কহ কানে কানে শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলও বারতা
১৯৫৮-৫৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রসিডেন্ট আইয়ুব খান ১১ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন এসএম শরীফ খান এবং ইতিহাসে এটি শরীফ খান শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত। এই কমিটি সাম্প্রদায়িকতা ও টাকা যার শিক্ষা তার আইয়ুব খান সরকারের শরীফ কমিশন রিপোর্টে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বণর্না করা হয় । “ শিক্ষা সম্পর্কে জনসাধারণের চিরাচরিত ধারণা অবশ্যই বদলাতে হবে। সস্তায় শিক্ষা লাভ করা যায় বলিয়া তাহাদের যে ভুল ধারণা রয়েছ, তা শীঘ্রই ত্যাগ করিতে হবে। যেমন দাম তেমন জিনিস – এই অর্থনৈতিক সত্যকে অন্যান্য ব্যাপারে যেমন শিক্ষার ব্যাপারেও তেমনি এড়ানো দুষ্কর”।
এ রিপোর্টে সাম্প্রদায়িক চেতনা, জাতীয় স্বার্থ বিরোধী, পুজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষাই শিক্ষার লক্ষ্য তা রিপোর্টের অংশে স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। এই নীতির ভিত্তিতে একটি অবৈজ্ঞানিক ও বৈষম্যমুলক শিক্ষানীতির সুপারিশমালা জমা দেয়। ১৯৬০ সালের ৬ইএপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তানের সরকার এটি অনুমোদন করে এবং ১৯৬১-৬২ শিক্ষাবর্ষ থেকে এর বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহন করে। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এই পশ্চাদপদ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন সহ সমগ্র ছাত্র জনতা আন্দোলনে নামে এবং All Party Student Action Committee সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্টানে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়। ছাত্র ধর্মঘট চলাকালে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর সরকারের পেটুয়া পুলিশবাহীনি গুলিতে নিহত হয় বাবুল, ওয়াজীউল্লাহ, মোস্তফাসহ আরো অনেকে।
শহীদের রক্তমাখা রাজপথে বিজয়ী হয় বীর ছাত্রসমাজ।
বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কি ৬২ এর অবস্থান থেকে ভিন্ন কিছু ? এদেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী এবং এদেশের ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসাবে অবশ্যই আমার উত্তর - না । তফাৎ শুধু ১৯৬২ ছিল উপনিবেশিক শাসন আমল, ভিন দেশী শাসক গোষ্ঠী আর ২০১০ সালে আমাদের শাসক আমরাই নির্ধারন বা নির্বাচন করি !!! । আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দর্শন ১৯৬২ সালে যা ছিল এখনও তাই । সেই উপনিবেশিক শাসনামলের কেরানী তৈরী করার শিক্ষাব্যবস্থা বহাল রয়েছে।
যা মানুষকে ভোগবাদী-সুবিধাবাদী হিসেবে তৈরি করে। বর্তমান সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ১১ টি ধারায় বিভক্ত। এদেশে এখন পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়নি। যদিও বর্তমানে একটি শিক্ষানীতি চালু আছে যার দর্শন পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরনের ও বৈষম্যেরই ধারক । যার প্রমান বেসরকারী বিশ্ববিদ্যলয় আইন ২০১০, এখানে আমরা স্পষ্টত দুটি শ্রেণী দেখতে পাই এক বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক ও শিক্ষার্থী ( বা শ্রমিক!!! ) ।
ফলাফল ৪.৫ % ভ্যাট বৃদ্ধি ও প্রতিবাদে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ (শ্রমিক বিক্ষোভ ও বলা যায়) ।
