যে মুখ নিয়ত পালায়......। ।
এই গল্প আমার। আমার চোখে দেখা গল্প। চোখের দেখা যে সব সময় ঠিক হবে তা না।
আর ঠিক বলতে তো নেই কিছু। সব আপেক্ষিক। ধরা যেতে পারে এই গল্প কোন এক আপেক্ষিকতারই গল্প।
আমরা যেসব রাস্তায় চলাচল করি। হাটি।
গাড়ি চালিয়ে যাই। রিকশায় যাই। তার চারপাশে অনেক কিছুই দেখি। ছোট গাছ। বড় গাছ।
অথবা হঠাত হঠাত এক শহুরে ক্যাপিটালিস্ট পাখির বাসা। অনেক কিছুই চোখে পড়ে। কিন্তু একটা জিনিস কখনোই আসলে তেমন চোখে পড়ে না দিনের বেলায়। রাতের বেলা হলে অন্য ব্যাপার। জিনিসটা ল্যাম্প পোস্ট।
আমার এই গল্প ল্যামপোস্টের গল্প ও।
আমার জানালা দিয়ে একটা ল্যাম্পপোস্ট দেখা যায়। আমি রাত জাগি। দীর্ঘক্ষণ জেগে থাকি। কি কারণে জাগি তা না ই বললাম।
তা অপ্রাসঙ্গিক। এরকমই এক রাত জাগা গভীর রাতে, যখন অন্ধকার ছিল ভীষন কালো তখনি আমার চোখে পড়ে প্রথম। একটি ল্যাম্প পোস্ট। আমার জানালার কিছু টা দূরে। একা একা দাঁড়িয়ে আছে।
আমি অবাক হয়ে যাই তখন। আমি এতদিন এই পথে যাই। এই পথে আসি। কখনো কোনদিন একবারের জন্য ও দেখিনি তাকে। আমার আসলেই অবাক লাগে।
সে তার মাথায় আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার তার জন্য খারাপ লাগে। আহা ল্যাম্পপোস্ট। একা একা রাত জাগে।
আমার তখনো অনেক কিছু জানা হয় নি।
আমি তখনো ঘুনাক্ষরেও ভাবিনি কত কিছু, কত অবাক করা কিছু অপেক্ষা করে রয়েছে আমার জন্য।
ল্যাম্পপোস্টের সৌন্দর্য আমাকে টেনেছিল। আমি ঠায় জানালার ধারে বসে তাকে দেখতে শুরু করলাম। আমার টেবিলে ধোঁয়া উদগীরন করতে করতে এক সময় বিরক্ত হয়ে ঠান্ডা হয়ে যেত। আমার সেদিকে তেমন লক্ষ থাকত না।
আমি নিশ্চয়ই ল্যাম্পের হলুদ আলোতে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। অথবা ল্যাম্পপোস্টের ভাষায়।
এরকম বেশ কয়েকদিন যাওয়ার পর আমার কেনো যেন কিছু জিনিস বিদঘুটে মনে হতে লাগল। কেমন যেন কিছু অপার্থিব। একদিন দেড়টার দিকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমি দেখলাম ঠিক আগের জায়গাতেই ল্যাম্পপোস্ট।
তবে আজকের ল্যাম্পপোস্ট গতকালের টার মতো না। কিছুটা অন্যরকম। কিছুটা বয়স্ক। কিছুটা বুড়ো বুড়ো চেহারার।
আমার স্মৃতিশক্তি ভালো।
আমি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলাম। হ্যা নিশ্চিত, এটি গতকালের টা, কিংবা প্রথম যেদিন দেখেছিলাম ওই ল্যাম্পপোস্ট না।
কিন্তু এ তো অসম্ভব! এ কীভাবে হবে? এই জায়গায় যদি সিটি কর্পোরেশন থেকে লোকজন এসে বদলাত টের পেতাম।
আমার সন্দেহ হলো। আমি ঘরের সমস্ত লাইট বন্ধ করে জানালার ধারে ঠায় বসে রইলাম।
দেখতে হবে আমার কী করে বদলে যায় ল্যাম্পপোস্ট।
