বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
দূর থেকে বুড়িমাকে আসতে দেখল দীপা । থুত্থুরে বুড়িমা লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটছে। বুড়িমার শনের মতন চুল, চোখের মনির রং বাদামী, ধবধবে ফরসা গায়ের রং।
বুড়িমার বাড়ি যে ঠিক কোথাও তা কেউ জানে না। রূপনগরে বছরে অন্তত একবার আসে বুড়িমা । লোকে বলে বুড়িমা নাকি যন্ত্ররমন্তর জানে। যন্ত্ররমন্তর যে ঠিক কী জিনিস-দীপা জানে না। দীপার সঙ্গে বুড়িমার বেশ খাতির।
বুড়িমার জীবন ভারি অদ্ভূত। এককালে বুড়িমার ঘরবাড়ি ছিল, সুখের সংসার ছিল; স্বামী ছিল, ছেলেমেয়ে ছিল। বুড়িমার ১২ বছর বয়েসী এক ছেলে একবার হারিয়ে গেল। বুড়িমা সেই ছেলের খোঁজে সেই যে বাড়ি ছাড়ল আর ফিরল না। সেই ছেলেকে আজও খুঁজে পায়নি বুড়িমা।
বুড়িমা কাছাকাছি চলে এসেছে। দীপা জিগ্যেস করল, শুনলাম তুমি নাকি আজই রূপনগর থেকে চলে যাচ্ছ বুড়িমা?
বুড়িমা মুখ তুলে চাইল। খনখনে কন্ঠে বলল, আমার কি আর এক জায়গায় থাকলে চলে রে মা? এবার যাচ্ছি দূরের এক অচিন দেশে। যদি ছেলের সন্ধান পাই।
এত বছরের ছেলের খোঁজ পেলে না বুড়িমা?
পেলাম আর কই।
এবার যাচ্ছি দূরে অচিন দেশে। যদি ছেলের সন্ধান পাই।
আচ্ছা যাও। ভালো থেকো। বলে দীপা হাঁটতে থাকে।
তালপুকুরের পাশ দিয়ে পথ। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। দীপা দ্রুত হাঁটে। দীপা ওর সই চৈতির বাড়ি গিয়েছিল। চৈতিরা রূপনগর স্টেশনের কাছে থাকে।
একই ক্লাসে ওঠে। দীপারা এবার এইটে উঠল। চৈতির মা নেই। চৈতির বাবা জীবন কাকা রূপনগর স্টেশনের স্টেশন মাষ্টার; তিনিও দীপাকে কন্যাসম স্নেহ করেন।
বাড়ির সামনে ছোট বাগানে জোছনার ঢল।
ঘর অন্ধকার। বাবা অফিস থেকে এখনও ফেরেনি হয়তো। সন্ধ্যের আগেই ঘরে ঘরে ধূপের ধোঁয়া ছড়ায় রাধা। আজ সে রকম সুগন্ধ পেল না দীপা। রাধা বাড়ি নেই।
ক’দিন হল দেশের বাড়িতে গেছে রাধা।
মা কই? দীপার বুক ধক করে ওঠে। ও রান্নাঘরের দিকে চলে আসে। উঠানে জোছনা। উথালপাথাল হাওয়া।
কাঁঠাল পাতায় বাতাসের খসখসানি। মা আধোঅন্ধকার বারান্দায় চুল এলো করে বসে আছে।
কি হয়েছে মা?
মা কান্না ভেজা কন্ঠে বললে, দুপুরে তোর শ্যামলদা এসেছিল। শ্যামল বলল, কাকি, রাজনগরে আষাঢ়ী পূর্ণিমার মেলায় বসেছে । ছোটনকে নিয়ে যাই।
আমি বললাম, যাও। শ্যামলের সঙ্গে ছোটন সেই যে গেল এখনও ফেরেনি।
বল কি মা! দীপার মুখচোখে অন্ধকার ছড়িয়ে যায়। বুকের ভিতরে হিম। কোনওমতে বলতে পারল, তুমি ভেব না মা।
দেখ, শ্যামলদারা ঠিকই ফিরে আসবে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। আষাঢ়ী জোছনা আরও ঘন হয়ে উঠল। ছোটন ফিরল না। মায়ের মুখ থমথমে হয়ে উঠল।
দীপা বুকের ভিতর যন্ত্রণা টের পায়।
রাত ৮টার দিকে বাবা ফিরে এল। সব শুনে বাবার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। অফিসের কাপড় না-ছেড়ে আবার বেরিয়ে গেল। বাবার পিছন পিছন সদর দরজা পর্যন্ত গেল দীপা ।
জিগ্যেস করল, বাবা তুমি কই যাচ্ছ?
