বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
আগের পর্ব
এইবার শোন, কদিন ধরে গড়পাড়া গ্রামে কী মজার কান্ড হয়েছে।
দিন সাতেক হল একটা সার্কাসের দল এসে উত্তরপাড়ার তালপুকুরের পাশে ময়নার মাঠের ওপর সারি সারি তাবু ফেলেছে। সার্কারে নাম -- কী আজব সার্কাস এন্ড কোং ।
সার্কাসের লোকেরা যে কত রকম খেলা দেখায়। ঘোড়ার খেলা, হাতির খেলা, বাঘের খেলা, দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটার খেলা- এরকম কত কী । রঙচঙা ভাঁড় ডিগবাজী খেয়ে কতরকম কসরত দেখায়। গ্রামের মানুষ হাসতে হাসতে এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ে। হ্যাঁ, বিকেল হলেই গ্রামের ছেলেবুড়ো ভেঙ্গে পড়ে তালপুকুরের পাশে ময়নার মাঠে।
তা, এই কী আজব সার্কাস এন্ড কোং-এর সত্ত্বাধিকারীর নাম গোলাম হায়দর রাব্বানী। সংক্ষেপে তাকে অবশ্য গো. হা রাব্বানী বা শুধু রাব্বানী বললেই চলবে। মাঝবয়েসি লোকটা ছ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট দশাশই চেহারার এক তাগড়াই যোয়ান। শুধু তাইই নয় তার একটি ইয়া বড় গোঁফও রয়েছে থ্যাবড়া নাকে নীচে আর মাথাটা নিখুঁতভাবে কামানো বলেই চকচকে । সব মিলিয়ে কী আজব সার্কাস এন্ড কোং-এর সত্ত্বাধিকারী রাব্বানী দেখতে ষন্ডাপ্রকৃতির।
গুজব এই, তার ভয়ে নাকি সার্কাসের নখ-দাঁত পড়ে-যাওয়া বুড়ো বাঘ আর হাড়জিরজিরে ঘোড়াগুটা নাকি এক গামলায় পানি খায়। কথাটা সত্যি কি মিথ্যে তা পরে জানা যাবে।
আর ভীষন বেঁটে আর উটকো মতন দেখতে গাবু হল কী আজব সার্কাস এন্ড কোং-এর সত্ত্বাধিকারী গোলাম হায়দয় রাব্বানীর ডানহাত। বলাই বাহুল্য যে, সে একটা ভারি বদ লোক। মাথায় কোঁকড়া চুলে বাংলা সিনেমার এক হিট নায়কের মতন ব্যাক ব্রাশ করা ।
ব্যাক ব্রাশ করা চুলের ওপর বাহারি টুপি। শোনা যায় লোকটা কোন্ পিরের মুরিদ। গাবুর মুখ-ভরতি গোটা-গোটা ব্রনের দাগ। সব সময় উটকোটা গাঢ় হলুদ রঙের পাঞ্জাবী পরে থাকে। দিনেরাতে চোখে তার কালো রোদচশমা থাকবেই।
তো সকাল বেলায় ইশকুল ফাঁকি দিয়ে তিতা আর কটূ তালপুকুরের পাশে ময়নার মাঠে ঘুরঘুর করছিল। কী ভাবে ওরা ভিতরে ঢুকেছে তা ওরাই জানে। হয়তো ময়নার মাঠের উত্তরদিকের আমগাছে চড়েই ঢুকেছে। কেউ খেয়াল করেনি। এখন সার্কাসের লোকজন অলস ভঙ্গিতে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছিল।
কারণ, সার্কাস শুরু হয় বিকেলের দিকে।
সার্কাসের হাতিটা একপাশে বাঁধা ছিল। দূর থেকে হাতি দেখিয়ে তিতা বলল, দেখেছিস কটূ কী বিশাল শরীর।
যেন হাতি পোষে এমন ভঙ্গি করে কটূ বলল, হাতিদের এমনই হয়। বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, চল বাঘটা দেখে আসি।
চল।
ওদের মাথায় অনেক দুষ্টুবুদ্ধি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু একটাও প্রয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছিল না। সার্কাসের মালিক রাব্বানী যা বদরাগী। যদি ওদের টুটিঁ চেপে খোদ বাঘের খাঁচায় ছুঁড়ে দেয়, তখন?