রাত সাড়ে তিনটায় প্রথম নড়ে উঠল বুড়ো ল্যাম্পপোস্ট। ঠিক মানুষের মত চারপাশে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে তার দুটি চিকন পা বের করল মাটি থেকে। কিছুটা ঝুঁকে ঝুঁকে চলে এল মুল রাস্তায়।
আমি এর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম বলে দেখতে পারি নি। এতক্ষণে মুল রাস্তায় চলে এসেছে অসংখ্য ল্যাম্পপোস্ট। সবাই পা টেনে টেনে হাটছে।
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। ঘামছিলাম আমি।
তবুও চোখ সরালাম না। অনেক অনেক ল্যাম্পপোস্ট। সারিবদ্ধ ভাবে, কিছুটা এলোমেলো ভাবে হাটছে। কারো হাতে গিটার। কেউ কেউ ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে।
কারো লাইটের আলো হলুদ, কারো লাল, কারো নীলচে আলো। মাঝখানে বুড়ো ল্যাম্পপোস্ট কে রেখে অন্য সবাই এক সময় দেখলাম গোল হয়ে দাঁড়াল। দেখলাম কেউ কেউ বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ছে।
আমি স্তব্দ হয়ে আছি। ভিতরে অদম্য কৌতুহল।
হঠাত আমাকে অবাক করে দিয়ে বুড়ো ল্যাম্প পোস্ট আমার জানলার দিকে আঙুল নির্দেশ করল। তার দুটি আঙুল অব্যর্থ নিশানায় আমার দুই চোখের মণির দিকে।
সাথে সাথে সব ল্যাম্প পোস্ট একসাথে তাকাল আমার জানলার দিকে। একসাথে সবার বিভিন্ন বর্নের আলো এসে আঘাত করল আমার জানালাকে। আমার জানালার অনু পরমাণু এবং ততোধিক ক্ষুদ্র ইলেক্ট্রন গুলো সহ্য করতে পারল না বোধহয়।
আমার চোখের সামনেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
আমি কিছুটা ভয় পেলাম। চিৎকার করতে মুখ খুলতে গেছি এমন অবস্থায় পিছন থেকে কে যেন আমার মুখ চেপে ধরল। কচি কচি ছোট দুই হাত। কিন্তু অসম্ভব জোর।
আমি মাথা একটু ঘুরিয়ে যা দেখলাম তা না দেখলেই বোধহয় ভালো ছিল। পিছন থেকে আমার মুখ দু হাতে চেপে ধরেছে আমারই টেবিল ল্যাম্প। তার গা থেকে বেরোচ্ছে সাদা আলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে নেয়া হলো মূল রাস্তায়। তার অল্পক্ষণ পড়েই আমার শরীর পরিবর্তন করা হলো ল্যাম্প পোস্টে এক ঝলক নীল আলোর সাহায্যে।
আমাকে বলা হলো সব কথা। কীভাবে প্রতিরাতে ল্যাম্প পোস্টেরা নগর ভ্রমণে বের হয়।
আমাকে বলা হলো আমি ও তাদের একজন।
আমি এখন প্রতিদিন রাতে ঘুরি। গভীর রাতে।
আকাশ যখন ফুলকির মতো অসংখ্য তারা ফুটিয়ে পৃথিবীকে ঢেকে দেয় অন্ধকার চাদরে, আমি তখন হাটতে বের হই। আর এইভাবে...ঠিক এইভাবে প্রতিদিন রাতে...আমার হলুদ আলোতে গল্প বলে যাই...। নিশ্চয়ই কেউ একদিন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমার গল্পের আলোতে বাঁধা পড়ে যাবে।
নিশ্চয়ই কেউ একদিন......আমাকে এবং আমাদেরকে বুঝতে চাইবে সম্মোহিতের মতো...।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।