বাবা গম্ভীর কন্ঠে বলল, থানায়।
দীপা শ্বাস টানল।
অনেক রাতে বাবা ফিরে এল।
ছোটন তখনও ফেরেনি।
মা পাথরের মূর্তির মতন পিছনের বারান্দায় বসে ছিল।
বাবা মায়ের পাশে বসল। বলল, রাজনগরে যেতে আসতে এক ঘন্টা লাগে। ওদের এত সময় লাগছে কেন।
মা বলল, তুমি একবার বালাগঞ্জ যাও। শ্যামল ছোটন কে ওখানে নিয়ে যেতে পারে।
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সদর দরজার দিকে চলে গেলেন। স্টেশনে যাবেন। । রাত দশটায় বালাগঞ্জ যাওয়ার ট্রেন।
দীপা মার পাশে বসল। মা দীপাকে জড়িয়ে ধরল। হুহু করে কাঁদল।
খানিক বাদে দীপা ঘরে গেল। ঘরটা অন্ধকার।
জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকেছে। টেবিলে ছোটন-এর বই। ছোটন ক্লাস সিক্সে পড়ে। দীপা ছোটনকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকত। গল্প বলত।
সেই ছোটন হারিয়ে গেল। দীপা কাঁদতে শুরু করে। ক্লান্তিতে দীপার শরীর ভেঙে আসতে চায়। ও বিছানার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল।
অদ্ভূত এক স্বপ্ন দেখল। দেখল চারিদিকে হিম আর গভীর কুয়াশার ভিতর রেললাইন। আবছা আলো। দু’পাশে উচুঁ উচুঁ গাছ। দুটি মূর্তি।
হেঁটে এদিকে আসছে। কারা ওরা ...
পর দিন দুপুরের আগে আগে বাবা ফিরে এল । হতাশার সুরে বললে, নাহ্ । শ্যামল এখনও বাড়ি ফিরেনি ।
বলে বাবা ঘর ছেড়ে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে গেল।
দীপা বাবার পিছু পিছু । হন হন করে হাঁটছে বাবা।
স্টেশনের কাছাকাছি এসে থামল ব । পিছু ফিরে দীপাকে বলল, তুই ঘরে যা দীপা। আমি একবার রাজনগরের দিকে যাই।
শুনেছি মেলা এখনও ভাঙেনি। এখনও ওরা ওখানে থাকতে পারে।
রাজনগরে কোথায় উঠবে?
ও নিয়ে তুই ভাবিস না। তোর রাঙা মাসী থাকেন রাজনগরে।
ও।
রাঙা মাসী মায়ের কী রকম বোন-ধবধবে ফরসা অপূর্ব সুন্দরী থলথলে মধ্যবয়েসী বিধবা। রাঙা মাসীর কড়া মেজাজ। যাক। কথাটা শুনে দীপা আশ্বস্ত হল।
বাবা স্টেশনের দিকে চলে গেল।
কাছেই চৈতিদের বাড়ি । দীপা চৈতিদের বাড়ীর দিকে হাঁটতে থাকে। কড়া রোদে দরদর করে ঘামছে। জীবনকাকা বাড়ি ছিলেন না। চৈতিকে সব খুলে বলল।
বলে চৈতিকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদল দীপা। চৈতিও অঝোরে কাঁদল।
দুপুর ফুরোবার আগেই দীপা ফিরে এল।
মাকে ঘরে পেল না । মা গেল কই? দীপার কান্না পায়।
খাওয়ার টেবিলের ওপর ভাঁজ করা একটা সাদা কাগজ। কাগজে মায়ের হাতে লেখা .... ছোটনকে কে খুঁজতে গেলাম। ওকে খুঁজে না পেলে ফিরব না। তোরা ভালো থাকিস।
দীপা যা বোঝার বুঝল।
মা ছোটন কে ভীষণ ভালোবাসতেন। দীপা হুহু করে কাঁদতে শুরু করে।
এরপর সংসারে অন্ধকার নেমে এল।
বাবা আধ পাগল হয়ে গেলেন। ঠিক মতো নাওয়া-খাওয়া নেই ... অফিসও যান না।
রাজনগর থেকে বাবার সঙ্গে রাঙা মাসী এসেছিল। সারাক্ষণ দীপাকে ধমকের ওপর রাখে রাঙে। তার নানা যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। বাবা অবশ্যি স্বাভাবিক হয়ে এল। নিয়মিত অফিস যেতে শুরু করলেন।
রাঙা মাসী বাবার ঘরেই শোয়। আড়াল থেকে গা শিরশিরে সব দৃশ্য দেখে দীপা। মাকে বাবা এত সহজে ভুলে গেল কি করে? আশ্চর্য!
