ভোরের তারা হয়ে একাকি পথ খুজি
আমার চিন্তা চেতনার জগতে বই এক বিরাট জায়গা নিয়ে আছে। কত কত দিন যে বইয়ের স্বপ্ন ডানায় ভেসে অন্য ভূবনে হারিয়ে গেছি তার ঠিক নেই। একেকটি বই যেন অদেখা একেকটি ভূবন, সেখানে না যেয়েও সেই ভূবনের রঙ, রুপ, মাধূর্য দেখেছি। জীবন চলার পথের কত সুখ, দুঃখ ভালবাসার টানাপোড়েন, কত কি যে জানলাম বইয়ের মাধ্যমে। ধন্য তুমি বই ধন্য।
যদিও এখন আর সেভাবে বই পড়া হয়ে উঠে না। নিজের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ভাবি কিশোর বয়সের সেই বইয়ের নেশা আজ কোথায় হারালো!!! তবুও কিছু কিছু বই আছে যাদের কথা শত ব্যস্ততার মাঝেও মনে পড়ে। জীবনে যাদের এত অবদান সেই বই গুলো নিয়েই ধারাবাহিক ভাবে কিছু বলার আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস(সরি লেখাটা একটু বড় হয়ে গেল। দুটো বই নিয়ে করা সমালোচনা এত বড় হওয়াটা ঠিক হয়নি)।
সেবার বরিশালে বেড়াতে গিয়াছিলাম কোন এক পরিচিতের বাড়ীতে।
ঢাকায় ফেরার পথে হাতে ধরিয়ে দিল দুটো বই । বইয়ের নাম দেখে মেজাজটা একটু খারাপই হল। কি সব অদ্ভুত নাম "লা নুই বেঙ্গলী" আর "ন হন্যতে"। আমি পড়ি হূমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল, সমরেশ........আর এরা এসব কি ছাইপাশ দিয়েছে পড়তে! বই দুটো নাকি এক সাথে জোড়া বেধে পড়তে হয় (লেখক লেখিকা দুইজনে নাকি একে অন্যের প্রতি উত্তরে বই দুটি লিখেছেন)। এই ব্যাপারটাও যথেষ্ট বিরক্তি উৎপাদন করল।
আমি পড়ব আমার ইচ্ছে মত, তা না কিসের নাকি জোড়া বেধে এইসব কাইজ্জা ঝগড়ার কাহিনী পড়তে হবে, যত্ত সব ডং! পাঠককে বাধ্য করা হচ্ছে বই দুটো পড়ার জন্য। ব্যবসায়িক ফায়দা আরকি!
ঢাকায় ফিরে বই দুটো সুন্দর করে শোকেসে সাজিয়ে রেখেছি । অনেক দিন হয়ে গেছে ছুয়েও দেখিনা। বই গুলো আমার দিকে আশার চোখে চেয়ে থাকে। পরীক্ষা শেষ, পড়ার কিছু নেই দেখে এক দিন বাধ্য হয়ে "লা নুই বেঙ্গলী" পড়া শুরু করলাম।
"লা নুই বেঙ্গলীর" অর্থ হচ্ছে বাঙ্গালীর রাত। ফরাসি লেখক মির্চা এলিয়াদ এর রচয়িতা। তিনি তার আত্মজীবনির ছায়াতেই বইটি রচনা করেছেন। কখনও কখনও সত্যের সাথে মিশিয়েছেন ফ্যান্টাসি। না পাওয়ার হাহাকার সেই ফ্যান্টাসির নীচে চাপা পড়ে গেছে, অপ্রাপ্তি গুলো পেয়েছে পূর্নতা।
প্রথমে পড়তে ভাল না লাগলেও ধীরে ধীরে কাহিনীর গভীরে ডুবে যেতে লাগলাম। এক সীমাহীন আকর্ষনে তীব্র আবেগে আন্দোলিত হতে লাগলো আমার হৃদয় জানালার কপাট গুলো। বয়স কম ছিল তাই হয়তো আবেগটাও বেশী ছিল।
গল্পের সময়কাল বৃটিশ পিরিয়ড। মির্চা ফ্রান্স থেকে ভারতে এসেছেন ভারতীয় ভাষার উপর জ্ঞান অর্জনের জন্য।
গুরু মেনে সে শিষ্যত্ব গ্রহন করে নায়িকা মৈত্রেয়ী দেবীর বাবার। গুরুর বাড়ীতেই শিষ্যের ঠাই হয়। প্রথম প্রথম নিজের সাদা চামড়ার জন্য তার আচরনে অহংকার কাজ করতো। ধীরে ধীরে সেই অহংকারের জায়গা দখল করে তার ভারতীয়দের সাথে মিশে যাবার প্রবনতা। একটা সময় আবিষ্কার করে, সে মৈত্রেয়ীকে ভালবেসে ফেলেছে।
