আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুধু কবিতার জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে এত ভালো লাগে তার কয়েকটি কবিতার সংকলন

আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া সন্ধানো করিয়া স্বপ্নেরও পাখি ধরতে চাই আমি স্বপ্নেরও কথা বলতে চাই আমার অন্তরের কথা বলতে চাই... যা চেয়েছি, যা পাবো না -কী চাও আমার কাছে ? -কিছু তো চাইনি আমি । -চাওনি তা ঠিক । তবু কেন এমন ঝড়ের মতো ডাক দাও ? -জানি না । ওদিকে দ্যাখো রোদ্দুরে রুপোর মতো জল তোমার চোখের মতো দূরবর্তী নৌকো চর্তুদিকে তোমাকেই দেখা -সত্যি করে বলো, কবি, কী চাও আমার কাছে ? -মনে হয় তুমি দেবী… -আমি দেবী নই । -তুমি তো জানো না তুমি কে ! -কে আমি ! -তুমি সরস্বতী, শব্দটির মূল অর্থে যদিও মানবী, তাই কাছাকাছি পাওয়া মাঝে মাঝে নারী নামে ডাকি -হাসি পায় শুনে ।

যখন যা মনে আসে তাই বলো, ঠিক নয় ? -অনেকটা ঠিক । যখন যা মনে আসে- কেন মনে আসে ? -কী চাও, বলো তো সত্যি ? কথা ঘুরিয়ো না -আশীর্বাদ ! -আশীর্বাদ ? আমার, না সত্যি যিনি দেবী -তুমিই তো সেই ! টেবিলের ঐ পাশে ফিকে লাল শাড়ি আঙ্গুলে ছোঁয়ানো থুতনি, উঠে এসো আশীর্বাদ দাও, মাথার ওপরে রাখো হাত আশীর্বাদে আশীর্বাদে আমাকে পাগল করে তোলো খিমচে ধরো চুল, আমার কপাল নোখ দিয়ে চিরে দাও -যথেষ্ট পাগল আছো ! আরও হতে চাও বুঝি ? -তোমাকে দেখলেই শুধু এরকম, নয়তো কেমন শান্তশিষ্ট -না দেখাই ভালো তবে ! তাই নয় ? -ভালো মন্দ জেনে শুনে যদি এ-জীবন কাটাতুম তবে সে-জীবন ছিল শালিকের, দোয়েলের বনবিড়ালের কিংবা মহাত্মা গান্ধীর ইরি ধানে, ধানের পোকার যে-জীবন -যে জীবন মানুষের ? -আমি কি মানুষ নাকি ? ছিলাম মানুষ বটে তোমাকে দেখার আগে -তুমি সোজাসুজি তাকাও চোখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকো পলক পড়ে না কী দেখো অমন করে ? -তোমার ভিতরে তুমি, শাড়ি-সজ্জা খুলে ফেললে তুমি তারা আড়ালে যে তুমি -সে কি সত্যি আমি ? না তোমার নিজের কল্পনা -শোন্ খুকী -এই মাত্র দেবী বললে- -একই কথা ! কল্পনা আধার যিনি, তিনি দেবী- তুই সেই নীরা তোর কাছে আশীর্বাদ চাই -সে আর এমন কি শক্ত ? এক্ষুনি তা দিতে পারি -তোমার অনেক আছে, কণা মাত্র দাও -কী আছে আমার ? জানি না তো -তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই -সিঁড়ির ওপরে সেই দেখা তখন তো বলোনি কিছু ? আমার নিঃসঙ্গ দিন, আমার অবেলা আমারই নিজস্ব–শৈশবের হাওয়া শুধু জানে -দেবে কি দুঃখের অংশভাগ ? আমি ধনী হবো -আমার তো দুঃখ নেই–দুঃখের চেয়েও কোনো সুমহান আবিষ্টতা আমাকে রয়েছে ঘিরে তার কোনো ভাগ হয় না আমার কী আছে আর, কী দেবো তোমাকে ? -তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই ! তুমি দেবী, ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে বসি মাথায় তোমার করতল, আশীর্বাদ… তবু সেখানেও শেষ নেই কবি নয়, মুহূর্তে পুরুষ হয়ে উঠি অস্থির দু’হাত দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরতে চায় সিংহিনীর মতো ঐ যে তোমার কোমর অবোধ শিশুর মতো মুখ ঘষে তোমার শরীরে যেন কোনো গুপ্ত সংবাদের জন্য ছটফটানি -পুরুষ দূরত্বে যাও, কবি কাছে এসো তোমায় কী দিতে পারি ? -কিছু নয় ! -অভিমান ? -নাম দাও অভিমান ! -এটা কিন্তু বেশ ! যদি অসুখের নাম দিই নির্বাসন না-দেখার নাম দিই অনস্তিত্ব দূরত্বের নাম দিই অভিমান ? -কতটুকু দূরত্ব ? কী, মনে পড়ে ? -কী করে ভাবলে যে ভুলবো ? -তুমি এই যে বসে আছো, আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি কপালে পড়েছে চূর্ণ চুল পাড়ের নক্সায় ঢাকা পা ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি- এই দৃশ্যে অমরত্ব তুমি তো জানো না, নীরা, আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে । -সময় কি থেমে থাকবে ? কী চাও আমার কাছে ? -মৃত্যু ? -ছিঃ , বলতে নেই -তবে স্নেহ ? আমি বড় স্নেহের কাঙাল -পাওনি কি ? -বুঝতে পারি না ঠিক । বয়স্ক পুরুষ যদি স্নেহ চায় শরীরও সে চায় তার গালে গাল চেপে দিতে পারো মধুর উত্তাপ ? -ফের পাগলামি ? -দেখা দাও । -আমিও তোমায় দেখতে চাই ।

