিনে মাত্র ২৪ মিনিট ব্যয় করে পড়ার জন্যে। এই পড়া বলতে শুধু বই নয়, সবকিছু- সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, ডায়েট টিপ্‌স, টিভি, ইত্যাদি। বাংলাদেশের অবস্থা, যেখানে সাক্ষরতার হার ৪৬ ভাগ, নিশ্চয়ই এর চেয়ে ভালো কিছু নয়। পঠনপাঠনের এই আকালের দিনে কবি ও কবিতার অবস্থা কী তা সহজে অনুমেয়। তারপরও আমেরিকা কিংবা বাংলাদেশে কবির সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।

আমেরিকান কবি রন সিলিম্যান প্রায়ই বলে থাকেন, ৩০-৪০ বছর আগে তাঁরা যখন লিখতে শুরু করেছিলেন, লেখা বা বই প্রকাশিত হয়েছে এমন কবির সংখ্যা ছিল তখন কয়েকশ, বর্তমানে যার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে দশ হাজারে। বাংলাদেশে অনেকেই বলেন কবি ও কাকের সংখা সমান। নিষ্ঠুর রসিকতা বটে, তবে এর ভেতর দিয়ে যে সত্যটাকে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে তা হলো কবির সংখ্যাধিক্য। এখন প্রশ্ন হলো এত কবি যে কবিতা লিখছে, তা তাঁরা কেন লিখছেন? কবিতা কিভাবে রচিত হয়? কবিতা লিখে তাঁরা কোথায় পৌঁছাতে চান? তাদের কবিতার হাতল কোথায়? পূর্বসূরী বা একাডেমিসমূহ এক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করছে তাদের গড়ে ওঠার পেছনে? এইসব কবিদের ভবিষ্যত কী? তাঁরা কি হতে পারবেন কল্পনার রাজ্যে শব্দের সফল ফেরিওয়ালা? পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি গ্যারি স্নাইডার এক সাক্ষাৎকারে কবিতা কিভাবে রচিত হয় সে-সম্পর্কে বলেছিলেন, কবিতার একটি চরণ আসে আর খুলে যায় মনের বিশাল জানালা। তার ভিতর দিয়ে কবি দেখেন দূরের দৃশ্য, সেই চরণকে ঘিরেই গড়ে ওঠে কবিতা।

শুধু কবিতা নয়, সম্ভবত সব শিল্পই গড়ে ওঠে এই উপায়ে। তবে সব সময়ই ব্যাপারটা এরকম হবে এরকম আশা করাটা হবে অতিলোভ। তিনি মনে করেন, কবিতার প্রয়োজনে কবিকে অনেক বিষয়ের সংস্পর্শে আসতে হয়। তবে তার নিজের ভাষাটা জানতে হয় যাতে শূন্যের মাঝার থেকেও যেনো কিছু উঠে আসে। তাছাড়া, লিখতে গেলে একটা শৃংখলা লাগে।

যেমন গদ্য লিখতে গেলে পড়াশুনা, গবেষণা, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, লেখা, সম্পাদনা ও পুনর্লিখন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এছাড়া গদ্য লেখা অসম্ভব। কবিতার ক্ষেত্রেও কবিকে হতে হবে নিবেদিতপ্রাণ। কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা আসে দুর্ঘটনার মতো, কখন তা ঘটবে কেউ তা জানে না। তবে যখন সে আসে তার জন্যে তৈরি থাকতে হবে, টুকে রাখতে হবে তারপর লেখাটা শেষ করতে হবে।

হাতের কাছে তখন একটা ভালো অভিধান থাকা চাই। তাঁর মতে কবিতা আসে গভীর অনুভূতির জায়গা থেকে, জীবন সংলগ্নতা থেকে, যাকে শিল্পরূপ দিতে লাগে জ্ঞান, পড়াশুনা ও একটি স্পর্শবিন্দু। কবিতা গড়ে ওঠে ভাষা, তার পদবিন্যাস (সিনট্যাক্‌স), সঙ্গীতময়তা আর বহু স্তরের অব্যক্ত অর্থময়তার ভেতর দিয়ে। গ্যারি স্নাইডার আমেরিকার কবিদের পরামর্শ দিয়েছেন কবিতা লিখতে গেলে তাঁরা যেন লক্ষ্য রাখেন ভারত ও পূর্ব এশিয়ার দিকে (কেন কি উদ্দেশ্যে তা অবশ্য আমার অজানা। ভাষার লিখিত রূপের আগেকার কবিতা ও গানের সম্পর্কেও জানার জন্যে তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