মির্চার কিছু কিছু ভালবাসার নমুনা না বললেই নয়। খাবার টেবিলে মৈত্রেয়ীর উপর অভিমান করে একটার পর একটা ভয়ংকর ঝাল মরিচ চিবিয়ে খাওয়া। ভীনদেশী তরুনের এই কান্ড অবাক করেছে আমাকে। বিদেশীরাতো জানতাম ঝাল সহ্যই করতে পারে না। আমরা বাঙালীরাই যেখানে সবাই ঝাল খেতে পারি না, আর সেতো ইউরোপীয়ান সাদা চামড়া!!!
আরেকটা ঘটনা ছিল এরকম- ওদের ভালবাসাবাসির কথা তখন জানাজানি হয়ে গেছে, গুরু শিষ্যকে নির্দেশ দিল তক্ষুনি তার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে।
বেচারা মির্চা অক্ষরে অক্ষরে গুরুর নির্দেশ পালন করল। একটি বারের জন্যও মৈত্রেয়ীর সাথে দেখা করার চেষ্টা করল না। অথচ কি অসম্ভব ভালই না সে বেসেছিল মৈত্রেয়ীকে। যে ধৈর্য্য, সহ্য, ভদ্রতা সে দেখিয়েছে তা বিরল। হতে পারে তখনকার দিনের সমাজ ব্যবস্হা এত নিয়ন্ত্রিত ছিল যা একজন বিদেশীকেও ব্যতিক্রমী হতে দেয়নি।
তবুও মানুষ বলে কথা।
মৈত্রেয়ীকে হারিয়ে মির্চা তখন দিশেহারা, পাগল প্রায়। এই সমাজ সংসার কিছুই তাকে ধরে রাখতে পারে না। শান্তির অন্বেষায় সে চলে যায় হিমালয়ে। সেখানে নাগা সন্নাসীদের সাথে ভীড়ে যায়, তাদের মত করে গেরুয়া পোশাক পরে খালি পায়ে ঘুরে বেড়ায়।
সেখানে গুহায় বসে আহার নিদ্রা ত্যাগ করে ছয় ছয়টি মাস মৈত্রেয়ীর ধ্যানে কাটিয়ে দেয়। এরপর কিছুদিন যাযাবরের মত এখানে সেখানে ঘুরেফিরে ফিরে যায় ফ্রান্সে। কয়জন প্রেমিক পারে প্রেমিকার জন্য সমাজ সংসার ত্যাগ করে সন্নাসী হয়ে হিমালয়ে চলে যেতে! তাও আবার বিদেশী, যাদের কিনা পারিবারিক মূল্যবোধ স্নেহ ভালবাসার বন্ধন বড় ঠুনকো, নড়বড়ে।
ফ্রান্সে ফিরে ত্যাগ তিতীক্ষা হতাশা আর না পাওয়ার হাহাকার থেকে লিখল "লা নুই বেঙ্গলী" নামক অসাধারন এই বই খানি। তবে বইয়ের সমাপ্তি তিনি খুবই বাজে ভাবে টেনেছেন।
পাঠককে অকুল পাথারে ভাসিয়ে দিয়ে হঠাৎ করেই তিনি কাহিনীর সমাপ্তি টানেন। অবশেষে কাহিনীর কি হল না হল পাঠক সেটা জানার আকুলতা নিয়ে কষ্ট পেতে থাকে। মির্চা সাহেবের এই দিকটাতে খেয়াল রাখা উচিত ছিল।
এবার অবশিষ্ট কাহিনী জানার তীব্র আকুলতা নিয়ে "ন হন্যতে" নিয়ে বসলাম। "ন হন্যতে" অর্থ হল দেহের ভিতর।
বইটির লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবী। অবাক হলাম এই ভেবে যে এইটুকু একটা কিশোরী মেয়ে ভালবাসার মানুষের জন্য বই লিখে ফেলেছে!!!প্রথম কয়েক পাতা পড়ে খেলাম বিরাট ধাক্কা। এই মৈত্রেয়ী দেবী বয়স্ক একজন মহিলা, যার কিনা স্বামী,পুত্র,পুত্র বধু,নাতি আছে। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে লাগলাম এই মৈত্রেয়ী দেবীই কি মির্চা এলিয়াদের সেই মৈত্রেয়ী দেবী?