-না ! -কেন ? -বোলো না । কক্ষনো বোলো না আর এ কথা আমি ভয় পাবো । এ শুধুই এক দিকের আমি কে ? সামান্য, অতি নগণ্য, কেউ না তুবি এত স্পর্ধা করে তোমার রূপের কাছে– -তুমি কবি ? -তা কি মনে থাকে ? বারবার ভুলে যাই অবুঝ পুরুষ হয়ে কৃপাপ্রার্থী -কী চাও আমার কাছে ? -কিছু নয় । আমার দু’চোখে যদি ধুলো পড়ে আঁচলের ভাপ দিয়ে মুছে দেবে ? এই জীবন বাঁচতে হবে বাঁচার মতন, বাঁচতে-বাঁচতে এই জীবনটা গোটা একটা জীবন হয়ে জীবন্ত হোক আমি কিছুই ছাড়বো না, এই রোদ ও বৃষ্টি আমাকে দাও ক্ষুধার অন্ন শুধু যা নয় নিছক অন্ন আমার চাই সব লাবণ্য নইলে গোটা দুনিয়া খাবো! আমাকে কেউ গ্রামে গঞ্জে ভিখারী করে পালিয়ে যাবে? আমায় কেউ নিলাম করবে সুতো কলে কামারশালায়? আমি কিছুই ছাড়বো না আর, এখন আমার অন্য খেলা পদ্মপাতায় ফড়িং যেমন আপনমনে খেলায় মাতে গোটা জীবন মানুষ সেজে আসা হলো, মানুষ হয়েই ফিরে যাবো বাঁচতে হবে বাঁচার মতন,বাঁচতে-বাঁচতে এই জীবনটা গোটা একটা জীবন হয়ে জীবন্ত হোক! শুধু কবিতার জন্য শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক; শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু কবিতার জন্য এতো রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়। মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।

নীরা ও জীরো আওয়ার এখন অসুখ নেই, এখন অসুখ থেকে সেরে উঠে পরবর্তী অসুখের জন্য বসে থাকা। এখন মাথার কাছে জানলা নেই, বুক ভরা দুই জানলা, শুধু শুকনো চোখ দেয়ালে বিশ্রাম করে, কপালে জলপট্টির মতো ঠাণ্ডা হাত দূরে সরে গেছে, আজ এই বিষম সকালবেলা আমার উত্থান নেই, আমি শুয়ে থাকি, সাড়ে দশটা বেজে যায়। প্রবন্ধ ও রম্যরচনা, অনুবাদ, পাঁচ বছর আগের শুরু করা উপন্যাস, সংবাদপত্রের জন্য জল-মেশানো গদ্য থেকে আজ এই সাড়ে দশটায় আমি সব ভেঙেচুরে উঠে দাঁড়াতে চাই–অন্ধ চোখ, ছোট চুল–ইস্ত্রিকরা পোশাক ও হাতের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলে আমি এখন তোমার বাড়ির সামনে, নীরা থুক্‌ করে মাটিতে থুতু ছিটিয়ে‌ বলি : এই প্রাসাদ একদিন আমি ভেঙে ফেলবো! এই প্রাসাদে এক ভারতবর্ষব্যাপী অন্যায়। এখান থেকে পুনরায় রাজতন্ত্রের উৎস। আমি ব্রীজের নিচে বসে গম্ভীর আওয়াজ শুনেছি, একদিন আমূলভাবে উপড়ে নিতে হবে অপবিত্র সফলতা।