এছাড়াও রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাইভেটাইজেশন, যার টোটকা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ সহ শ্রদ্ধেয় (!) দাতা গোষ্ঠী ( অর্থাৎ আমরা এখনো মানসিকভাবে পরাধীণ, আমরা গরু কিনতেও ৩য় পক্ষের সাহায্য চাই !!! ) । এর সারমর্ম হচ্ছে, বাবারা নিজেদের পেটের খোরাক তোমরা নিজেরা জোগাড় করো। এটা মুলত বাস্তবায়িত হবে ইউজিসি ( পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি সায়ত্তশসিত প্রতিষ্ঠান হয় তাহলে ইউজিসি কেন ? ) এর ২০ বছর মেয়াদী কৌশল পত্র এবং পিপিপি ( পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) এর মাধ্যমে। এর ধারাবাহিকতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নৈশ কালীন কোর্স চালু, বেতন ফি এর লাগামহীন বৃদ্ধি অভ্যাহত রয়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমুহের এহেন বাণিজ্যিকীকরন কে পরিপূর্ণতা প্রদানই মুলত ২০ বছর মেয়াদী কৌশল পত্র এবং পিপিপি -এর মুল লক্ষ্য । যদিও জগন্নাথ বিশ্ববদ্যালয়কে এর জন্য মডেল ধরা হয়েছিল কিন্তু ইউজিসি সে জায়গা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে , এখন নতুন মডেল বিশ্ববিদ্যালয় শাবিপ্রবি । যার ফলে ঢাকা, রাজশাহী, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভ চোখে পড়ছে। বর্তমান সময়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ সমুহে বেতন - ফি ১৫% পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সবচে’ মজার ব্যাপার হচ্ছে রাষ্ট্র শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের কথামতো কাজ করলেও ইউনেস্কের সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্র শিক্ষাক্ষেত্রে মোট বাজেটের ২৫% ও জাতীয় আয়ের ৮% বরাদ্দের বিষয়ে এদেশের শাসক শ্রেণীর মুখে কোন কথা শুনা যায় না ।
এছাড়াও দেশের ক্যাম্পাস পরিস্থিতি সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল ছাত্র বিক্ষোভের পাশাপাশি টেন্ডারবাজী, দখল পাল্টা দখলতো ছিলোই এর সাথে সাম্প্রতিক সময়ে একটা নতুন ইভেন্ট যোগ হয়েছে, যার নাম সহপাঠি নিক্ষেপ প্রতিযোগীতা , যার ফলে রাবিতে একজন মৃত্যুবরন করেছে, জাবির সহপাঠিদের কথা এখন পত্রিকার পাতায় নাই ... ।
ঢাকসু সহ কোন ছাত্র সংসদই কার্যকর নয়, অদুর ভবিষ্যতে হবে বলে কোন সম্ভাবনাও নেই বা ইচ্ছাও নেই... । প্রতিটা ক্যাম্পাস আজ এক একটি পুলিশ ব্যারাক, প্রক্টোররা এদের কমান্ডার (!)। (শরীফ খান শিক্ষা কমিশনের অন্যতম প্রস্তাবনা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের উপর তীক্ষ্ম নজর রাখার প্রস্তাব করে । )
ডশক্ষার এহেন বাণিজ্যিকীকরন আজ এদেশের ছাত্র আন্দোলনের রূপকল্প হতে পাড়তো সেখানে ছাত্র ইউনিয়ন সহ অন্যান্য বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাড়া কেউ এব্যাপারে কাজ করছে না ।
মিডিয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম। তারা পচা-গলা ছাত্র সংগঠনের ভিডিও ফুটেজ দেখাতে বেশী উৎসাহী।
সবশেষে বাধ্য হয়েই বলতে হচ্ছি ১৯৬২ ও ২০১০ এর মধ্যে সময় গত ব্যবধান থাকলে ও নৈকট্যটাই বেশী। কারণ পুর্ববত্তীদের মতো একটি বিজ্ঞানভিত্তিক-বৈষম্যহীন-অসাম্প্রদায়ীক শিক্ষানীতি এখনো আমাদের স্বপ্ন এবং প্রতিবাদী মিছিলের ভাষা ...
সত্যজিত দত্ত পুরকায়স্থ
সাধারন সম্পাদক
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, শাবিপ্রবি সংসদ ও সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি ।
বিশেষ ধন্যবাদ ঃ শেখ রফিক ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।