বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
প্রথম পর্ব
রাতটা ফুরিয়ে যাচ্ছিল। তাইই ঝিলিমিলি নদীর ধারে গাইতে-থাকা, নাচতে-থাকা পরিদের দলটারও কিন্তু পরির দেশে ফিরে যাবার সময় হয়ে এল। কিন্তু এ কী! রাকা কোথায়? রাকাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
রাকা কোথাও নেই যে! ও কোথায় গেল? সবাই মিলে রাকাকে খুঁজতে শুরু করল। বালুচরের সর্বত্র, ঘাসের বনের ফাঁকেফোকরে, অশথ গাছের তলার ঝুপসি অন্ধকারে, অশথ গাছের পিছনের খালপাড়ের ভেজা মাটিতে। না নেই। কোথাও রাকাকে পাওয়া গেল না।
শেষমেশ।
কী আর করা। পরির দল মন খারাপ করে আকাশে উড়ল। তারপর চাঁদের গা ঘেঁষে আকাশপথে ভেসে ভেসে চলে যেতে লাগল পরির দেশে।
রাকাকে খুঁজে না পেয়ে সেই দুঃখেই কার যেন রুপালি মুক্তোদানার মতন একফোঁটা অশ্র“ দুধসাদা জোছনার সঙ্গেই ঝরে পড়ল ঝিলিমিলি নদীচরের বালির ওপর!
পরির দেশের রানবাড়িতে পৌঁছে সবই খুলে বলল পরিরা। রাকা হারিয়ে গেছে শুনে রানবাড়ির সবাই কান্না জুরে দিল।
পরিরাজ্যে রাকাকে সবাই গভীর ভাবে ভালোবাসত। ওরা সবাই ফিরল। রাকাই কেবল ফিরল না। এখন কী হবে। যদি রাকা আর কোনওদিনই ফিরে না আসে।
পরিরানি শয্যা নিলেন। পরিরানিই তো হল রাকার মা। পরিরানি এমননিতে ভীষন বুদ্ধিমতী আর সাহসী। পরির দেশটা তো তিনিই শাসন করেন। সবাই তাঁকে পরিমা বলে ডাকে।
কিন্তু এখন রাকাকে না দেখে ভেঙ্গে পড়লেন পরিরানি। রাকাকে তিনি ভীষনই আদর করেন কিনা তাই। পরিরানি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আর কোনও দিন রাকাকে বকব ন। ওরে, তোরা আমার রাখাকে আমার বুকে ফিরিয়ে আন। আমি আর কোনও দিন রাকাকে বকব ন।
পরিরানির শয্যার কাছে সবাই দাঁড়িয়েছিল। পরিরা ছাড়াও ছিল রাজাবাড়ির দারোয়ান পবনবাবু, হেড বাবুর্চি ভোলামিঞা, রথের সারথী বুড়োদাদা। এ ছাড়া ছিল পরির দেশের মন্ত্রীবুড়ো আর রাকার বাবা। রাকার বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, সে তো বুঝলাম, কিন্তু রাকা গেল কোথায় সেই তো বোঝা যাচ্ছে না। তোমরা রাকাকে ভালো করে খুঁজেছিলে তো?
সবুজ পরি কান্নাভেজা কন্ঠে বলল, হ্যাঁ, জ্যাঠামশাই, রাকাকে আমরা তন্ন তন্ন করেই খুঁজেছি।
পরিরানি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি বকলাম বলেই তো ও রাগ করে আর ফিরে এল না।
রাকার বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে। সেসব আর বলে কী লাভ। বলে গম্ভীর মুখে পায়চারি করতে লাগলেন।
রাকার বাবার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন।
তার গলায় একটা দূরবীন। মুখচোখে মন্ত্রীবুড়ো উদ্বেগের ছাপ পড়েছে।
পরিরানি বললেন, কাউকে এখন পৃথিবীতে পাঠানোই বিপদ। সূর্য উঠছে। একটু পরই আকাশপথটা আগুনে ঝলসে যাবে।
মন্ত্রীবুড়ো বললেন, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন পরিমা। সূর্য না-উঠলে কাউকে না কাউকে পাঠানো যেত। দেখি এখন কী হয়।
রাকার বোন আঁকা। ও ও নীল পরি।
এখন চোখ মুছতে মুছতে বলল, আপুর জন্য আমার কেমন যে করছে।
হলুদ পরিটা মন্ত্রিবুড়োর মেয়ে। ও খানিকটা হিংসুক ধরনের হলেও রাকার জন্য ...