কবিতায় ছোট দুঃখ, ফিরে গিয়ে দেখেছি বহুবার আমার নতুন কবিতা এই রকম ভাবে শুরু হয় : নীরা, তোমায় একটি রঙিন সাবান উপহার দিয়েছি শেষবার; আমার সাবান ঘুরবে তোমার সারা দেশে। বুক পেরিয়ে নাভির কাছে মায়া স্নেহে আদর করবে, রহস্যময় হাসির শব্দে ক্ষয়ে যাবে, বলবে তোমার শরীর যেন অমর না হয়… অসহ্য! কলম ছুঁড়ে বেরিয়ে আমি বহুদূর সমুদ্রে চলে যাই, অন্ধকারে স্নান করি হাঙর-শিশুদের সঙ্গে ফিরে এসে ঘুম চোখ, টেবিলের ওপাশে দুই বালিকার মতো নারী, আমি নীল-লোভী তাতার বা কালো ঈশ্বর-খোঁজা নিগ্রোদের মতো অভিমান করি, অভিমানের স্পষ্ট শব্দ, আমার চা-মেশানো ভদ্রতা হলুদ হয়! এখন, আমি বন্ধুর সঙ্গে সাহাবাবুদের দোকানে, এখন বন্ধুর শরীরে ইঞ্জেকশন ফুঁড়লে আমার কষ্ট, এখন আমি প্রবীণ কবির সুন্দর মুখ থেকে লোমশ ভ্রুকুটি জানু পেতে ভিক্ষা করি, আমার ক্রোধ ও হাহাকার ঘরের সিলিং ছুঁয়ে আবার মাটিতে ফিরে আসে, এখন সাহেব বাড়ীর পার্টিতে আমি ফরিদপুরের ছেলে, ভালো পোষাক পরার লোভ সমেত কাদা মাখা পায়ে কুৎসিত শ্বেতাঙ্গিনীকে দু’পাটি দাঁত খুলে আমার আলজিভ দেখাই, এখানে কেউ আমার নিম্নশরীরের যন্ত্রনার কথা জানে না। ডিনারের আগে ১৪ মিনিটের ছবিতে হোয়াইট ও ম্যাকডেভিড মহাশূন্যে উড়ে যায়, উন্মাদ! উন্মাদ! এক স্লাইস পৃথিবী দূরে, সোনার রজ্জুতে বাঁধা একজন ত্রিশঙ্কু। কিন্তু আমি প্রধান কবিতা পেয়ে গেছি প্রথমেই, ৯, ৮, ৭, ৬, ৫…থেকে ক্রমশ শূন্যে এসে স্তব্ধ অসময়, উলটোদিকে ফিরে গিয়ে এই সেই মহাশূন্য, সহস্র সূর্যের বিস্ফোরণের সামনে দাঁড়িয়ে ওপেনহাইমার প্রথম এই বিপরীত অঙ্ক গুনেছিল ভগবৎ গীতা আউড়িয়ে? কেউ শূন্যে ওঠে কেউ শূন্যে নামে, এই প্রথম আমার মৃত্যু ও অমরত্বের ভয় কেটে যায়, আমি হেসে বন্দনা করি : ওঁ শান্তি! হে বিপরীত সাম্প্রতিক গণিতের বীজ তুমি ধন্য, তুমি ইয়ার্কি, অজ্ঞান হবার আগে তুমি সশব্দ অভ্যুত্থান, তুমি নেশা, তুমি নীরা, তুমিই আমার ব্যক্তিগত পাপমুক্তি। আমি আজ পৃথিবীর উদ্ধারের যোগ্য চায়ের দোকানে লণ্ডনে আছে লাস্ট বেঞ্চির ভীরু পরিমল, রথীন এখন সাহিত্যে এক পরমহংস দীপু তো শুনেছি খুলেছে বিরাট কাগজের কল এবং পাঁচটা চায়ের বাগানে দশআনি অংশ তদুপরি অবসর পেলে হয় স্বদেশসেবক; আড়াই ডজন আরশোলা ছেড়ে ক্লাস ভেঙেছিল পাগলা অমল সে আজ হয়েছে মস্ত অধ্যাপক! কি ভয়ংকর উজ্জ্বল ছিল সত্যশরণ সে কেন নিজের কণ্ঠ কাটলো ঝকঝকে ক্ষুরে - এখনো ছবিটি চোখে ভাসলেই জাগে শিহরণ দূরে চলে যাবে জানতাম, তবু এতখানি দূরে ? গলির চায়ের দোকানে এখন আর কেউ নেই একদা এখানে সকলে আমরা স্বপ্নে জেগেছিলাম এক বালিকার প্রণয়ে ডুবেছি এক সাথে মিলে পঞ্চজনেই আজ এমনকি মনে নেই সেই মেয়েটিরও নাম।

কেউ কথা রাখেনি কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী আর এলোনা পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি। মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে! নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায় তিন প্রহরের বিল দেখাবে? একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি ভিতরে রাস-উৎসব অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা কত রকম আমোদে হেসেছে আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি! বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও… বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা! বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল, যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে! ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড় বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ এখনো সে যে-কোনো নারী। কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.