অস্বীকার করব না প্রথমে বইটা আমাকে সেভাবে টানলো না তবুও জোর করে পড়তে লাগলাম। নিঃসন্দেহে তিনি অনেক উচচমার্গীয় লেখিকা।
তার চিন্তা ভাবনার বেশীর ভাগই আমার মাথার উপর দিয়ে গেল। এই সব গুরু গম্ভীর কথা পড়তে বেশ বিরক্ত লাগছিল। ঐ ছেলে মানুষী বয়সে হালকা ধরনের লেখা গুলোই যে ভাল লাগতো। যাই হোক পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে দিয়ে পড়তে লাগলাম। শেষে এসে গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়লাম বই খানির সাথে।
এই লেখিকার জীবন বোধ, দৃষ্টিভঙ্গি মির্চার তুলনায় নিঃসন্দেহে অনেক গভীর। তার লেখায় উঠে এসেছে তৎকালিন ইংরেজ শাসিত ভারতের সমাজ ব্যবস্হা, জীবন যাপন। তিনি ছিলেন উচ্চ শিক্ষীতা। সেই বৃটিশ পিরিয়ডে তার পরিবারের শিক্ষা প্রীতী চোখে পড়ার মত। প্রথম প্রথম মৈত্রেয়ী দেবীকে আমার বেশ শক্ত প্রকৃতির মহিলা বলে মনে হয়েছে।
আসলে মির্চা বই লিখেছিলেন তার যুবা বয়সে আর মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছেন তার জীবন সায়াহ্নে এসে। আবেগের পরিনতির পার্থক্যতো থাকবেই। তবে মৈত্রেয়ী দেবী কোন ফ্যান্টাসির আশ্রয় নেননি, যা সত্য তাই তুলে ধরেছেন।
এটা ঠিক এই বই তিনি লিখেছিলেন অনেকটা বাধ্য হয়েই। মির্চা বই লেখার পর তা নিয়ে হুলুস্হুল পড়ে যায় ফ্রান্সে।
সেই উত্তেজনার ধাক্কা ভারতে এসেও লাগে। ভারতীয় শিক্ষিত সমাজও মির্চার লিখিত বইয়ের সাথে সমান ভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। তাইতো মৈত্রেয়ী দেবী যেখানেই গেছেন সমালোচনার তীর তার গায়ে এসে লেগেছে। লোকজন অর্থ পূর্ন হাসি হেসেছে। কয়েক জন ফরাসিতো বলেই ফেলল "তুমি আমাদের দেশের জাতীয় নায়িকা"।
তৎকালিন রক্ষনশীল সমাজে একজন বিবাহিতা মেয়ের এই ধরনের পরিস্হিতিতে পড়া সত্যিই পীড়াদায়ক। অবশেষে তিনি মির্চার বইটি যোগাড় করে পড়লেন। পড়ে বুঝলেন তিনি মির্চার ফ্যান্টাসির জালে আটকে গেছেন, তার চরিত্র হনন হয়েছে। সব মিলিয়ে তাই বাধ্য হলেন "ন হন্যতে"র মাধ্যমে আসল ঘটনাটি তুলে ধরতে।
মৈত্রেয়ী দেবীর চোখ দিয়ে তার প্রেমকে যতটুকু উপলব্দী করলাম তা হল তার কৈশরের প্রথম প্রেম ছিল মির্চা।
তাই অন্য রকম এক আবেগ সেখানে কাজ করেছিল। মির্চা যতটা গভীর প্রনয়ের কথা বলেছেন আসলে তার ছিটেফোটাও ছিল না তাদের প্রেমে। তাদের ভালবাসা ছিল সম্পূর্ন ঐশ্বরিক। মির্চাকে বাড়ী থেকে বের করে দেবার পর স্বাভাবিক ভাবেই মৈত্রেয়ী দেবী ভীষন ভাবে ভেঙে পড়েন।
মেয়েকে স্বাভাবিক করতে মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা পুরো পরিবার নিয়ে বেড়াতে যান হিমালয়ের কোন এক নয়নাভিরাম স্হানে।
