আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নুরজাহান আর পাথর ছুঁড়ে মারা ভন্ড ফতোয়াবাজের দল যুগে যুগে...!



নুরজাহানের কথা মনে আছে নিশ্চয়? যাঁদের মনে নেই বা যাঁরা জানেননা তাঁদের স্মরন করিয়ে দিতে চাই.. সিলেট অন্চলের চটকছাড়া গ্রামের ২১ বছর বয়সী সেই হতভাগ্য তরুনী, যাঁকে ফতোয়াবাজরা মাটিতে পুতে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলো... নাহ্.. হাজার বছর আগের কোন ঘটনা নয়। মধ্যযুগীয় ববর্রোচিত ঘটনাটি ঘটেছিলো ১৯৯৩ সালের ১০ই জানুয়ারি!! নুরজাহানের অপরাধ ছিলো, তিনি প্রথম স্বামী তালাক দেবার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলনে। কি ভীষণ স্পর্ধা! তালাক প্রাপ্তা গ্রাম্য নারী(সুন্দরী তরুনী), সে স্থানীয় হায়নাদের লালসার খোরাক না হয়ে পূণরায় ঘর বাঁধবে, সংসার করবে.. এ কেমন কথা!! তাই, গ্রামের কাঠ মোল্লারা ছলা বলে তার দ্বিতীয় বিয়ে অবৈধ ঘোষণা করে তাঁর বিরুদ্ধে “বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের” অভিযোগ এনে এই শাস্তির বিধান দেয়। নুরজাহানের মৃত্যু হলেও বিনাশ ঘটেনি, সময়ের সাথে সাথে আমাদের দেশে নুরজাহানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র। অজপাড়াগাঁয়ের গন্ডী ছেড়ে তারা চলে এসেছে, শহরে, রাজধানী ঢাকায়.. কখনও সাধারণ দোকানীর স্ত্রী, কখনও অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ীর আর সম্প্রতি তার বিচরন তারকা জগতেও।

আমাদের সমাজে পুরুষ আর নারীর যে বৈষম্য তা বোধ হয় সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠে যখন কোন অনৈতিক আচরণ, বিশেষ করে ব্যাভীচারের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ম, শ্রেনী নির্বিশেষে বিবাহপূর্ব শারীরিক সম্পর্ককে অত্যন্ত ঘৃন্য দৃষ্টিতে দেখা হয়, আর বিবাহবহির্ভূত এধরনের সম্পর্ক বা পরকীয়া অত্যন্ত নিন্দনীয়। মজার ব্যাপার হলো এই ঘৃনা ও নিন্দার পরিমান তারতম্য ঘটে শুধুমাত্র জেন্ডার বা লিঙ্গপরিচয় ভেদে!! অপরাধ নারী করলে তা শুধু অমাযর্জনীয় নয়, হাতের কাছে না পেলে মুখের কথায় বা ভার্চুয়ালী তাঁকে পতিতালয়ে পাঠিয়ে ক্ষ্যান্ত হইনা আমরা, দোররা বা পাথর নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলার উপক্রম করি। আর একই অপরাধ, এমন কি নারীর চেয়েও নৃশংস ও হাজারগুন বেশী ঘৃন্য অপরাধ পুরুষ করলে আমরা কিভাবে যেনো তা এড়িয়ে যাই। দু'একজন বিবেকবান মানুষ প্রতিবাদী হয়ে এগিয়ে এলে কেউ কেউ তাঁদের দুকথা শোনাতেও কুন্ঠাবোধ করেনা! একজন প্রভা, একজন আয়শা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে আমাদের রোষানলে পড়ে।

শুধুমাত্র পরকীয়া সম্পর্কের অপরাধে আয়শার মাতৃস্নেহকে অস্বীকার করে তাকে পুত্র হন্তারক হিসেবে প্রমানে আমরা মরিয়া হয়ে উঠি। একজন প্রভা বাগদানের পর সেই পুরুষকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করলে আমরা তাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যায় উদ্যত হয়ে উঠি.... কেনো? ২০-৩০ বছর সংসার করার পরও স্বামী স্ত্রী পৃথক হয়ে যায়, সেখানে এনগেজমেন্ট বা বাগদান অত্যন্ত ঠুনকো জিনিষ। সামাজিক বা ধর্মীয় কোন কমিটমেন্ট নেই, বিশ্বাস ও ভালোবাসার ভিত্তিতে যতোখানি বিশ্বস্ততা থাকতে পারে... আর সেক্ষেত্রে ভালোবাসাটি হারিয়ে গেলে অর্থহীন হয়ে পড়ে এই সম্পর্ক। তারপরও আমরা ক্ষেপে উঠি... কারন প্রভা প্রত্যাখাত প্রেমিকের মাঝে অনেকেই খুঁজে পান নিজের প্রতিচ্ছবি। তাই মনে মনে মেয়েটিকে নিজের (?)প্রতারক প্রেমিকা ভেবে শাস্তি প্রদানের বিকৃত উল্লাসে মেতে উঠি।

