নর্দমার রাত, হিরন্ময় তাঁত
১মপর্বের পর:
০৯.
একদিন তুরানের কাছে বনে শিকারে গিয়ে একসময় রোস্তম ঘুমিয়ে পড়লেন এবং তার ঘোড়া রাখসকে হারিয়ে ফেললেন। ঘোড়াটিকে খুঁজতে খুঁজতে তিনি শত্রুদেশের এক শহর, সামাংগান এ এসে হাজির হলেন, যেখানে তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন স্থানীয় রাজা, এবং তিনি ঘোড়াটিকে খুঁজে বের করে দেয়ার অঙ্গীকার করলেন। রুস্তমের সাথে দেখা হল রাজার সুন্দরী কন্যা তাহমিনার সাথে, যে তার সম্বন্ধে সব বীরত্বসূচক কাহিনি শুনে তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। রুস্তম বিয়ে করলেন তাহমিনাকে। ইরানের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করার ঠিক পূর্বণে তিনি তার স্ত্রীকে দিয়ে গেলেন একটি তাবিজ, যা তিনি বেঁধে রাখতেন তার বাহুতে।
এটি পাবে তার উত্তরাধিকারী : যদি হয় কন্যাসন্তান তবে সেটি পড়বে তার চুলে এবং যদি হয় পুত্রসন্তান, তবে সে বাঁধবে বাহুতে।
নয়মাস পর তাহমিনা জন্ম দেন এক পুত্রসন্তান। নাম রাখলেন সোহরাব, সে যখন তিনবছর বয়সী, তখন শেখা শুরু করল যুদ্ধবিদ্যা, এবং যখন সে দশ বছর বয়সে পৌঁছল তখন সে হয়ে উঠলো অনন্য বীর। সে শীঘ্রই উপলব্ধি করতে পারল যে, সে তার সমবয়সী অন্যান্য ছেলের চাইতে শ্রেষ্ঠতর এবং যখন সে তার পিতা সম্বন্ধে জানতে চাইল তার মায়ের কাছে, তিনি তাকে বললেন যে, সে রুস্তমের পুত্র। এটি সোহরাবকে যে শুধু তার পিতার অনুসন্ধানেই উদ্দীপ্ত করল, তা নয়, এতে তিনি তুরানের সাথে তার সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে উৎসাহিত হলেন।
এছাড়াও তিনি রাজাদের রাজার পদ থেকে কেক্যাভাসকে অপসারণ করতে এবং সেই পদে রুস্তমকে আসীন করতে অগ্রসর হলেন।
১০.
সোহরাবের খবর পৌঁছে গেলো আফ্রাসিয়াবের কাছে, যে পিতা এবং পুত্র উভয়ের বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর পরিকল্পনা ফেঁদে বসল, যাতে করে সোহরাবের সাথে তার পিতার সাক্ষাৎ ঠেকানো যায়, এর মধ্য দিয়ে আড়াল করা যাবে রুস্তমের কাছে তার পুত্রের পরিচয়, যাতে করে তার মুখোমুখি হয় পরস্পরের শত্রু হিসেবে।
যুদ্ধক্ষেত্রে সোহরাবের সন্দেহ হলো যে তার প্রতিপ হয়তো তার পিতা, কিন্তু যখন তিনি তার নাম জিজ্ঞাসা করলেন, তখন রুস্তম তার প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখলেন। সোহরাব তখন তুরানিদের কাছ থেকে সত্যটি জানতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু আফ্রাসিয়াবের আদেশে তারা রোস্তমের পরিচয় প্রকাশ করল না। কেবলমাত্র যুদ্ধেেত্র তাদের চূড়ান্ত মোকাবেলায়, যখন সোহ্রাব তার পিতা রুস্তমের কাছ থেকে পেলেন এক ভয়ংকর আঘাত এবং রুস্তম সোহরাবের বাহুতে আবিষ্কার করলেন তার দেয়া তাবিজ, তখন রুস্তম বুঝতে পারলেন যে, তিনি পুত্রকে হত্যা করেছেন।
১১.