বছর খানেক কাটল। না, তারও বেশি কাটল। মা ফিরে এল না।
দেখতে দেখতে শীতকালও চলে এল। রূপনগর সকাল বিকাল ঘন কুয়াশায় ডুবে যায়। দুপুরে কেবল ঝলমল করে রোদ। আকাশটা আর দূরের পাহাড় নীল হয়ে থাকে। স্কুলের জানালা দিয়ে সেই নীলাকাশের দিকে সেই নীল পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে দীপা।
তাকিয়ে থাকে দূরের পাহাড়ে দিকে। ওর হৃদয়ের মাঝারে গুঞ্জরিয়া ওঠে এক বিষন্ন গান:
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা
আন্মনা যেন দিক্বালিকার ভাসানো মেঘের ভেলা। ।
একদিন বিকেল।
দীপা চৈতিদের বাড়ি থেকে ফিরছিল ।
চৈতিই তো এখন ওর সুখ-দুঃখের সাথী। বাবা আর রাঙা মাসী অজাচার করছেন-এই কথাটা জীবন কাকা কীভাবে যেন টের পেয়েছিলেন ব্যাপারটা। একদিন তিনি দীপাকে বললেন, মা, দেখ, জীবন যেমন সুন্দর ... তেমনি কুৎসিত । তুমি শুধু জীবনের সুন্দর দিকটিই গুরুত্ত দিয়ো। তাহলে বেঁচে থাকা সহজ হবে।
ঐ দেখ মা ... বলে তিনি জানলা দিয়ে দূরের অপরাহ্নের ঝলমলে আলোয় ডুবে থাকা পাহাড় ও নীলাকাশ দেখিয়েছিলেন। তারপর, দীপার কপালে আলতো করে চুমু খেয়েছিলেন। দীপা শিউরে উঠেছিল। সেই জীবন কাকা আজ বাড়ি ছিলেন। মুড়ি মাখা খেতে খেতে বললেন, জান মা, আমিও না একবার ছেলেবেলায় হারিয়ে গিয়েছিলাম।
চৈতি অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে বাবা?
প্রতিবছর আষাঢ় মাসে ঈশ্বরপুরের ভবের হাটে চরণ ঠাকুরের মেলা বসে। সেই মেলায়।
এক মুঠ মুড়ি মুখে ফেলে দীপা বলল, ভবের হাট কোথায় কাকু?
ঈশ্বরপুর স্টেশন রূপনগরের দু’ স্টেশন পর। সেই ঈশ্বরপুর রেলস্টেশনের খুব কাছেই ভবের হাট । রেললাইনের পাশ দিয়ে পথ।
দু’পাশে উচুঁ উচুঁ কড়–ই গাছ, ইউক্যালিপটাস গাছ।
চৈতি বলল, বাবা তুমি হারিয়ে গেলে। তারপর কী হল?
তারপর সন্ধ্যাবেলা বাবাকে দেখলাম ঈশ্বরপুর রেলস্টেশনের কাছে দাঁড়িয়ে। পরে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কী কাঁদাই না কাঁদল ...
চৈতিদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। তালপুকুরের ধার দিয়ে হাঁটছিল দীপা।
চারিদিকে কুয়াশা ঘনিয়ে উঠছে। ভেজা ঘাস পাতার গন্ধ পেল ও। আর শীত লাগছিল। দীপা কামিজের ওপর সোয়েটার পরে ছিল। তার ওপর চাদর জড়িয়েছে।
ভালো করে চাদর জড়িয়ে নিল দীপা।
হঠাৎ মুখ তুলল দীপা। চমকে উঠল। বুড়িমা। এদিকেই আসছে ।
ওর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। বুড়িমা একই রকম আছে। বুড়িমার বয়স বাড়ে না।
বুড়িমা কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়াল। কেমন আছিস রে?
দীপা চুপ করে থাকল।
তারপর বলল, ভালো না বুড়িমা।
কেন রে? তোর আবার কি হল? নাগর তর বুকের মধু খেয়ে পালিয়েছে?
ধ্যাত।
তাহলে?
কেন তুমি জান না বুড়িমা?
আমি কী জানব রে? আমি আজই ফিরলাম ঈশ্বরপুরের ভবের হাট থেকে।
ঈশ্বরপুরের ভবের হাট ? দীপা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে উঠল কয়েক মুহূর্তের জন্য। দ্রুত সামলে নিয়ে দীপা বলল, আমার ছোট ভাই ছোটন-কে তোমার মনে আছে বুড়িমা ?
হ্যাঁ রে।
খুব মনে আছে। একবার ওর দাঁতে পোক হল, তখন আমিই পোক ফেলে দিলাম, কেন তোর মনে নেই?
হ্যাঁ। আমার মনে আছে বুড়িমা। সেই ছোটন শ্যামলদার সঙ্গে সেই যে রাজনগরে আষাঢ়ী মেলায় গেল ... আর ফিরে এল না। আমরা কত খুঁজলাম ছোটনকে।
পেলাম না। তারপর ছোটন কে খুঁজতে বেরুল মা । মা আর ফিরল না।
বলিস কী রে! এযে বড় সর্বনেশে কথা। বুড়িমার কন্ঠস্বর কেমন কর্কস শোনাল।
দীপা চুপ করে থাকে। বুড়িমা কি জানে-মায়ের নিরুদ্দেশের পর কতবড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। সাজানো সুখের সংসার এলোমেলো হয়ে গেল। আজও রাঙা মাসী বিশ্রী ব্যবহার করেছে দীপার সঙ্গে। মহিলার মেজাজ বড্ড খিটখিটে।
রাঙা মাসী দীপাকে বকাঝকা করলে বাবা কিছু বলে না। দীপার খুব কান্না পায়। রাধা কেও রাঙা মাসী বকত। যে কারণে রাধা আর থাকল না- কাজ ছেড়ে বড়লেখায় চলে গেল। সংসারের সব কাজ এখন দীপাকেই করতে হয়।
দীপা আর পারছে না। বাড়ি ছেড়ে দীপা পালিয়ে যাবে ঠিক করেছে। ইচ্ছে করে রূপনগর স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠে। তারপর ইচ্ছেমতন কোনও স্টেশনে নেমে দু’চোখ চোখ যে দিক যায় চলে যায়। তারপর যা হবার হবে ... কিংবা মা আর ছোটনের সন্ধাবে বেরুবে দীপা।
ওদের সন্ধানে এক জীবন পাড় করে দেবে। বুড়িমার মতো। সংসারে অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা । বাবা আর রাঙা মাসী অজাচার করছেন। খিদে সহ্য করা যায়, অজাচার সহ্য করা বড় কঠিন।
বুড়িমা খনখনে গলায় বলল, ভবের হাটের চরণ ঠাকুরের মেলায় তোমার মায়ের মতো একজনকে দেখলাম মনে হল যেন। আমার চোখের ভুলও হতে পারে। তবে মেয়েটা যেন তোমার মায়ের মতই দেখতে।
দীপার বুক ধক করে ওঠে। কোথায় বললে বুড়িমা?