প্রভার নাম প্রথম শুনি এই স্ক্যান্ডালের পর, ঠিক যেমনটি শুনি আয়শা, ফারজানা এবং বিলাসীর নাম। আয়শা অথবা প্রভা, তাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ মূল্যবোধের অবক্ষয়, অসামাজিক কাজ করা, যেখানে সমান ভাবে অপরাধী তাদের সঙ্গী পুরুষও। আমর ক'জন সেই অপরাধের সমালোচনা করছি? ক'জন সেই পুরুষটির প্রতি সমান ভাবে ঘৃনা প্রকাশ করছি? অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কেউ কেউ সেই অসামাজিক কাজকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়ে নিজেকে বিরাট মুক্তমনা প্রমানে সচেষ্ট, এমনকি সেসব অবৈধ আচরন ভিডিও করাটাকেও স্বাভাবিক ও যুগের হাওয়া হিসেবে প্রচারে মরীয়া.. তবে সেই তথাকথিত মুক্তমনাদের মুক্তমণ অন্ধকার কুয়োর ক্ষুদ্র গন্ডীতে আছড়ে পড়ে যখন.. “প্রভা অপরাধ করেছে তার ৭ বছরের প্রেমিককে ছেড়ে গিয়ে” বলে!! হায়রে নির্বোধ (?)মুক্তমনার দল... হিপোক্রেসীর সীমাও এদের কাছে লজ্জিতবোধ করবে। অপরের ব্যাভীচার বৈধতা দিতে এদের বাঁধেনা, প্রশ্ন জাগে, এদের স্ত্রীর বা ভাইয়য়ের স্ত্রীর যদি এমন কোন ভিডিও প্রকাশ পায়, এরা কি তখন তাঁকে হাসি মুখে মেনে নিবে। আগামী কাল, এদের বোন বা কন্যা যদি তাদের দীর্ঘদিনের প্রেমিককে ত্যাগ করায় সেই কুলাঙ্গার এমনি করে ভিডিওটি ছেড়ে দেয়, সেদিনও কি তারা লাইনে দাঁড়িয়ে তার লিংক সংগ্রহ করে উপভোগ করবে? প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের প্রত সহানুভূতিশীল হবে? শুধু তাই নয়, এই হিপোক্রেটের দল একজন প্রভা বা একজন আয়শার উপর যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, একজন নরপশু রাশেদের উপর তেমন ভাবে আক্রমণাত্বক হয়ে উঠেনা।

অথচ, এই দুজনের সন্মিলীত অপরাধের চেয়ে রাশেদের অপরাধের মাত্রা অনেক অনেক বেশী। আয়শার পরকীয়ার কারনে তার একজন পুত্রের মৃত্যু ঘটেছে, আর কুলাঙ্গার রাশেদের কারনে দুজন নিষ্পাপ শিশু মৃত্যুকে আলীঙ্গন করে। একজন প্রভা তার সাত বছরের প্রেমিককে ছেড়ে আরেকজন পুরুষকে বিয়ে করেছে, আর রাশেদ তার দীর্ঘদিনের বিবাহিতা স্ত্রী, সন্তানের মা'র সাথে প্রতারণা করে পরকিয়া ও ব্যভীচারে লিপ্ত হয় এবং পরবর্তীতে বিয়ে করে। প্রভার প্রাক্তন প্রেমিকের কষ্টে সমব্যথী হয়ে আমরা জ্বলে উঠি, যদিও সেই প্রেমিক নিজেকে এক ঘৃন্য কুলাঙ্গার হিসেবে প্রমান করে। অথচ, যে মেয়েটি প্রতারক স্বামীর নির্মমতা সইতে না পেরে আত্মহনন করে আমরা সেই নরপশু স্বামীর বিরুদ্ধে টু শব্দটি করিনা।