জাল সিমুর্ঘ এর সাহায্য কামনা করেন রুস্তমের জন্য, যখন তিনি লড়ছিলেন ইসফান্দিয়ার এর বিরুদ্ধে, যা ছিল দুই সমানে-সমানের মধ্যে এক বিখ্যাত লড়াই। মারাত্মকভাবে আহত রোস্তম প্রথমবারের মতো সন্দিহান হয়ে পড়লেন এই ভেবে যে, তিনি ইসফান্দিয়ার এর শক্তি আর সহ্য করতে পারবেন কি না এবং তিনি তার পিতার সাহায্য প্রার্থনা করলেন। রুস্তম এবং রাখস্ উভয়ের বিপদজনক শারীরিক অবস্থায় চিন্তাব্যাকুল জাল, তাকে দেয়া সিমুর্ঘ এর পালকটি জ্বালিয়ে দিলেন। তৎণাৎ অন্ধকার আকাশটি আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠল এবং আবির্ভাব ঘটল সিমুর্ঘপাখির। রুস্তমের শরীর থেকে বের করে আনল সাতটি তীর এবং তগুলোর উপর ঘষে দিল তার পালক।
ইসফান্দিয়ার ছিলেন জরথুস্ত্রের পৃষ্ঠপোষক, এবং জরথুস্ত্র তাকে করে তুলেছেন অপরাজিত। তবু সিমুর্ঘ রুস্তমের কাছে প্রকাশ করে ইসফান্দিয়ারকে পরাস্ত করার গোপন কৌশল, যা আরো একবার প্রমাণ করে জাল এবং তার পুত্রের প্রতি তার আনুগত্যকে। পাখিটি রোস্তমকে তিনটি পালক ও দুটি তীরের ফলা সম্পন্ন একটি কাঠামো তৈরি করতে এবং এটিকে ইসফান্দিয়ারের চোখের দিকে তাক করতে বলল। রুস্তম সিমুর্ঘের উপদেশ আনুসরণ করলেন, যদিও তীরটি নিপে করার পূর্বে তিনি ইসফান্দিয়ারকে বললেন যে, তাদের উচিত তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মীমাংসা করে ফেলা। তবু ইসফান্দিয়ার তখনো বিশ্বাস করতেন যে, কেউ তার সমক নয়, তাই তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং শেষ পর্যন্ত রুস্তমের শিকারে পরিণত হলেন।
ইসফান্দিয়ার সংক্রান্ত আরেকটি কাহিনিতে একটি দৈত্যাকৃতি পাখির সাথে লড়াই করেন। এই পাখিটির নামও ছিল সিমুর্ঘ, স্পষ্টতই তা ছিল না জাল এর সেই রাকারী পাখি। অতি ধূর্ততার সাথে তিনি পাখিটিকে পরাস্ত করলেন, তার তরবারি দ্বারা একে কেটে টুকরো টুকরো করলেন, অতঃপর এই মর্তলোক পর্বত থেকে পর্বতে ছেয়ে গেল এর পালকসমূহ দ্বারা।
ইসফানদিয়ার-এর বিরুদ্ধে রুস্তমের বিজয়ের পর রুস্তম নিজেই খুন হলেন তার সৎ ভাই জাবুলিস্তানের রাজা শাকাদের হাতে, যখন তিনি তার ঘোড়াসহ পড়ে গেলেন এক ভয়ঙ্কর গর্তে যা তারা খনন করেছিল এবং পূর্ণ করে রেখেছিল উলম্ব ছুরি ও তলোয়ার সমূহ দ্বারা। তবে মৃত্যুর পূর্বে রুস্তম নিজে গর্ত থেকে উঠতে সমর্থ হলেন, শাকাদকে বিদ্ধ করলেন একটি তীর দ্বারা, তার মৃতদেহ গেঁথে রাখলেন একটি গাছের ডালের সাথে।
১২.