ঈশ্বরপুরে।
ভবের হাটের চরণ ঠাকুরের মেলায় ।
কবে দেখলে? দীপার বুক ভীষন কাঁপছে।
গতকাল।
দীপার আর শীত লাগছিল না। বরং ও সারা শরীর জুড়ে তাপ টের পায়।
দরদর করে কাঁপছিল। মা কি তাহলে ...বুড়িমার ভুলও তো হতে পারে। হোক ভুল। তবু একবার ঈশ্বরপুরের ভবের হাটে যেতেই হবে।
বুড়িমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চট জলদি বাড়ি ফিরে এল।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ঘরদোর অন্ধকার হয়ে ছিল। আর ফাঁকা লাগছিল। বাবা অফিস থেকে ফেরেনি। রাঙা মাসী কি ঘুমাচ্ছে ? অলক্ষুনে মাগী সন্ধ্যাবেলায় বাতি নিভিয়ে ঘুমায়।
রাধা থাকলে আলো জ্বালাত, ধূপ জ্বালাত। আজ ঘরদোর সুগন্ধীহীন পড়ে আছে। একটি সুখের সংসার কী ভাবে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। দীপার কান্না পায়। তবে ও সামলে নিল।
খালি হাতে কি ঘর ছেড়ে বেরুনো যায়? দীপার কিছু জমানো টাকা ছিল; টাকাগুলি নিল। তারপর ঘর থেকে বেড়িয়ে এল।
চারিদিকে কুয়াশার চাদরের সঙ্গে জোছনা মিশে আছে।
স্টেশনে পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম।
টিকেট কিনে এনে। রূপনগর স্টেশনে টিকেট বিক্রি করেন বিজয় কাকা । চোখে কম দেখেন বিজয় কাকা। দীপাকে চিনতে পারল না। প্ল্যাটফর্মে হলুদ আলো জ্বলে ছিল।
ট্রেন না আসা অবধি বেঞ্চিতে বসে থাকল দীপা। ভিতরে ক্ষীন উত্তেজনা টের পাচ্ছে; জীবন কাকার সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়। দেখা হলে দীপা কি বলবে? বলবে মা আর ছোট ভাইকে খুঁজতে ঈশ্বরপুরের ভবের হাটে যাচ্ছি?
স্টেশন কাঁপিয়ে ট্রেন এসে থামল।
যখন আবার ছাড়ল তখন ৮টা বেজে গেছে । ফাঁকা কামরা।
একজন যাত্রীও নেই। দীপা অবাক হয়ে যায়। একজন যাত্রীও নেই কেন। ওর শীত করে। জানালার বাইরে ম্লান জোছনা।
তবে হুহু করে শীতের বাতাস ঢুকছিল। ও জানালা বন্ধ করে দেয়। অন্য জানালা দিয়ে অবশ্য শীতের বাতাস ঢুকছিল। সবগুলি জানালা বন্ধ করা সম্ভব না। কামিজের ওপর সোয়েটার পরে ছিল।
তার ওপর চাদর। ভালো করে চাদর টেনে নিল ।
ঘন্টা দুয়েক পর ঈশ্বরপুর স্টেশনে ট্রেন থামল। ততক্ষণে কুয়াশা আরও ঘন হয়ে উঠেছে। দীপা এক বুক শূন্যতা নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামল।
নির্জন কুয়াশাময় স্টেশন । কেমন থমথম করছে। প্ল্যাটফর্মে কাউকে চোখে পড়ল না। দীপা হাঁটতে থাকে। চারিদিকে কুয়াশা ঘনিয়ে উঠছে।
ভবের হাটে যেতে হবে। কিন্তু কোথায় ভবের হাট? মনে পড়ল: আজই জীবন কাকা বলেছিলেন ... ঈশ্বরপুর রেলস্টেশনের খুব কাছেই ভবের হাট । রেললাইনের পাশ দিয়ে পথ। দু’পাশে উচুঁ উচুঁ কড়–ই গাছ। ইউক্যালিপটাস গাছ।
দীপা রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ভেজা ঘাস পাতার গন্ধ পেল ও। পায়ের শিশির জড়ায়। মাথা ভিজে যাচ্ছে শিশিরে। চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে নিল।
ঘন কুয়াশারা ওকে ঘিরে রেখেছে। বাঁ পাশে রেল লাইন। কুয়াশার চাদর ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ।
বহুদিন আগে দেখা একটি স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায় ওর ।
দীপা মুখ তুলে দেখে কুয়াশা ফুঁড়ে দুটি মূর্তি এগিয়ে আসছে...দীপার বুক ধক করে ওঠে।
মা! মায়ের পাশে কে যেন। ছোটন?
দীপার ঘুম ভেঙে যায় ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।