এই তো সামনেই রাব্বানীর হলুদ রঙের তাবুটা দেখা যাচ্ছে।
লোকটার সামনে না পড়াই ভালো। হয়তো এমনি এমনি গর্দান নিয়ে নেবে। ওরা ভয়ে ভয়ে জায়গাটা পেরিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় পিছন থেকে বাজখাই কন্ঠ শুনে ওদের পিলে চমকে উঠল। এই তোরা এখানে কী করছিস? এখানে ঢুকলি কী করে?
সর্বনাশ! এতো সার্কাসের মালিক রাব্বানীর ভয়াবহ কন্ঠস্বর।
ওরা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে চোখ বুঁজে ফেলেছিল। চোখ খুলে দেখল যেখানে বাঘের ভয় ... হলুদ রঙের তাবুর সামনে বুক টানটান করে রাব্বানী দাঁড়িয়ে। কালো রঙের চামড়ার জ্যাকেট পরা। হাতে একটা চাবুক। কামানো মাথাটা সূর্যালোকে চকচক করছে।
পাশে গাবু দাঁড়িয়ে। আজ একেবারে বাঘের মুখে পড়েছে।
তিতা হাত জোর করে কোনওমতে বলতে পারল, মানে ...মানে একটু ঘুরে ফিরে দেখছিলাম আর কী।
এই গাবু ও দুটোকে ধরে নিয়ে আয় তো। বলেই বিশালদেহী রাব্বানী হলুদ তাবুর মধ্যে ঢুকে গেল।
অতি বেটে হলেও কিছু বোঝার আগেই গাবু ওদের চ্যাঙ্গদোলা করে তাবুর ভিতরে নিয়ে থপ করে ফেলল। ওরা ব্যথা পেয়ে কুঁই কুঁই করে উঠল। কটূ ফিসফিস করে তিতার কানে কানে বলল, এবার নিশ্চয়ই আমাদের আস্ত খেয়ে ফেলবে। কেন যে মরতে এসেছিলাম।
ওরা ধূলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল।
হুম। সার্কাসের মালিক রাব্বানী হুঙ্কার ছাড়ল।
ওরা দেখল সার্কাসের মালিক রাব্বানী টেবিলের ওপর পা তুলে বসে চুরুট টানছে, গলার কাছে হলুদ রঙের তোয়ালে। আর একটা কালো করে শুকনো মতন লোক রাব্বানীর মাথাটা পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে। এই লোকটা হল নাড়ু নাপতে, হাটের দিন বটতলায় বসে।
নাড়ু নাপতেকে দেখে ঠিকই চিনল তিতা-কটূ। মনে হল নাড়ু নাপতে সার্কাসের মালিক রাব্বানীর মাথা চেঁচে দেবে আজ। হ্যাঁ, তাই। শুকনো মতন লোকটা হাতে একটা কালো রঙের সেভিং ব্রাশ তুলে নিল। টেবিলের ওপর থালাভর্তি জিলেপি।
এখন সকাল ১১টা বাজে ওদের খিদে পেয়েছে। ওরা জিলেপির দিকে কেমন করে তাকাল।
এই তোরা কই থাকিস রে? রাব্বানী জিগ্যেস করল। গলার স্বরটা এখন তত বাজখাঁই নেই।
তিতা এক ঝলক জিলিপী-ভরতি পে¬টের দিকে তাকিয়ে কোনওমতে বলতে পারল, আমরা এই গাঁয়েরই ছেলে।
আমাদের বাবা নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। হারুন মন্ডল।
রাব্বানীর মুখটা নরম হল। ও, তোরা তাহলে হারুন মন্ডলের ছেলে। হ্যাঁ, তোদের বাবাকে ভালই চিনি।
এখানে সার্কাস বাসানো আগে তাঁর পারমিশন নিতে হল। বেশ, ভালো ভালো। তোরা জিলিপী খাবি? এই নে খা। বলে পা দিয়েই থালাটা ঠেলে দিল রাব্বানী।
বাবার কথায় তাহলে কাজ হল।
কটূ ভীষন অবাক হয়ে তিতার মুখের দিকে তাকাল। তিতাও।
খা। অত ভয় খাচ্ছিস কেন? আমি বাঘ না ভাল¬ুক না উল¬ুক?
দুটোই। না না তিনটেই।
মনে মনে বলল কটূ। তিতা একসঙ্গে দুটো জিলিপী তুলে নিল। কটূ তিনটে।
শুকনো মতন লোকটা রাব্বানীর মাথায় সেভিং ক্রীম ঘঁষে চলেছে। রাব্বানীর চোখটা আরামের চোটে ছোট ছোট হয়ে এল।
রাব্বানী জিগ্যেস করল, এ্যই,তোদের গ্রামে কি কি মজার মজার জিনিস আছে বল তো ?