হলুদ পরি আঁকাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত্বনা দিল।
পরিরানি আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, তোমরা আমার রাকাকে ভালো করে খুঁজেছিলে তো?
হ্যাঁ, জেঠিমা, আমরা তন্ন তন্ন করেই খুঁজেছিলাম। এমন কী অশথগাছের পিছনে খালপাড়েও খুঁজেছি, পাই নি।
সবুজ পরি বলল।
গ্রামে খোঁজনি?
রাকার জন্য সবুজ পরির ভারি কষ্ট হচ্ছে। বেচারির মুখচোখ শুকিয়ে গেছে। ওই বলল, না।
পরিরানি কঠিন স্বরে বললেন, কেন?
পরিরা চুপ করে রইল।
পরিরানি আর কী বলবেন। তিনি চুপ করে থাকলেন।
মন্ত্রিবুড়ো একটু পর বললেন, যাই, ছাদে যাই। দেখি যদি রাকাকে দেখা যায়। বলেই মন্ত্রিবুড়ো ধীরে ধীরে ঘর ছেলে চলে গেলেন।
রানবাড়ির দারোয়ান পবনবাবু, হেড বাবুর্চি ভোলামিঞা, রথের সারথী বুড়োদাদা মন্ত্রিবুড়োকে অনুসরণ করে চাদে উঠে এল।
মন্ত্রিবুড়ো ঘর ছেলে চলে যাওয়ার পর পরিরানি ক্লান্ত গলায় বললেন, যাও। তোমরা এখন যার যার ঘরে চলে যাও। ভোর হয়ে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়।
রাকা যদি ফেরে তো পরে দেখা হবে।
পরিরা সবাই ঘর ছেড়ে চলে গেল।
ততক্ষনে মন্ত্রীবুড়ো রানবাড়ির ছাদে উঠে এসেছেন। চোখে দূরবীন লাগিয়ে রাকাকে আকাশপথে খুঁজতে লাগলেন তিনি। মন্ত্রিবুড়ো রাকাকে ভীষন আদর করেন বলে তাঁর মুখে গভীর উদ্বেগ ফুটে উঠেছে।
রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। না রাকাকে কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না।
ওদিকে প্রায় শেষ রাতের দিকে ঘুম ভাঙল রাকার। চোখ ডলে চারপাশে তাকাল। উঠে বসল।
দেখল গাছের পাতা আর ডাল। আর কে যেন শুয়ে পাশে। এ কী! আমি এখানে কেন? আম্মু কই? রাকা ওর পাশে ওর আম্মুকে না দেখে কেঁদেই ফেলল। একটু পর কান্না থামিয়ে ও ভাবতে বসল। ধীরে ধীরে ওর সব মনে পড়ল।
কালরাতে ওর সঙ্গে পিদিম নামের সাদা ভূতটার পরিচয় হয়েছিল। এই তো পিদিম এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
আম্মুর জন্য এখন খারাপ লাগছে রাকার। ও ঠিক করেছিল পরির দেশে আর ফিরবেই না। দুধ না-খাওয়ার জন্য বকার জন্য ওর আম্মুর ওপর ভীষণ অভিমান হয়েছিল।
ভাবতেই রাকার ছোট্ট বুকটা হিম হয়ে এল। আর বুক ভেঙ্গে কান্না পাচ্ছিল। আম্মুটা যে কী। এমন করে বকল। কেউ বকলে রাগ করে না বুঝি।
এতসব ভেবে ও ঠিক করে ছিল এই পৃথিবীতে থাকবে পরিদের দেশে আর ফিরে যাবে না। অথচ এখন ওর আম্মুর মুখটা মনে পড়তেই ও পরির দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল।
ঝিলিমিলি নদীর ধারে ঘাসের বনের দিকে উড়ে গেল রাকা।
এই দৃশ্যটাও দেখে গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ল গড়ান।
