মেঘমুক্ত নীলাভ দিঘীর কবোষ্ণতা খুঁজছে মন!
সেদিন আমাদের ওয়ান্ডার বয়েজ ক্লাবের মিটিংয়ে হাবু ভাই বেশ খেপে গেলেন, ‘কী বললি, হারুন মিয়ার কাছে চাঁদা তুলতে যাসনি, ক্যান শুনি?’ কারণটা হাবু ভাই ভালো করেই জানেন, তার পরও বৃথা আমাদের জেরা।
‘না, এ তোদের ভীষণ অন্যায়। হারুন মিয়ার কাছে হেরে যাওয়া, এইভাবে হারু হওয়া, এ তোমাদের দারুণ অবহেলা। ’
‘হাবু ভাই, তার কাছে যেতে আমাদের আত্মসম্মানে বাধে। ’ শেষমেশ জবাব দিই।
শুনে হাবু ভাই এমন মুখভঙ্গি করলেন, যেন আমি বলেছি যে উড়বার জন্য আমার পিঠে চমৎকার এক জোড়া রঙিন পাখা গজিয়েছে।
হারুন মিয়া আমাদের পাড়ার ৬ নম্বর বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় দুই রুমের এক বাসা নিয়ে বহুদিন ধরে বসবাস করছেন। মগবাজারে তাঁর একটি আইসক্রিম ফ্যাক্টরি আর খিলগাঁও এলাকায় কয়েকটি কাপড়ের দোকান আছে। টাকা-পয়সা অঢেলই বলা চলে। কিন্তু তাঁর মতো হাড়কিপটে লোক দ্বিতীয়টি আছে কি না গবেষণার বিষয়।
গত বছর আমাদের ক্লাবের বার্ষিকীতে যখন চাঁদা তুলতে গিয়েছি, তখন প্রায় আধঘণ্টা জেরা করে পাঁচ টাকা দিয়েছিলেন। এই বিশাল এবং অতিকায় দানের জন্য, এই অহেতুক বদান্যতার জন্য ওই মাসটা যে তাঁর খুব টানাটানিতে কাটবে, তা তাঁর হাবভাবে জানা গেল। পাঁচ টাকা হাতে করে যখন আমরা বিধ্বস্ত অবস্থায় বেরোলাম, তখন পাড়ার ভিক্ষুক কদম আলীকে আমাদের মাসতুতো ভাই বলে প্রথম উপলব্ধি করলাম। তারপর থেকে হারুন মিয়াকে দেখলেই আমাদের জিতু কেমন শিউরে উঠত। ও একটু ইমোশনাল।
তাই এই বছর যখন আমাদের ক্লাব থেকে আবার সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো, সেই আয়োজনের প্রয়োজনে এবং প্রতিজনে ব্যাপারটা জানান দেওয়ার জন্য চাঁদা তুলতে বেরিয়েছি, তখন হারুন মিয়ার দরজাটা এমনভাবে এড়িয়ে গেলাম, যেন ওটা মিসরের কোনো ফারাওয়ের অভিশাপপুষ্ট সমাধির ফটক।
কিন্তু আমাদের হাবু ভাই-যিনি নিজেকে নেপোলিয়নের মতো দিগ্বিজয়ী ভাবতে ভালোবাসেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত ডিকশনারিতে অন্য অনেক শব্দের মতোই ‘অসম্ভব’ শব্দটা নেই বলে প্রায়ই বড়াই করেন-এই অর্থের ক্ষতি কিছুতেই মানতে পারলেন না।
তিনি তাঁর স্বরচিত নানা উপায়ে আমাদের প্ররোচিত করতে লাগলেন।
‘দেখ, তোরা যদি সঠিক কায়দা মেনে এগোস, তবে ফায়দা লোটা মোটেও কঠিন নয়। যদিও তাঁর সঙ্গে আমাদের আদায়-কাঁচকলার সম্পর্ক, তবু চাঁদা আদায়ে কাঁচকলা এড়ানো মোটেও অসম্ভব নয়।
জিতু বলল, ‘কাঁঠালের আমসত্ত্বও অসম্ভব নয়। ’
তুই বেশি বকছিস জিতু, যেভাবে বলছি সেইভাবে হারুন মিয়ার কাছে তোরা ফের যাবি-এই আমার শেষ কথা।
‘অ্যাতো যখন, তুমিই যাও না হাবু ভাই। আর শুনে রাখো, পুরো না হোক, অর্ধেকটাও যদি গছাতে পারো-এই বলে দিচ্ছি, আজ থেকে আমার নাম জিতু না, হারু। ’ রীতিমতো জিতুর চ্যালেঞ্জ ঘোষণা।
এত বড় কথার পর তো হাবু ভাই চুপ করে বসে থাকতে পারেন না, যদিও হাবু ভাই আমাদের ‘ওয়ান্ডার বয়েজ’ ক্লাবের চেয়ারম্যান। তাই তিনি চাঁদা তোলার মতো এত মাঠপর্যায়ের কাজে নামেন না। ক্লাবের অন্যান্য জটিল কাজ যেমন কীভাবে কোথায় কত খরচ করতে হবে, ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি, নানা আয়োজনের প্লানিং ইত্যাকার বিষয় নিয়ে ভাবিত থাকেন। আর প্রয়োজনবোধে যখন তখন ক্লাবের খরচে ভূরিভোজন, সিনেমা দেখা ইত্যাদিও তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে বটে। কিন্তু জিতুর এই চ্যালেঞ্জ হেতু তিনি আর জিতুর মতো বসে থাকতে পারলেন না।
সবেগে বেরিয়ে পড়লেন হারুন মিয়ার ফ্ল্যাটের উদ্দেশে। আমরাও পিছু নিই তার তৎক্ষণাৎ।
‘স্লামালাইকুম চাচা’, হারুন মিয়া দরজা খুলতেই হাবু ভাইয়ের সূচনা। এক দঙ্গল ছেলে দেখে হারুন মিয়া চমকালেন কি না বোঝা গেল না।
‘অলাইকুম সালাম, তা বাবারা তোমরা এই সন্ধ্যার সময়?’
