শেষ বলে কিছু নেই
এই গীর্জা সংলগ্ন মেসবাড়িতে কোন কোন রাত আসে বড় বেশি নৈঃশব্দ নিয়ে; মাঝে মাঝে নিয়মমত গির্জার ঘন্টা বেজে ওঠে, কিন্তু নিস্তব্ধতার স্থিতধী সমুদ্রে কতিপয় ঘন্টাধ্বনি কোন ঢেউ তুলতে সক্ষম হয় না ; এ যেন মৌনতার এক কৃষ্ণ-গহ্বর- শব্দতার একটি দু’টি রেণু পলকে গিলে ফেলে; এ এমন এক মৌনতা যার ভেতরে জাগতিক সব রকম জিনিশ এমনকি জীবন কিংবা মৃত্যুর তরঙ্গও কেমন নিরর্থক মনে হয়; নিষ্কম্প অন্ধকারের ভেতর শুয়ে থেকে আমি অনুভব করেছি আমার মগজের ভেতরে কোন সংকেত নেই, সেখানে এই ঘরের চৌকো অন্ধকারের মতই এক প্যারালাল প্রতিভাস ; মগজের অন্ধকার ঘরে তখন কী এক শান্তি শুয়ে থাকে; সে শান্তির কোন মানে থাকে না, কেননা তা অস্তরীভূত; অস্তরীভূত সেই ভৌতিক শান্তির শরীর বেয়ে সেইসব রাতে হিমবাহের মত এক ধরনের ঘুম নেমে আসে; সেই ঘুমের ভেতর সিগনিফিকেন্ট কোন স্বপ্ন থাকে না- না দুঃস্বপ্ন না সুখস্বপ্ন না কোন অবচেতন শব্দজট...
এরকম রাত কখনো নক্ষত্রের মত জ্বলে ওঠে, আবার নিভে যায়।
নক্ষত্র নিভে গেলে কৃষ্ণ-গহ্বর থাকে।
কিন্তু এরকম রাত নিভে গেলে কোন ছাই-ভষ্ম থাকে না।
কিছু না, কেবল শূন্যতা।
আবার এর উল্টো এক ধরনের রাত কখনো সখনো আসে এই মেসবাড়িতে।
এক ঝলক বাতাস বয়ে গেলেই সব জিনিশ মুহূর্তে কেমন তরঙ্গ-সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে; মশারীর মধ্যে চৌকো অন্ধকার দোলে, মশারী দোলে যেন পেরেক থেকে ছিড়ে যাবে সুতো; দেয়াল থেকে দুমড়ে মুচড়ে টাল খেয়ে মেঝেতে পড়ে চে গুয়েভারা; মেসরুমের দরজার মরচে পড়া কব্জায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ ওঠে; আমি চমকে উঠি। দরজাটা ভেঙে পড়বে না তো ? আমি ১২ বছর ধরে এখানে আছি, এই ১২ বছরে অনেকখানি লৌহ অনেকখানি অক্সিজেন খেয়ে ফেলেছে নিজের মুদ্রাদোষে ; কব্জা খসে গিয়ে দরজা ধ্বসে পড়বে না তো ? আমি টের পাই, ভাঙনের মিহিদানা শব্দ ওঠে ওখান থেকে, এ শব্দ আমার পরিচিতি; পেরেসত্রৈকার মত এ শব্দ।
গির্জায় ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজে; ঘন্টাওয়ালা হয়তো ক্ষান্ত হয় পরক্ষণেই, কিন্তু প্রতিধ্বনি বাজতেই তাকে ঢং- ঢং-ঢং- এবং জ্যামিতিক হারে তার তীব্রতা বাড়তে থাকে; আমি অন্ধকারে উৎপ্তি হই; আমার উত্তেজিত হাতের প্রক্ষেপণে অন্ধকার বিশাল ঢেউয়ের মত তেড়ে গিয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ে; ছলাৎ করে শব্দ হয় আর ছলাৎছল অন্ধকারে আমি ডুবে যেতে যেতে দু’হাতে মাথার চুল খামছে ধরি; চুল থেকে ধান গাছের শরীরের মত এক উদ্ভিজ্জ্ব উষ্ণতা আমার হাতে নেমে আসে; আমার মাথা যেন আদিগন্ত ধানক্ষেত; সোনারঙা থোকা থোকা পোয়াতি ধান; সবুজ বিপ্লবের গন্ধে ভরা উফশী ধান; উপচে পড়ছে ধান; উদ্বৃত্ত ধান কেথায় যেন চলে যাচ্ছে; আমি দেখতে থাকি, উদ্বৃত্ত ধান রূপকথার এক পাহাড়ের খোড়লে জমা হচ্ছে; জমতে জমতে পচে যাচ্ছে; পচা ধান থেকে মিথেনের মত এক মদিরগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিক; আমি দেখতে থাকি, কতিপয় পাখি ধানের মদির গন্ধে কেমন ঢুলতে থাকে, ঢুলতে ঢুলতে পাখিরা স্বপ্ন দেখে; স্বপ্ন দেখতে দেখতে যুবক পাখিরা বুড়ো হতে থাকে, আর বুড়ো পাখিরা নতুন জন্মের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে...