কাকতালীয় ভাবে এই জায়গাটি হল সেই জায়গা যেখানে মির্চা মৈত্রেয়ীর ধ্যানে গুহায় ছয় ছয়টি মাস কাটিয়ে দিয়েছিলেন। মৈত্রেয়ী দেবী একে ওকে জিজ্ঞাসা করে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করলেন। সেই গুহাটাতেও গেলেন যেখানে মির্চা এত গুলো দিন কাটিয়েছেন। আমার মনে আশার সঞ্চার হল এই বুঝি দুজনের দেখা হতে চলেছে। কিন্তু না তেমন কিছুই হল না।
উল্টো দুজনের মধ্যে লক্ষ, কোটি যোজন যোজন দূরত্ব তৈরী হয়ে গিয়েছিল। মৈত্রেয়ী দেবী গুহায় গেলেন ঠিকই কিন্তু সেখানে মির্চার ব্যবহার্য কিছু জিনিস ছাড়া আর কিছুই পেলেন না।
এরপর মৈত্রেয়ী দেবী আরো বেশ কিছু দূর তার পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যান। একটা সময় তার বিয়ের কথাবার্তা চলতে থাকে। মৈত্রেয়ীতো কিছুতেই বিয়ে করবেন না।
বইয়ের এখানে একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করেছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কাহিনীতে এসে পড়লেন। মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা এবং মৈত্রেয়ী দেবী নিজেও রবীন্দ্রনাথের একান্ত ঘনিষ্ঠ শিষ্য ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীকে তুই করে সম্বোধন করতেন। মৈত্রেয়ীর বাবা কবিকে অনুরোধ করলেন মৈত্রেয়ীকে বুঝানোর জন্য।
কিন্তু কবি সেই রাস্তায় গেলেন না। জেনে নিলেন মৈত্রেয়ীর ইচ্ছার কথা এবং তাকে তার জ্ঞান,বুদ্ধি বিবেক বিবেচনা ব্যবহার করে চলতে বললেন।
এই সময়টায় মৈত্রেয়ীর এত রাশভারী আদর্শবান বাবা জড়িয়ে পড়েছিলেন অনাকাক্ষিত এক প্রেমের সম্পর্কে। মহিলাটি তখন তার পি এইচ ডি কমপ্লিট করছিলেন। সেই মহিলাই মৈত্রেয়ী আর রবীন্দ্রনাথের কথোপকথন চুরি করে শুনে ফেলেন।
এরপর তা লাগিয়ে দেয় জায়গা মত। ফলে মৈত্রেয়ীর বাবা আরো ক্ষেপে যান এবং উঠে পড়ে লাগেন মেয়েকে পাত্রস্হ করতে। অবশেষে মৈত্রেয়ী বাধ্য হলেন বিয়ে করতে। বর হিসেবে যিনি তার জীবনে এলেন তিনি ছিলেন সরকারি চাকুরিজিবী এবং পি এইচ ডি ডিগ্রীধারী। সত্যি বলতে মৈত্রেয়ী দেবী অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত,শান্ত একজন মানুষকে তার জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন।
যিনি তাকে ভীষন রকম সম্মান দিয়েছিলেন, দিয়েছিলেন অগাধ ভালোবাসা। ভদ্রলোক কোন দিন মুখ ফুলে একটা কটু কথাও বলেননি, আর ছিলেন মৈত্রেয়ীর প্রতি ভীষন রকম কেয়ারিং। মৈত্রেয়ী দেবীর ভালবাসার ভাগ্য সত্যিই ঈর্ষনীয়।
জীবন চলে যায় জীবনের নিয়মে। স্বামীর বদলির চাকরির সুবাদে ভারতের এখানে সেখানে যাবার অভিজ্ঞতা হয় মৈত্রেয়ী দেবীর।
ইংরেজ হেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতের পদের মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ হয়। ফলে ভাবনা চিন্তার ভান্ডার হয় কানায় কানায় পূর্ন। চিঠি পত্রের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ হোত তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ কখনো সখনো কিছুদিনের জন্য হলেও মৈত্রেয়ীর কাছে এসে বেড়িয়ে যেতেন।