সিয়াভাশ হলেন কেক্যাভাস এবং ফেরাইদুন ও তুরানি রাজপরিবারের উত্তরাধিকার সম্পন্ন এক রাজকুমারীর পুত্র। তরুণ বয়সে তাকে পাঠানো হয় রুস্তমের তত্ত্বাবধানে, যিনি তাকে যুবরাজসুলভ সব কলাকৌশল ও দতায় দীতি করে তোলেন। যখন সে এক সুদর্শন পুরুষে পরিণত হল, তখন তার পিতার অন্যতম স্ত্রী সুদাবে তার প্রেমে পড়লেন। যখন তার প্রলোভন সিয়াভাশকে প্রলুব্ধ করতে পারল না, তখন তিনি তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনলেন এবং তার স্বামীর কাছে এই মিথ্যাচার করলেন যে, সিয়াভাশ তার কাছে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। সুদাবেকে প্রাথমিকভাবে বিশ্বাসকারী, কেক্যাভাস তার পুত্রকে কেবল তখনই মা করলেন যখন সে এক কালো ঘোড়ায় চড়ে আগুনের ভিতর দিয়ে গিয়ে নিজেকে নিষ্পাপ প্রমাণ করলো।
অতঃপর সিয়াভাশ চলে গেলেন আফ্রাসিয়াবের দরবারে, যেখানে তিনি রাজকন্যার প্রেমে পড়লেন, তাকে বিয়ে করলেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলেন। সিয়াভাশের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত হয়ে আফ্রাসিয়াবের ভাই গার্সিভাজ আফ্রাসিয়াবকে ইরানের তরুণ রাজকুমারটির বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে সমর্থ হলেন, তখন তাকে নির্দয়ভাবে খুন করা হল এবং তার মস্তক কেটে ফেলা হল। কিছুকাল পর সিয়াভাশের পুত্র কেখুসরো তুরান থেকে ইরানে ফিরে এলেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সৎ-ভাই, ফারিবার্জকে পরাভূত করে তিনি হয়ে উঠলেন তার পিতামহ কেক্যাভাস এর উত্তরাধিকারী এবং রাজা হয়ে গেলেন । গার্সিভাজ এবং আফ্রাসিয়াব দুজনই কেখুসরোর হাতে নিহত হলেন।
১৩.
পুরো শাহনামা জুড়ে রাজা এবং বীরদের পাশাপাশি আবির্ভূত হয় নিষ্ঠুর অতিপ্রাকৃত শক্তি বা দিভ-ই-সেপিদ নামক অশুভ শক্তিসমূহ। এদেরকে কখনো বলা হয় আহরিমান নামক শয়তান।
শাহনামার বীরগণকে সচরাচর তাদের সাহস এবং শারীরিক শক্তির সাথে রাজাদের রাজার প্রতি তাদের পরম আনুগত্য প্রমাণ করতে হতো দিভ, ড্রাগন, নেকড়ে এবং দৈত্যদেরকে মোকাবেলা করে। এই সময়ে এমন সব উপাখ্যান রয়েছে যেগুলোতে বীরগণকে সাহায্য এবং রা করে অনেক সদয় এবং অতিপ্রাকৃত সৃষ্টি। এদের মধ্যে রয়েছে পাখি সিমুর্ঘ এবং রোস্তমের ঘোড়া, রাখস।
