ডিপ্রেশনঃ
মন খারাপ শব্দটি ঘুরে ফিরে দিনে বেশ কয়েকবার বলে ফেলি আমরা। কখনো নিজের মনে আবার কখনো নিজের কারো কাছে। কিন্তু ঠিক কি কারনে মন খারাপ তা আমরা নির্ধারন করতে পারিনা। ব্যাপারটা বিভিন্ন জিনিসের উপর নির্ভর করে। তবে সব মন খারাপ মানেই ডিপ্রেশন নয়।
মন খারাপ দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং তার সাথে আরো কিছু লক্ষন প্রকট হয়ে দাড়ালে তাকে আমরা ডিপ্রেশন বলি। ডিপ্রেশন এক কঠিনতম মনোব্যাধি। যার ডিপ্রেশন হয় সেই বোঝে তার নির্মম কষ্ট। ডিপ্রেশন মানুষের জীবনীশক্তি নষ্ট করে দেয়। এ রোগ হলে মানুষ বাঁচার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে।
বংশগত কারণ, জৈবিক কারণ, সামাজিক কারণ প্রভৃতি কারণে ডিপ্রেশন রোগের সূচনা ঘটতে পারে। বড় বড় রোগব্যাধির কারণেও ডিপ্রেশন হতে পারে। নারীরা ডিপ্রেশনে বেশি স্পর্শকাতর। তাদের ডিপ্রেশন হওয়ার আশঙ্কা পুরুষদের চেয়ে ৩ গুণ বেশি। ডিপ্রেশনের কারণে ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবনও এলোমেলো হয়ে পড়তে পারে।
ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় অলস প্রকৃতির হয়ে যান। তার দ্বারা তখন কোনো দায়িত্ব পালন করা কঠিন ব্যবহার হয়ে দাঁড়ায়। ডিপ্রেশনের কারণে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় ক্ষতিসাধিত হয়। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। ফলে দাম্পত্য জীবনে দেখা দিতে পারে অবনিবনা।
ডিপ্রেশন সাধারনত তিন ধরনের হতে পারে,-মাইল্ড, মডারেট ও সিভিয়ার। ডিপ্রেশনের লক্ষনগুলো অবজার্ভ করে বুঝা যায় এটি কোন পর্যায়ের। তাই প্রথমে আমাদের জানা দরকার ডিপ্রেশনের লক্ষনগুলো কি কি?
• ২ সপ্তাহ টানা ডিপ্রেসড মুডে থাকা।
• কোন কিছুতে উতসাহ না পাওয়া
• এনার্জি লেভেল কমে যাওয়া
• আত্মবিশ্বাসের অভাব
• নিজের মধ্যে অপরাধবোধ
• ঘন ঘন আত্মহত্যার চিন্তা করা
• মনোযোগের অভাব বা সিদ্ধান্ত নিতে না পারা
• সহজেই রেগে যাওয়া,বা চারপাশের জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া
• অতিরিক্ত ঘুম বা ঘুম কম হওয়া
• খিদে কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, অথবা ওজন কমা বা বাড়া
মাইল্ড ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে এর মধ্যে অন্তত ৪ টি লক্ষন দেখা যাবে, মডারেটের ক্ষেত্রে ৬ টি এবং সিভিয়ারের ক্ষেত্রে ৮ টি লক্ষন দেখা যাবে। দীর্ঘদিন ধরে এই লক্ষনগুলো অব্যাহত থাকলে অবশ্যই একজন ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
ডিপ্রেশনের কারনঃ
বিভিন্ন কারনে একজন মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগতে পারেন। পেশেন্টের শারিরীক ও মানসিক গঠন ও ডিপ্রেশনের কারন হতে পারে। হাইপোথ্যালামাস পিটুইটারি ও অ্যাড্রেনাল গ্লান্ডের পরস্পর নির্ভর হরমোন ক্ষরনে অসামঞ্জস্য হলে ডিপ্রেশন হতে পারে। তাছাড়াওজেনেটিক কারনে ও ডিপ্রেশন হতে পারে। জেনেটিক কারনের মধ্যে ক্রোমজোমের গঠন ও পলিজেনিক ইনহেরটেন্স হচ্ছে অন্যতম।
সেরোটনিন ও নরএড্রেনালিন নিউরোট্রান্সমিটারের ভাসাম্যের অভাব দেখা দিলে ডিপ্রেশন হতে পারে। মানুষের বিহেভিয়ারাল প্যাটার্নের মধ্যে অবসেসিভ বৈশিষ্ট থাকলে ডিপ্রেশনের প্রবনতা আরো বেড়ে যায়। তাছাড়াও ছোটবেলায় সেক্সুয়াল এবিউজ, ভয়ের ঘটনা,প্রতারনা, কারো মৃত্যু, স্ট্রেস ইত্যাদিও ডিপ্রেশনের কারন হতে পারে।
যারা কমবেশি ডিপ্রেশনে ভোগেন তাদের জন্য কয়েকটি টিপসঃ