মৈত্রেয়ীর বাবা মাঝে মাঝেই মির্চা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য মেয়েকে জানাতেন। যেমন মির্চা মৈত্রেয়ীকে নিয়ে আজে বাজে কথা বলে বেড়াচ্ছে, সে নাকি তার পর্ন লেখালেখির জন্য জেল খেটেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
পরে মনে হল এই সব কথার বেশীর ভাগই মিথ্যাচার ছিল। ততদিনে মির্চা বিয়ে করেছেন, লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
এদিকে বিভিন্ন মানুষের টিপ্পনি,বাকা কথা শুনে শুনে মৈত্রেয়ী দেবী বইটি পড়লেন এবং মির্চার ঠিকানা যোগাড় করে চিঠি লিখলেন। বেশ কয়েকটি চিঠিই তিনি লিখেছিলেন। কিন্তু মির্চা একটিরও উত্তর দিলেন না।
অতঃপর মৈত্রেয়ী দেবী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি মির্চার সাথে দেখা করবেন। স্বামী বড় চাকুরে হবার সুবাদে শুধু দেশেই নয় বিদেশে যাবার সুযোগও হরহামেশাই তৈরী হোত। ফ্রান্সে, লন্ডনে বিভিন্ন দেশে তিনি তিন চার বার করে অল্পের জন্য মির্চাকে ধরতে পারলেন না। মির্চা কিভাবে যেন আগেই টের পেয়ে সরে যান। মৈত্রেয়ী দেবী বুঝে উঠতে পারেন না কেন মির্চা তার সাথে দেখা করতে চান না? কেন তার চিঠির উত্তর দেন না? বলাই বাহুল্য তার স্বামী তাকে এই ব্যাপারে যথেষ্ট সহোযোগিতা করেছেন।
শেষবার প্রতিজ্ঞা করে বের হলেন এই বার মির্চাকে খুজে বের করবেনই করবেন। তার ফ্রান্সে আসার খবর কাক পক্ষী কাউকেও জানতে দিলেন না। খোজ নিয়ে জানতে পারলেন মির্চা স্হানীয় একটি ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরীর শিক্ষক। মৈত্রেয়ী দেবী সোজা সেই ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে চলে গেলেন। খুজে বের করলেন লাইব্রেরী রুম।
এই জায়গাটা একটু ডিটেইলস করে বলি। বইয়ের এখানে একটা লাইন আছে যা আমার ভীষন ভীষন প্রিয়।
মৈত্রেয়ী দেবী সিড়ি বেয়ে উঠছেন, দোতালায় লাইব্রেরী রুম। আর একটু পরেই মির্চার সাথে তার দেখা হবে। মৈত্রেয়ী দেবী রুমে ডুকলেন।
হেটে হেটে রুমের শেষ প্রান্তে চলে এলেন। এসে দেখেন এক পৌঢ় ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে আছেন, স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ এবং মৃদু কাপছেন। মৈত্রেয়ী দেবী দেখলেন বয়সের আড়ালে লুকিয়ে আছেন সেই মির্চা এলিয়াদ। মির্চা বললেন "সিড়িতে তোমার পায়ের আওয়াজ শুনেই বুঝেছি তুমি এসেছ"(এটাই আমার প্রিয় লাইন)। এক অসম্ভব কষ্ট মেশানো ভাল লাগা পেয়েছিলাম আমি তখন।
কি করে একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে এতটা ভালবাসতে পারে যে ত্রিশ চল্লিশ বছর পরেও ভালবাসার মানুষের পায়ের আওয়াজ মনে রাখতে পারে!