অত্যন্ত বিনীতভাবে উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন হাবু ভাই।
সংগীতের মতো একটি মহতি আয়োজনে অংশীদার হওয়া যে বিরাট হৃদয়ের কাজ, তা চমৎকারভাবে ব্যক্ত করলেন। চাঁদা দেওয়ার কাজটা যে কত মহৎ, সেটা এই এত দিনে হাবু ভাইয়ের বক্তব্য শুনে মনে হলো।
বক্তব্য শেষ হতেই হারুন মিয়ার গোমড়া মুখে হোমরা-চোমরা হাসি ফুটল, ‘বাহ্ বেশ বলেছ তো! তাহলে তোমরা চাঁদা চাইতে এসেছ তো?’
আমরা সম্মতিসূচক মাথার ঊর্ধ্ব-নিম্ন সঞ্চালন প্রদর্শন করি হাস্যমুখে।
‘তাহলে দাঁড়াও, দিচ্ছি তোমাদের। ’
আমরা তো অবাক।
হাবু ভাইয়ের তো সত্যি জাদু আছে! এত সহজে হারুন মিয়া রাজি। হারুন মিয়া ভেতরের ঘরে ঢুকতেই বিজয়দীপ্ত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চাইলেন হাবু ভাই।
কিন্তু খানিকক্ষণ পর হারুন মিয়া যে বস্তু হাতে নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হলেন, সেটা চাঁদাই বটে; তবে তা একমাত্র জ্যামিতি বক্সেই পাওয়া যায়।
‘এই নাও চাঁদা, খুব ভালো জিনিস। বছর দশেক আগে যখন প্লাস্টিকের ব্যবসা করতাম, তখন এগুলো বানাতাম, বুঝলে।
এখনো কতগুলো রয়ে গেছে। এত করে যখন বলছ, তা নাও না একটা। ফ্রিই দিচ্ছি। এতগুলো ছেলে এসেছ যখন। ’
ততক্ষণে হাবু ভাই পাংচার হয়ে গেছেন।
কিন্তু আমরা যেখানে হাল ছাড়ি, হাবু ভাই সেখানে হালখাতা খোলেন। আমরা যখন বেহাল দশায় পড়ি, সেখানে হাবু ভাই নতুন উদ্যমে বেহালা বাজান। অর্থাৎ কিনা হাবু ভাইকে নিরস্ত্র করার মতো অস্ত্র খুব কমই আছে। তাই তিনি এবার কথাটা সরাসরি পাড়লেন,
‘দেখুন চাচা, আপনার ওই জ্যামিতির চাঁদা আপনিই রেখে দিন। অনুষ্ঠানের খরচের অংশীদার হিসেবে আমরা চাঁদা বা বকশিশ বা যেভাবে আপনি বোঝেন, এক শ টাকা করে ধার্য করেছি।
ওইটেই আমাদের দিন। ’
‘অ্যা, কী বলছ?’ অনেকক্ষণ হারুন মিয়ার মুখ থেকে কোনো বাক্যব্যয় হয় না। ‘অ্যা, অ্যাক শো-ও-ও টাকা? অ্যা, বলছ কী তোমরা!’