প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে ওরা রাব্বানীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রাব্বানীর ডান হাত গাবু তখন মোচে তা দিতে দিতে বলল, তোরা হুজুরের কথা বুঝতে পারলি নাতো? শোন, তাহলে আমিই সব খুলে বলছি। সার্কাসে এসে এখন আর লোকে বস্তাপচা পুরনো খেলা দেখে মজা পায় না। লোকে নতুন নতুন খেলা দেখতে চায়। হাতি-বাঘ-ঘোড়া-বানর, এইসব এখন বস্তাপচা হয়ে গেছে বুঝলি।
এসব দেখে দেখে গ্রামের হদ্দ লোকেরও অরুচি ধরে গেছে। এখন আর তেমন লোক জোটে না। ভাবছি শেষে সার্কাসই না তুলে দিতে হয়। হুজুর তাই জানতে চাইছিলেন, তোদের গ্রামে কি কি মজার মজার জিনিস আছে যা দেখালে লোকে মজে যাবে।
আরেকটা জিলিপী মুখে পুরে তিতা জিগ্যেস করল, একেবারে অন্য কিছু কী?
গাবু লালা রুমালে মুখ মুছে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, অন্য কিছু মানে, এই ধর সাপ-ব্যাঙ- ইঁদুর- বিলাই- জ্বীন- ভুত, মানে এর আগে সার্কাসে যা দেখানো হয়নি।
ও বুঝিছি। তিতা বলল। বলে ভাবল গড়পাড়া গ্রামে কি কি অদ্ভূত জিনিস আছে। এদের যে করেই হোক খুশি রাখতে হবে। তা হলে নিশ্চয়ই সার্কাসে ঢোকার ফ্রি টিকিট ছাড়াও অনেক টাকা পয়সা পাওয়া যাবে।
টাকার দরকার। দুষ্টুমি করে বেড়ায় বলে বাসা থেকে হাতখরচ বন্ধ করে দিয়েছে। ওরা ভালো করেই জানে পূর্ণিমার রাতে ঝিলিমিলি নদীর পাড়ের বালুচলে পরিরা নামে। ফস করে জানতে চাইল কটূ, পরি হলে চলবে?
পরি? বলিস কী! কোথায়? সার্কাসের মালিক রাব্বানী সিধে হয়ে বসতেই উঃ করে উঠল। কেটে গেল বোধ হয়।
শুকনো দেখতে লোকটা হাতে এখন একটা চকচকে ধারালো ক্ষুর।
চোখে কালো রোদচশমা পরা গাবুটাও দুপা এগিয়ে এল।
একসঙ্গে দুখানা জিলেপী মুখে পুরে তিতা বলল, আছে।
কোথায়?
বললাম তো আছে।
আহা বলনা কোথায়?
বলব।
তবে পরি ধরে দিলে কী পাব সেইটে আগে শুনি?
তোরা কী চাস?
তিতা-কটূর অনেক দিন ধরে ঘোড়ার শখ। একটা ঘোড়া জোগার করে বিকেলের দিকে গ্রামের পথে পথে ঘোরালে বেশ হয়। লোকে তাকিয়ে দেখবে। তা ছাড়া আগামী বছর ওদের বাবা হারুন মন্ডল ইলেকশানে দাঁড়াবে। তখন ঘোড়াটা কাজে লাগবে।
তিতা বলল, সাদা রঙের ঘোড়াটা চাই।
সার্কাসের মালিক রাব্বানী কী যেন ভাবল। ঘোড়াটা এমনিতেই হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে। দুদিন পর এমনিতেই ওটাকে তাড়িয়ে দিতে হবে। রাব্বানী বলল, সত্যিই পরি ধরে দিতে পারবি?
হ্যাঁ পারব।
কটূ দৃঢ় স্বরে বলল।
যা তাহলে, এক্ষুনি পরি এনে দে। দেখি তোদের মুরোদ কেমন?
কটূ বলল, আঙুল চাটতে চাটকে বলল, সার, এখন তো প্রায় দুপুর। পরিরা আসে রাতদুপুরে। যদি জোছনা থাকে তবেই।
তাই এব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই সার, আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে সার।
রাব্বানী বলল, হুঁ। ঠিক আছে, আমি না হয় অপেক্ষা করলাম।
আমরা তাহলে যাই সার।
যা।
তিতা-কটূ হুড়মুড় করে তাবু থেকে বের হয়ে গেল।
ক্রমশ ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।