এরপর শেষবারের মত তাদের মধ্যে কিছুক্ষন কথোপকথন হয় যার সবটা আমার মনে নেই(এগারো বছর আগে পড়েছিলাম, স্মৃতিতো প্রতারনা করবেই)। তবে হে মির্চা মৈত্রেয়ীর সব চিঠিই পেয়েছিলেন, ইচ্ছে করেই কোন উত্তর দেননি এবং ইচ্ছে করেই দেখা দেননি। কেন যে দেননি তার সেই উত্তর এখন আর মনে পড়ছে না। আর তিনি মৈত্রেয়ীর সব খোজ খবরই রাখতেন। এমনকি যতবার তিনি ফ্রান্সের মাটিতে পা রেখেছেন ততবারই তিনি তার আসার খবর পেয়ে গিয়েছিলেন।
মৈত্রেয়ী জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন তাকে নিয়ে প্রনয় লীলার কথা লিখেছেন? উত্তরে মির্চা বলেছিল "মৈত্রেয়ী তার কাছে ছিল দেবীর মত, আর দেবীরাতো অভিসারে যায়ই"। আমার মনে হয় বাস্তবে না পেলেও লেখার মাধ্যমে তিনি মৈত্রেয়ী দেবীকে গভীর করে পেতে চেয়েছিলেন। মির্চার শেষ কথা গুলো ছিল কিছুটা এরকম "এই জনমে তোমাকে পেলাম না, কিন্তু পরের জনমে নিশ্চই পাব, কোন এক নদী তীরে দু হাত বাড়িয়ে সেদিন আমি তোমাকে গ্রহন করব "।
ফিরে এসে সমাজ সংসারের ভয় না করে মৈত্রেয়ী দেবী লিখেন তার এই বিখ্যাত ব্ই "ন হন্যতে"। যা বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন।
আরো অনেক পরে তার এই বই নিয়ে মুম্বাইয়ের বিখ্যাত পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানশালী তৈরী করেন তার বিখ্যাত ফিল্ম "হাম দিল দে চুকে সানাম"। এতে ঐশ্বরিয়া অভিনয় করেন মৈত্রেয়ী দেবীর ভূমিকায় আর সালমান করেন মির্চার ভূমিকায়। পরবর্তীতে এই ছবি, ছবির পরিচালক এবং তার কলাকুশলিরা ফিল্ম ফেয়ার এ্যাওয়ার্ড পান। কথিত আছে পরিচালক কাহিনী ব্যবহারের পারমিশন টুকু পর্যন্ত মৈত্রেয়ী দেবী বা তার পরিবারের কাছ থেকে নেননি।
খুব ইচ্ছে ছিল এই দুজনের সাথে দেখা করব।
কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে যে অনেক ফারাক থাকে। যতটুকু জেনেছি মির্চা পরলোকগমন করেছিলেন আর মৈত্রেয়ী দেবী এত দিনে নিশ্চয়ই আর বেচে নেই। কোথাকার কোন মৈত্রেয়ী দেবী আর মির্চা এলি্যাদ চিনি না জানি না তবুও কেন যে তাদের জন্য এত মায়া আর ভালবাসা কাজ করে বুকের ভিতর!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।