* যদি বিষন্নতার লক্ষণ নিজের মধ্যে দেখেন, তাহলে নির্ভরযোগ্য বন্ধু, স্বজনকে বিষয়টি জানান| যদি অন্য কেউ আপনার মধ্যে বিষন্নতার লক্ষণ খুঁজে পায়, তবে অযথা তার দিকে আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখাবেন না-তার পর্যবেক্ষণকে গুরুত্বের সঙ্গে নিন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন|
* বিষন্ন অবস্থায় এমন কোনো লক্ষ্য স্থির করবেন না, যেটার বাস্তবায়নে অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে হয়|
* নিজের কাজটিকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ফেলুন, কোন অংশটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ণয় করুন এবং গুরুত্বের মাত্রা অনুযায়ী জরুরি কাজটি আগে করে ফেলুন|
* নিজের কাছে খুব বেশি কিছু আশা করবেন না| মনে রাখবেন আস্তে আস্তে আপনি সবই করতে পারবেন| নিজেকে সময় দিন| নিজের কাছে খুব বেশি আশা করলে আশাভঙ্গের বেদনায় আরও বেশি বিষাদগ্রস্ত হবেন|
* স্বজন, বন্ধু আর সহকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটান|
* নতুন বন্ধু তৈরি করুন| একা একা সময় কাটাবেন না|
* যেসব কাজ করতে আপনার ভালো লাগে, যাতে আপনি আনন্দ পান সেগুলোই করুন| জোর করে নিরানন্দ কাজে নিজেকে নিয়োগ করবেন না|
* শরীরের সাধারণ যত্ন নিন, নিয়মিত গোসল করুন, নখ কাটুন, দাঁতের যত্ন নিন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরুন|
* প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করুন| ফুটবল, টেনিস বা ক্রিকেটের মতো খেলায় নিয়মিত অংশ নিতে পারেন|
* সামাজিক বা সাংস্কৃতিক যেকোনো কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন|
* ভালো বোধ করার জন্য নিজেকে সময় দিন| তাড়াহুড়ো করবেন না|
* বিষন্ন অবস্থায় জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত-যেমন বিয়ে করা বা না করা, বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানো, নতুন চাকরি নেওয়া বা চাকরি ছেড়ে দেওয়া, জমি বা বাড়ি বিক্রি করা ইত্যাদি| প্রয়োজনে এসব বিষয় সাময়িক স্থগিত করুন| চিকিৎসক এবং নির্ভর করতে পারেন, এমন স্বজন বা বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করুন|
* তাড়াহুড়ো করে নিজের বিষন্নতাকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না, সময় নিয়ে বিষন্নতা দূর করুন| ‘কেন আমি বিষন্ন’-এটা ভেবে নিজেকে দায়ী করবেন না| মনে রাখবেন বিষন্নতা দূর করা কঠিন বিষয় নয়, ধৈর্য ধরে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন|
* নিজের ভেতরকার নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে প্রশ্রয় দেবেন না, এগুলো বিষন্নতার অংশ-এগুলো বিষন্নতার সঙ্গে সঙ্গে দূর হয়ে যাবে|
* ইতিবাচক চিন্তা নেতিবাচক চিন্তাকে দূর করে| তাই ইতিবাচক চিন্তা ও পরিকল্পনা করুন|
* মৃতুচিন্তা আর আত্মহত্যার প্রবণতা থাকলে চেষ্টা করুন সব সময় স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে| মৃতুর কারণ ঘটাতে পারে এমন বস্তু (ছুরি, বঁটি, ওষুধ, দড়ি, ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন ইত্যাদি) থেকে দূরে থাকুন|
* চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন| নিজে নিজে ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন করবেন না, নতুন ওষুধ যোগ করবেন না, ওষুধ বন্ধ করে দেবেন না| হঠাৎ করে বিষন্নতারোধী ওষুধ বন্ধ করে দেওয়ার ফল মারাত্মক| চিকিৎসকের নির্দেশমতো ওষুধ বন্ধ করতে পারেন|
উপরের বিষয়গুলো ছাড়াও মেডিকেশন,ফ্যামিলি সাপোর্ট, থেরাপি ও কাউন্সেলিং,পজিটিভ অ্যাটিটিউড একজন মানুষকে সহজেই ডিপ্রেশনের কালো থাবা থেকে বের করে আনতে পারে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।