ঢং ঢং করে গির্জার ঘন্টা বাজতে থাকে; আমার অস্থিরতা দুরপনেয় দুর্নিবার হাতে থাকে; আমি অস্থির পায়ে হাঁটতে থাকি লালচে মাটির পথে; চারদিকে অশান্ত বাতাসে শিমুল তুলো উড়াউড়ি করছে; মাথার উপর শরৎ নাকি হেমন্ত নাকি বসন্ত নাকি শীত নাকি গ্রীষ্মের টগবগে সূর্য বুঝতে পারি না; কিন্তু আমাদের স্বপ্নের সানুদেশে ঢুকে আছে যে সূর্য- তা অনেক বেশি লাল- এত লাল যে স্বপ্নের ত্বক ফুঁড়ে রক্ত-মাংসে এসে তার লালচে উত্তাপ লাগে; আমার লাগে, আমার বন্ধু দবিরের লাগে, অশোকের লাগে... অনেকদিন আগে অশোক, হ্যাঁ অশোকই তো একটা বই আমার হাতে এক প্রকার গছিয়ে দিয়ে বলেছিল, পড়ে দেখ এর মধ্যে সূর্য আছে...। বইটার লাল মলাট, লাল গ্রাউন্ডের ওপর ছোট কালো বৃত্তের মধ্যে একজন সন্নাসীর আবক্ষ ছবি; কেমন হিপনটিক চোখ তার। আমি অশোককে বইটি ফেরত দিতে গিয়ে বলেছিলাম- শুধু এটুকু বলেছিলাম, চল্ শ্বেত ব্যারিকেডগুলো ভেঙে ফেলি...
ও আমাকে নিয়ে গেল; একে একে দবিরকে চিনলাম, তিতুমিরকে চিনলাম, আরো চিনলাম খদ্দরের পাঞ্জাবি আর কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝোলানো কিছু হঠাৎ আগন্তুককে যাদের স্বপ্ন আরো অনেক গভীর এবং পরিব্যাপ্ত।
খাটের উপর মশারীটা ‘মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মত ফুলে ওঠে’; চে গুয়েভারা উতাল বাতাসে মেঝেময় ছেচড়াতে থাকে; কব্জার ক্যাঁচক্যাঁচানি আরো একটু বাড়ে; এর মধ্যেও আমি বুঝতে পারি, খাটের নিচে কিচির মিচির করছে কিছু প্রাণী- ওরা ইঁদুর; ১টি ২টি কিংবা অনেক, তবে দুটি ইঁদুর নিয়ে ভাবতে আমি অধিক পুলক বোধ করি; দুটি ইঁদুর হলে ঢের মজা হয়; ভাবা যাক একটি ছেলে ইঁদুর, অন্যটি মেয়ে; আমার খাটের নিচের পৃথিবীতে ইঁদুরযুগল ধুমছে গোল্লাছুট খেলে ; গোল্লাছুট না কি বুড়ির চি’? যাই খেলুক, ক্ষণে ক্ষণেই ওরা একে অপরকে ছোঁয়; ছোঁয় আর পুলকিত হয়- হবেই তো, ওরা শৈশব কৈশোর পার হয়ে এসে এখন যৌবনের পৃথীবিতে অভিযোজিত; নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি কোন দিন বুড়ির চি’ কিংবা গোল্লাছুট খেলেছি? খেলেছি, কৈশোরে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের মত কিশোরীদের সাথে; সেইসব কিশোরীরা অনেক দিন আগেই নারী হয়ে গেছে, আমিও পুরুষ হয়ে গেছি, কিন্তু কোন নারীর সাথে আর গোল্লাছুট খেলা হয় নি; হয় নি কেন? আমার স্বপ্নে কোন নারী ছিল না, ছিল খেবল টগবগে লাল এক সূর্য। ইঁদুরযুগল গোল্লাছুট খেলে চলে, আর ওদের প্রতিটি তরঙ্গ কম্পন আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে অনুরণিত হতে থাকে; ওরা খেলে খেলে ক্লান্ত হতে হতে এক নিবিড় নির্জন সুখের দিকে এগোতে থাকে...