রাখস নামক ঘোড়ার কথা প্রথম উল্লেখ করা হয় শাহনামার শুরুর দিকে। রাজাদের রাজা কেক্যাভাসকে উদ্ধার করার জন্য পর্বতে এক দুঃসাহসী অভিযান চালানোর পূর্বে, রুস্তম তার মাতৃভূমি জাবুলিস্তানের সব পশুপালকদের মধ্যে একটি উপযুক্ত ঘোড়া খোঁজ করলেন, কিন্তু এদের পৃষ্ঠে তিনি তার হাত দ্বারা চাপ দিয়ে দেখলেন যে, এদের কোনোটিই সেই ওজন সহ্য করতে পারছে না এবং এদের পেট মাটি পর্যন্ত ঝুলে যাচ্ছে। রোস্তম হঠাৎ একটি ঘোড়া দেখলেন যার কানগুলি বেরিয়ে এসেছিল দুটি তরবারির মতো। ছোটো ছোটো ধাপে দ্রুত পা ফেলে এর পেছন পেছন এলো একটি অশ্বশাবক যেটি দেখতে এর মায়ের মতোই। অশ্বশাবকটির ছিল গভীর কালো চোখ একটি দীর্ঘ লেজ এবং ইস্পাতের মতো খুর।
এর হালকা বর্ণের শরীরটিতে আছে দাগ, যেগুলো চকচক করছে আকাশের মতো। এর উচ্চতা একটি উটের উচ্চতার সমান এবং এর শক্তি একটি হাতির শক্তির সমান। সেই শাবকটিই রাখস নামে পরিচিত হলো।
রোস্তমের প্রতি রাখস এর পরম আনুগত্য এবং এর বুদ্ধিমত্তা চমৎকারভাবে প্রমাণিত হয়েছে রোস্তমের সাতটি অভিযানে।
প্রথম অভিযানটিতে, নলখাগড়ার মাঠে রোস্তম তার ছুরিটি রেখে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এবং তার অজ্ঞাতসারে তার দিকে এগিয়ে এল একটি সিংহ।
ক্রুদ্ধ রাখস এর সামনের পা দ্বারা সিংহটিকে আঘাত করল এবং এর পৃষ্ঠদেশ কামড়ে দিলো।
তৃতীয় অভিযানে, রুস্তম নিদ্রাচ্ছন্ন ছিলেন। বিশ্রামে যাওয়ার পূর্বে তিনি রাখসকে সিংহ এবং ড্রাগনদের সাথে লড়াই করার ব্যাপারে সতর্ক করে দিলেন। অনতিবিলম্বে আবির্ভূত হল একটি বিশাল ড্রাগন। রাখস্ বিপন্ন হয়ে পড়লো এবং তার পা দ্বারা মাটিতে আঘাত করে তার মনিবকে জাগাতে চেষ্টা করল, কিন্তু রোস্তম যখন চোখ খুললেন, তখন ড্রাগনটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
রোস্তম তখন রাখসকে বকাঝকা করলেন তাকে বিরক্ত করার জন্য। ড্রাগনটি এই খেলা চালিয়ে যেতে লাগল, প্রতিবারই রাখস জাগিয়ে তুলল রোস্তমকে, তেপান্তরের মাঝে তিনি শুধু অন্ধকারই দেখতে পেলেন। অবশেষে তিনি রাখসের মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেলার হুমকি দিলেন। নিঃশ্বাসের সাথে ধোঁয়া এবং আগুন নির্গমন করে ড্রাগনটি আবির্ভূত হল আরো একবার, রাখস রোস্তমের হুমকি এবং ড্রাগনের অদৃশ্য হওয়ার কৌশল উভয়ই উপেক্ষা করলো এবং উত্তেজনা ও ক্রোধে গর্জন করে এটি মাটিতে পা দ্বারা আঘাত করতে লাগল যতক্ষণ না ফাটল ধরে। তখন রোস্তম জেগে উঠে অন্ধকারের মাঝে দেখতে পেল ড্রাগনের অগ্নিশিখা।
ততক্ষণে রাখস ড্রাগনকে আক্রমণ করলো এবং এর কাঁধে কামড় বসালো। তারপর রোস্তম একে আঘাত করলেন তার তরবারি দ্বারা এবং এর মাথা কেটে ফেললেন।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র:
১. World of myths by Felipe Fernández-Armesto
২. অন্তর্জাল
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।