‘হঁ্যা, এক শ টাকা। তবে যদি আরও বেশি দিতে চান, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, গুরুদান আমরা হাসিমুখেই গ্রহণ করব। ’ হাবু ভাই তাঁকে আশ্বাস কিংবা অভয় দেন।
কিন্তু হারুন মিয়া আশ্বস্ত হন, না তাঁর আশার অস্ত হয়-কিছু বোঝা যায় না।
‘না-না, এ তোমাদের বাড়াবাড়ি, তোমাদের বয়সে ওই জ্যামিতির চাঁদা ছাড়া অন্য কোনো চাঁদা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। তার চেয়ে শোনো, আমি না হয় তোমাদের অনুষ্ঠানে একটা গান গেয়ে দেব। তাতে হবে না!’
শুনে আমরা আঁতকাই।
সবাই সমস্বরে ‘না’ বলে উঠি।
আমাদের এই নাক্কারে তিনি মর্মাহত হন। তারপর খানিকটা ভেবে হঠাৎ বলেন, ‘আচ্ছা না হয় দেব, কিন্তু অর্ধেক। ’
আমরা তো লাফিয়ে রাজি। কিপটে হারুন মিয়ার কাছ থেকে ৫০ টাকা বাগাতে পারলে আমাদের নাম তো এই পাড়ার ইতিহাসে অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে।
কিন্তু আমাদের লিডার হাবু ভাই গোঁ ছাড়ে না, ‘না চাচা, তা কেন।
সবাই পুরোটা দিল, আপনি তা-ই দিন। ’
জবাবে হারুন মিয়া যা বললেন তাতে অবাক হলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা ছাত্র, তাই না?’
সমস্বরে ‘হঁ্যা’ বলে আমরা ছাত্রদের প্রমাণপত্র দাখিল করি।
‘তাহলেই বোঝ, প্রবাদ আছে 'ছাত্র নং অর্ধনং তপঃ' অর্থাৎ ছাত্র মানেই অর্ধেকের কারবার। অর্ধেকের তপস্যা।
তোমরা যেমন অর্ধেকটা খেলাধুলা করবে, তেমনি পাশাপাশি পড়ালেখাও চালাবে। বন্ধুর টিফিনের অর্ধেকটা মারবে আর বাকি অর্ধেকটা ওর জন্য দয়া করে রাখবে-এই তো তোমাদের কারবার। তাই তোমাদের চাঁদাও অর্ধেকটা দিচ্ছি কী বলো। ’
শুনে আমরা সবাই স্তম্ভিত! আমি বলি, ‘কিন্তু শব্দটা তো অর্ধনং নয়, অধ্যয়নং। ’
‘আরে রাখো, ছেলেদের আর কাজ নেই অধ্যয়ন ছাড়া, আরও ভালো বইতে এই উক্তি আছে বুঝলে; আর এ জন্যই তো তোমরা অধ্যয়ন ছেড়ে এখানে এসেছ-ঠিক কি না।
’
শেষমেশ হাবু ভাই ব্যাপারটা মেনে নিলেন। তা অর্ধেক চাঁদা পেলেও তাঁর জিতই হয়, আর জিতুর হার হয় এবং হারু হয়। ‘আচ্ছা, তা-ই দিন, না হয় অর্ধেকই দিন। ’
‘হঁ্যা, তা তো দেবই। বাড়ির কেয়ারটেকার জলিলকে ডাকছি, ও-ই দেবে।
’
‘তিনি কেন, আপনিই দিন। ’ আমরা চেঁচিয়ে উঠি। তার হেঁয়ালি আমরা বুঝি না। টাকাটা হাতে এসে ফসকে যাচ্ছে দেখে আমারা মরিয়া হই।
‘না-না, আমি দিই কীভাবে, আমার বয়স হয়েছে না! আগের মতো শক্তি আছে? জলিলই দেবে তোমাদের, খুব শক্তিশালী ছেলে ও।
’
‘মানে!’ আমরা অবাক হই। ‘এর সঙ্গে শক্তির কী?’
‘অ্যা, তাও বোঝ না। ইশকুলে কী শেখায় আজকাল! তোমাদের অর্ধেক চাঁদা দেব, অর্ধেক চাঁদাতে কী হয়-অর্ধচন্দ্র। এই বয়সে তোমাদের অর্ধচন্দ্র বা গলাধাক্কা দেওয়া কী আমার সাজে-তোমরাই বলো। এই জলিল শিগগির আয়, ছেলেগুলো কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে।
’
আমরা আর দাঁড়াই না। হাবু ভাই তাঁর চাঁদমুখ নামিয়ে আগেই নেমে যান।
বাইরে বেশ বড় একটা চাঁদ উঠেছিল। চাঁদটা তো খুব বিচ্ছিরি-এই প্রথম আমার মনে হলো।
প্রকাশিত: ২৫ জুলাই ২০০৮, দৈনিক প্রথম আলো, হঠাৎ করে অনেকদিন পর লেখাটার খোঁজ পেলাম, তাই ব্লগে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।