কব্জার ক্যাঁচক্যাঁচানি আরো বাড়ে; দরজাটা খুলে আসতে চায়; দরজাটা এখন ভেঙে পড়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত;
আজ হোক কাল হোক পরশু হোক মেরামতের উল্টা বাতাস না লাগলে ভেঙে ওকে পড়তেই হবে; ভাঙনের ইঙ্গিত আমি বুঝতে পারি; অনেকেই পারে না; যে পারে সে এই বঙ্গদেশে বসে সুদূর ইউরেশিয়ার ভাঙনের ইঙ্গিতও বুঝতে পারে; যারা বুঝতে পারে তারা কেউ কেউ বুঝতে পেরে বুক চাপড়ে হাহাকার করে ওঠে, কেউ কেউ হাত গুটিয়ে বসে থাকে, কেউ কেউ রোষে জ্বলে ওঠে আবার কেউ কেউ নিষ্করুণ টার্ন নেয়; যেমন নিয়েছে দবির অশোকেরা; সেদিন দবিরের সাথে কথা হর তার অফিসে; একটা মাল্টিল্যাটারাল ডোনার এজেন্সির কান্ট্রি ডিরেক্টর দবির আমাকে বলে, তোর মাথার চুল তো অর্ধেক হাওয়া। এখন কিছু একটা কর।
আমি বলি,করব।
দবির বলে, তাহলে নিজে কিছু কর।
আমি বলি, না ।
ও বলে,এখনও আলেয়ার পেছনে ছুটছিস? পার্টি অফিসে যাস? কেউ যায়?
আমি হ্যাঁ-না’র মাঝামাঝি মাথা নাড়ি।
ও বলে, তুই কি আউট হয়ে গেছিস?
আমি হ্যাঁ-না’র মাঝামাঝি মাথা নাড়ি।
দবির বলে, তোর মেন্টালে যাওয়া উচিৎ।
অশোক দিয়েছিল অন্য সিদ্ধান্ত।
...স্বপ্ন হচ্ছে দিল্লীকা লাড্ডু, খেলেও পস্তাবে না খেলেও... আর কতকাল লাড্ডু খাবি রে হারামজাদা...। একথা সে বলছিল ডিভি লটারি জিতে আমেরিকায় পাড়ি দেবার প্রাক্কালে; আমি, দবির আর তিতুমির অশোককে সি অফ করতে গিয়েছিলাম এয়ারপোর্টে; অশোকের প্লেন উড়ে গেল আর আমি উপলব্ধি করলাম আমার তলপেটে অসহনীয় চাপ, প্রস্রাবে ব্লাডার ফেটে যাচ্ছে, অগত্যা ঢুকে পড়লাম এয়ারপোর্টে টয়লেটে; তখন চেন খুলে ভারমুক্ত হতে হতে আমার মনে হয়েছিল, যদি প্রস্রাবের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারতাম গোটা এয়ারপোর্ট! কিন্তু মানুষের যৌনাঙ্গের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, ম্যাক্সিমাম সে সন্তান উৎপাদন করতে পারে, তার বেশী কিছু না!
ইঁদুরযুগলের গোল্লাছুট শেষ; ওরা এখন খাটের নিচে ঠিক মধ্যবিন্দুতে নির্জনতার এক অতীত নির্জনতায় মুখোমুখি, আমি টের পাই, আমার নিতম্বের ঠিক নিচে; ওদের কিচির মিচির এখন অনেক চাপা, তীক্ষ্ণ এবং ধাঁরালো। আবার একটা পাগলা হাওয়ার ঝলক আসে; বিকট শব্দে জানালা বাড়ি খায়; ঘরের অন্ধকার দুলে ওঠে; জানালায় চাঁদ, জোসনায় পুড়ে যেতে থাকে মরচে পড়া ন্যাতনেতে গ্রিল...
ইঁদুরযুগলের চাপা চিৎকার এখন আপাপ শীৎকার; আমি বুঝতে পারি, ওরা এখন পরষ্পর উপগত; খাটের নিচেয় চৌকো অন্ধকারে এক অলৌকিক আলোর বন্যায় ভেসে যায় ওরা; আমার নিতম্বে তার উত্তাপ উড়ে এসে লাগে, উত্তাপ সঞ্চালিত হয় রক্তে; আমি মৃদু কাঁপতে থাকি, কাঁপতে কাঁপতে আমার দীর্ঘদিন ধরে ট্রাঙ্কে তুলে রাখা শরীরের গুপ্ত গহ্বর থেকে একটা ঢাকনা টুস্ করে খুলে যায়; আমার হাতের ভেতর অন্য হাত, আমার রাতের ভেতর ঢুকে পড়ে অন্য রাত; আমার হাত এবং রাতের ভেতর একসময় আমি বিস্ফোরিত হই; ছলকে ছলকে বেরিয়ে আসে ম্যাগমার মত তপ্ত রোষ;
প্রথম ছলক পড়ে, আমি মনে মনে বলি, দবির এটা তোর উদ্দেশে;
দ্বিতীয় ছলক পড়ে, আমি মনে মনে বলি, অশোক এটা তোর উদ্দেশে;
তৃতীয় ছলক পড়ে,আমি মনে মনে বলি, হে আমার একাকীত্ব, এটা তোর উদ্দেশে;
তারপর শেষ হয় গল্প; আমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি এবং অবধারিতভাবে স্বপ্ন-রাজ্যে প্রবেশ করি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।