বালুচরটা ফাঁকা পড়ে আছে দেখে রাকার বুকটা ছ্যাত করে উঠল।
এ কী ! গেল কই সব? ওরা কি আমাকে ফেলেই চলে গেল নাকি? ভাবতে-ভাবতে বালুচরে, ঘাসের বনের গভীরে তন্নতন্ন করে খুঁজল। খুঁজল বটে , কিন্তু কাউকে না পেয়ে ভীষন কান্না পেল রাকার। ওরা সবাই মনে হয় আমাকে ফেলেই চলে গেছে। কী আর করা। আমি তা হলে একাই পরির দেশে ফিরে যাই।
এই ভেবে একাই আকাশে উড়ল রাকা ।
একটু জোরেই উড়তে থাকল ও। দেরি হলেই যে সর্বনাশ! চাঁদটা ডুবে গেলে যে আর পরির দেশে ফেরাই হবে না। আর পুবদিকে সূর্যটা উঠলে যে সর্বনাশের চূড়ান্ত হবে। সূর্যের আগুনে পাখা খসে পড়বে যে।
তখন ধপাস করে নীচের মাটিতে পড়ে যেতে হবে।
রাকা এই ভয়টাই পাচ্ছিল। চাঁদটা পশ্চিমে ডুবে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। আর আকাশের পূর্বকোণে ফুটে উঠল রঙের আভাস ।
সর্বনাশ!
সূর্য উঠছে।
রাকা প্রাণপন ডানা ঝাপ্টাচ্ছিল। যে করেই হোক সূর্য ওঠার আগে রানবাড়ি পৌঁছতেই হবে।
ইস, তখন কেন যে ঘুমিয়ে পড়লাম। এখন? পুড়ে মরতে হবে। ভাবতেই রাকার চোখে জল ভরে এল।
ও চোখের কোণ দিয়ে পুবে দেখছিল আর প্রাণপ্রন ডানা ঝাপ্টাচ্ছিল। যদি সূর্যের তাপে ডানার মোম গলে যায় আর আমি পড়ে যাই নীচে...
ঠিক এমন একটা সময়ে চোখে দূরবীন লাগিয়ে রানবাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে মন্ত্রিবুড়ো রাকাকে খুঁজছিলেন। না, রাকাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ঠিক এমন সময় কার যেন পায়ের শব্দ শোনা গেল। চোখ থেকে দূরবীন সরিয়ে মন্ত্রীবুড়ো দেখলেন রাকার বাবা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
দেখা যাচ্ছে কিছু?
মন্ত্রীবুড়ো আবার চোখে দূরবীন ঠেকিয়ে বললেন, না। হ্যাঁ। আরে ওটা কী। রাকা না তো। কী যেন দেখা যাচ্ছে নীল রঙের আকাশপথে।
রাকা কি? হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে। মন্ত্রিবুড়োর বুকটা আনন্দে দুলে উঠল। হ্যাঁ, রাকাই তো, প্রাণপনে ডানা ঝাপটে এদিকেই আসছে। জোরে জোরে পাখা ...ওর ডান দিকে আলোর রেখা সর্বনাশ সূর্য উঠছে। মন্ত্রীবুড়োর বুকটা কেঁপে উঠল।
কই দেখি। দাও, আমাকে দূরবীনটা দাও।
মন্ত্রীবুড়ো রাকার বাবাকে দূরবীনটা দিলেন। রাকার বাবা চোখে দূরবীন ঠেকিয়ে দেখলেন, রাকা এগিয়ে আসছে। ওদিকে ধীরে ধীরে সূর্যটাও উঠছে।
রাকার বাবা বললেন, হ্যাঁ, ওই তো। কিন্তু, সর্বনাশ! সূর্য উঠছে। রাকা তো তা হলে পুড়ে যাবে।
মন্ত্রীবুড়ো বললেন, আমিও সেটাই ভাবছি। আকাশপথটা একটু পরেই আগুনে ঝলসে উঠবে।
রাকার বাবা প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন। এখন কী হবে। রাকার ডানা দুটো যদি পুড়ে যায়!