তরুণ কবিদের তিনি বলেন, ভুলে যেওনা তুমি অতিক্ষুদ্র একটা দেহকাণ্ড, তার ভিতরে বাস করে রহস্যময় একটা বিশাল মন, পৃথিবীর এক কোণ, যেখানে বয়ে চলে শত নদীনালা। পিয়েরি জরিস মনে করেন তিনি কবিতা পড়েন অজানাকে জানার জন্যে, যা তিনি ইতিমধ্যে জানেন তা খুঁজে ফেরার জন্য নয়। তাঁর মতে অজানাকে আমরা ভয় পাই, মৃত্যুভয়ের মতো। মানুষ আস্বস্ত হতে চায় যে পৃথিবীতে যা ঘটছে, নিজ দেশে যা ঘটছে তা তাদের জানা। মানুষ আসলে বুঝতে চায়, অর্থ খুঁজে পেতে চায়।

তিনি বলেন, একটা ভালো কবিতা কঠিন, এমনকি অব্যক্ত কিন্তু উপলব্ধির অসাধ্য নয়। তিনি বলেন, পাঠক হিসেবে সেই কবিতাকে বিশ্বাস করো না, যা তোমার কাছে মনে হবে সব কিছু খুলে দিচ্ছছ, নগ্ন স্বচ্ছ। এটা অনেকটা দ্রুত যৌনকর্ম করে নেওয়া কিংবা ফাস্টফুডের মতো- যাতে পুরো ক্ষুধা মেটে না, একটা খাখা অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং কোলেস্টরাল বাড়িয়ে দেয়। তাঁর মতে কবিতা যেন এক বিদেশি ভাষা, পাঠককে তা শিখতে হবে। প্রতিদিনকার যোগাযোগ, নাটক-নভেল-সিনেমায় ব্যবহৃত হতে হতে ভাষা আটপৌরে হয়ে যায়, এ থেকে ভাষাকে উদ্ধার করার জন্যেই কবিতার ভাষাকে হতে হয় অস্বাভাবিক ও কৌতূহলোদ্দীপক, ঘন সসের মতো যা কবিরা করে থাকেন বিভিন্ন উপায়ে।

তবে তিনি একথাও স্বীকার করেন যে ভালো কবিরা এমন কবিতাও লেখেন যার হাতল আছে। এক্ষেত্রে ছন্দ ও সঙ্গীতময়তার মধ্য দিয়ে পাঠক শুরু করতে পারেন তার কবিতাযাত্রা। পল সিলান (Paul Celan) বলেন কবিতার আধার গড়ে ওঠে কল্পনা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা। কবিতা জন্মান্ধ, ব্যাপক ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের জন্যে ভাষার পৃথিবীতে একখণ্ড ভাষা হিসেবে গড়ে ওঠে। তিনি আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, কবিতা মৌলিক কথা বলে, এতে নিকট ও দূর একাকার, একদিকে সে অন্ধকার আবার তা দূরের উজ্জ্বলতাও।

কীট্‌সও অনেকটা এরকম মনে করতেন। তাঁর ভাষ্য: কবিতায় অন্ধকার আছে- এ কখনো গাণিতিকভাবে নিখুঁত হবে না- এবং তবুও তা দিকনির্দেশনামূলক ও গুরুত্বপূর্ণ। এবার আসা যাক কবিতার অনুপ্রেরণা প্রসঙ্গে। ফরাসি দার্শনিক Vladimir Jankelvitch বলেন ‘‘ile a le mystere et le secret” অর্থাৎ এটা গোপনীয়তার চেয়ে রহস্যের ব্যাপার। মরক্কোর কবি খাতিবি আবদেলকেবির এ-প্রসঙ্গে মূল্যবান এক কথা বলেছেন- ‘‘যখন কেউ আমাকে বলে পরিষ্কার করে বলো (Be clear) তখন সে যা বলে তার অর্থ হলো আমি যেন তার মতো হই’’।

আসলে দুর্বোধ্যতা কবিতায় নয়, থাকে সম্পর্কে । এ-অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পিয়েরি বলেন, ‘‘প্রতিটি পাঠ প্রতিপাঠ দাবি করে। আমি মূলত তাদের জন্যেই লিখি যারা লেখাটা যেমন সেভাবেই তাকে ভালোবাসে এবং যারা তাদের কল্পনায় ভাষাটাকে স্থান দেন সুদৃঢ় ভিত্তির উপরে’’। (লেখাটি সাপ্তাহিক কাগজে প্রকাশিত কবিতার মানচিত্র-১-এর নির্বাচিত অংশ। )


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।