একজন স্মৃতির বিশ্বাসঘাতকতা, কৃতঘ্নতা, ব্যাভীচারীতা আয়শা অথবা প্রভাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়, আমরা তাকে আক্রমণ করিনা, এড়িয়ে যাই তার অপরাধ কারণ তাহলে কুলাঙ্গার রাশেদকেও আক্রান্ত হতে হয়। একজন ফারজানা, একজন বিলাসী আমাদের হিপোক্রেসীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েই প্রাণপ্রিয় সন্তান সহ আত্মহননের পথ বেছে নেন। একজন প্রভা, একজন আয়শার দিকে আমরা প্রস্তরখন্ড হাতে ছুটে যাই বলেই মহিমারা আত্মহত্যা করে। একজন আরিফ, একজ রাজীব অথবা রাশেদের ব্যাপারে আমরা নির্লিপ্ত, ক্ষেত্র বিশেষে নির্লজ্জের মতো এসব কুলাঙ্গারের পক্ষ সমর্থনেও দ্বিধাবোধ করিনা, তাই এদের সংখ্যা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে... এরা নির্ভীক আর আরো বেশী নৃশংস হয়ে উঠছে। আজ যারা, এসব নরপশুর পক্ষ নিয়ে আয়শা, প্রভাদের দিকে পাথর ছুঁড়তে উদ্যত, আজ যারা একজন ফারজানার মৃত্যুতে নিরব, অপেক্ষা করুন.. আগামীতে আপনার পরিবারের মেয়েটির এমন পরিনতির জন্য।

কোন অভিসম্পাত নয়, আপনার কর্মফলের কারনেই এমনটি অবধারিত, অনিবার্য। আজ ফতোয়াবাজদের দলে ভীড়ে আর কারো কন্যা, কারো বোনের দিকে প্রস্তরাঘাত করছেন, সেদিন অন্য কেউ আপনার কন্যা আপনার বোনকে এমনটি করবে। কারণ, নারীদের জন্য প্রতিকূল এই সমাজ আপনারই সৃষ্টি। সমাজ থেকে ব্যাভীচার দূর করা জরুরী। এসব অসুস্থ চর্চার পরিনাম কখনও শুভ নয়।

আর এই অসুস্থ, বিকৃত চর্চার জন্য সংশ্লিষ্ট নারী পুরুষ সমানভাবে দায়ী, এই কথাটি জানতে বা বুঝতে অতি বড় বিদ্বান হবার প্রয়োজন নেই। নুন্যতম সাধারন বিবেকবোধ যথেষ্ট। ব্যক্তিগত ভাবে আমি রক্ষণশীল জীবন আচারের পক্ষে। তবে যে সমাজ ব্যাভীচার, বিবাহপূর্ব অনৈতিক সম্পর্ককে আধুনিকতার খোলস পড়িয়ে স্বীকৃতি দিচ্ছে, সেই সমাজ যখন শুধুমাত্র পুরুষ সঙ্গীকে প্রত্যাখ্যান করার অপরাধে নারীটির দিকে পাথর হাতে ছুটে আসছে, তাদের ভন্ডামী আর হিপোক্রেসীকে ধিক্কার জানাই। নোংরামী, অনৈতিক আচরন ততোক্ষণ পর্যন্ত বৈধ যতোক্ষণ তা পুরুষের পক্ষে যাবে, আর পুরুষের বিরুদ্ধে গেলেই তা ব্যাভীচার, মেয়েটি ভ্রষ্টা! মেয়েটি তখন হয়ে উঠে চটকদার রসালো আলাপ আর ব্যঙ্গবিদ্রুপের প্রিয় বিষয়, তাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে কষাঘাত করার অসুস্থ প্রতিযোগীতা যেনো... এমনি ভাবে প্রতিনিয়ত নিজের অজান্তে আমরা চটকছড়া গ্রামের কুখ্যাত মওলানা মান্নানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পাথর ছুড়ে হত্যায় উদ্যত হই নুরজাহানদের..... ***অত্যন্ত দুঃখজনক যে, এই লেখাটরি অংশ বিশেষ আজ থেকে প্রায় দুমাস আগে লেখা যখন আয়শা আর ফারজানার ঘটনার সময় আমাদের হিপোক্রেসী অত্যন্ত নগ্নভাবে প্রকাশ পায়।

সেসময় প্রকাশ করা হয়নি, তাতে কি.. আমাদের সমাজে নুরজাহানদের অভাব নেই.. প্রতিনিয়ত আমরা কোন না কোন নুরজাহানকে ভার্চুয়্যালী দোররা অথবা পাথর মেরে শাস্তি দিতে উদ্যত হচ্ছি!!! দুমাস আগে অথবা পরে, এমন পোস্টের প্রাসঙ্গিকতার অভাব নেই- এটা অত্যন্ত দুঃখজনক!!!!***

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।