রানবাড়ির দারোয়ান পবনবাবু, হেড বাবুর্চি ভোলামিঞা, রথের সারথী বুড়োদাদা -সবাই ছাদে উঠে এল। সেই সঙ্গে হলুদপরি আর আঁকা। হলুদ পরির মুখ শুকিয়ে গেছে।
ও আঁকার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন কী হবে ভাই?
আঁকা বলল, আমি ওই দৃশ্য দেখে সইতে পারব না। বলে ও চোখ বুঝল।
আঁকার কথা শেষ হল ঝুপ করে একটা শব্দ হল ছাদের ওপর।
কী হলো কী। আঁকা চোখ খুলে দেখল ছাদের ওপর দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে রাকা।
রানবাড়ির দারোয়ান পবনবাবু, হেড বাবুর্চি ভোলামিঞা, রথের সারথী বুড়োদাদা, হলুদ পরি, রাকার বাবা, মন্ত্রিবুড়ো -সবাই হইহই করে উঠল। রাকার বাবা আর মন্ত্রীবুড়ো ছুটে গেলেন রাকার কাছে। আঁকাও। ওর পাশে হলুদ পরি। দেখল রাকার ছোট্ট নীল রঙের মুখটি ঘেমে গেছে।
আরও নীল হয়ে গেছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ছোট্ট বুকটা ওঠা নামা করছে।
ব্যাথা পেয়েছিস মা ? রাকাকে জড়িয়ে ধরে রাকার বাবা জিগ্যেস করলেন। ইস, আরেকটু হলেই পুড়ে মরছিল।
ভাবতেই বুকটা শুকিয়ে আসছিল।
না তো। রাকা বলল।
মন্ত্রিবুড়ো রাকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম সুরে জিগ্যেস করলেন, মার কাছে যাবে রাকা?
হ্যাঁ, কাকা, আমি মার কাছে যাব। বলে কেঁদে ফেলল রাকা।
রাকার বাবা রাকাকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় নেমে এসে পরিরানির ঘরে নিয়ে এলেন।
পরিরানি তখনও কাঁদছিলেন। রাকাকে ওর বাবার কোলে দেখেই তবে পরিরানি কান্না থামল। শুধু তাই না, পরিরানির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
ধড়ফর করে উঠে বসে রাকাকে কোলে নিলেন পরিরানি, হাসলেন, রাকার গালে ও কপালে চুমু খেলেন। আর কোনও দিন রাকাকে বকবেন না বলে কথা দিলেন। রাজবাড়ির হেড বাবুর্চি ভোলা মিঞা আজ বাদাম দিয়ে তালমিছরির পায়েস রেঁধেছিলেন। রাকাকে কোলে বসিয়ে পরিরানি রুপোর চামচ দিয়ে তাই খাওয়ালেন ।
রাকা ফিরে এসেছে বলে রানবাড়িতে বইল খুশির বন্যা ।
মন্ত্রীবুড়োর সুপরামর্শে পরিরানি পরির দেশে সাত দিনের বিরতিহীন আনন্দ-উৎসবের ঘোষনা দিলেন
মার কোলে বসে পায়েস খাওয়া শেষ। রাকার এখন খুব ঘুম পাচ্ছে। ওর মা ওর ডানা দুটো খুলে রেখে নরম পালকের বিছানায় শুইয়ে দিলেন রাকাকে। শুয়ে পড়তেই রাকার নেমে এল রাজ্যে ঘুম। পরিরানি ওর মাথার কাছে বসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
আঁকাও রাকার খুব কাছে বসে থাকল ।
জানালার বাইরে তখন চাঁদ উঠেছে। পৃথিবীতে যখন দিনের শুরু তখনই পরির দেশে নেমে আসে রাত। আর পরির দেশে যখন দিনের শুরু হয় তখন পৃথিবীর লোকেরা দেখে যে সন্ধ্যা নামছে।
হ্যাঁ।
এটাই নিয়ম।
চলবে ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।