আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চন্দ্রকথা-জোছনা

গোধুলি ভালবাসায় ভিজে একসারা একাকী একজন।

'' কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না রাত কাটে তো ভোর দেখি না কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না, কেউ জানে না'' ছাদে বসে বসে দেখছি রাতের আকাশ। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। কালচে নীল আকাশে ভেসে যাচ্ছে সাদা সাদা মেঘের ভেলা। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে চাঁদের ঝকঝকে রুপ।

আজ পুর্ণিমা। চারদিক ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। আনমনেই আউড়ে যাচ্ছি প্রিয় প্রিয় কবিতা গুলো। এত ভাল লাগছে কেন সব কিছু আজ? এমন অপরুপ জোৎস্না যেন আগে কোন দিন দেখিনি। এত সুন্দর রাত এর আগে কখনও আর আসেনি।

প্রেমে পড়লে নাকি সবকিছুই ভাল লাগে সব কিছুই সুন্দর মনে হয়। আসলে কি তাই? আমি কি সত্যিই প্রেমে পড়ে গেলাম অচেনা একটা মেয়ের? অবশেষে সে এসে গেল আমার জীবনে? উফফ! কি দীর্ঘ অপেক্ষাই না করিয়েছে সে আমাকে দিয়ে! আবেগের বন্যায় ভাসছে হৃদয়। কে যেন পেছনে এসে দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি অজিত হাতে জলন্ত সিগারেট। ' কি করিস অন্ধকারে বসে বসে?' অজিত আমার পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করে।

ইশারায় উপরটা দেখাই। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে অজিত কিছুক্ষণ তারপর মৃদু স্বরে জানতে চায় ' তুই কি প্রেমে পড়েছিস ঐ মেয়েটার?' এখানে আসার পর থেকে এই নিয়ে কম করে হলেও পঞ্চাশবার এই একই প্রশ্ন করল অজিত। বৌদিও দু'বার জিজ্ঞেস করেছে। কিছু বলিনি এড়িয়ে গেছি প্রতিবার। আসলে নিজের মুখে এই পবিত্র সত্যটা স্বীকার করা সহজ নয় কারো জন্যই।

অজিত আমার কাঁধে একটা জোর ঝাকুনি দেয় ' কি হলো ? চুপ করে আছিস যে?' হেসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলি ' পাগল হয়ে গেলি নাকি! পোকার মত ভিনভিন করেই যাচ্ছিস?' ' না সিরিয়াসলি বল' অজিত ঘুরে আমার মুখোমুখি বসে। চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ। তারপর কাঁপা গলায় বলি ' হয়ত। মনে হচ্ছে সেরকমই। ' এই কটা কথা বলতেই ঘেমে যাই।

নার্ভাস ভঙ্গীতে একটু হাসি। শোনায় ঠিক গোঙ্গানির মত যেন গলায় ব্যাং ঢুকেছে। অজিত চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে দেখে কেমন অসস্তি লাগে। দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। অজিতের বাড়িতে যেদিন প্রথম আসি আমরা কি ভীতই না ছিল চন্দ্র সেদিন।

অজিত আর বৌদির উষ্ণ অভ্যর্থনা আর আন্তরিকতা ওকে সহজ করে তুলতে বেশ সাহায্য করেছে। ঝর্না বৌদির কাছে এজন্য চিরকৃতজ্ঞ আমি। হয়ত চন্দ্রও। প্রথম দিনের সেই বিভীষিকাময় সময়কে পেছনে ফেলে অজিতের বাড়িতে ঢুকেই চন্দ্র অচেতন হয়ে পড়ে। এত্ত ভয় পেয়েছিলাম তখন! অজিতের তখন পর্যন্ত ধারনা যে চন্দ্র আমার বৌ ।

'কি রে তুই বৌয়ের সাথে কি করেছিস?' অজিত আর্তনাদ করে উঠে। ' আমার বাড়িতে পা দিয়েই সেন্সলেস?! 'আহ! তুমি থামবে?' ঝর্না বৌদির চাপা কন্ঠের ধমক খেয়ে চুপ করে গেল অজিত। বৌদির সেবা শুশ্রূষা ওকে সুস্থ করে তুলল। চন্দ্রকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বৌদি আমার কাছে এসে বসে জানতে চাইল ' কি হয়েছে বলো তো? মেয়েটা এত ভয় পেয়েছে কেন? ঘুমের মাঝেও কেঁপে কেঁপে উঠছে। ' একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুলে বলি ওদের সব ঘটনা।

'মেয়েটা যে সত্যি বলছে শিওর হচ্ছিস কিভাবে? এমনও তো হতে পারে মেয়েটা ঐ বদমাশদেরই একজন। ' অজিতের এহেন সন্দেহমূলক কথাবার্তা আমার একটুও ভাল লাগছিলো না। 'ও কেন খারাপ হতে যাবে? ও তো জানতই না ওর স্বামী নারীপাচারের সাথে জড়িত। ' তীব্র প্রতিবাদ করি। ' হয়ত সে তোকে ধরে এই ফাঁদ থেকে বের হতে চেয়েছিল।

হতে পারে না? একটু চিন্তা করে দেখ মেয়েটা আর ওর স্বামী একসাথে ছিল স্টেশনে। সেখান থেকে কেমন করে শুধু ওর হাসবেন্ডই আলাদা হয়ে গেল? যে কিনা ওকে বিক্রি করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে ট্রেনে সে তার পন্যকে ফেলে চলে যাবে এটা হতে পারে? কোন ব্যবসায়ী করে কখনও এমনটা? আমার যা মনে হচ্ছে তা হলো মেয়েটা স্টেশনে ঐ লোকগুলিকে দেখেই কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিল। নাহলে সে অন্য্ বগীতে উঠত না। এটাই সম্ভাব্য ব্যাখ্যা। ' অজিতের কথা গুলোয় যুক্তি আছে।

কিন্তু এই যৌক্তিক কথা গুলি মেনে নিতে চাইছে না মন। 'চন্দ্র নির্দোষ আমি জানি। ' জোর গলায় জানিয়ে দিই ওদের শোনায় ঠিক ঘোষনার মত। অজিত কি যেন বলার চেষ্টা করে থেমে গেল। আমিও আর কথা বাড়াইনি।

এরমাঝে একদিন গেলাম নতুন চাকরীর জায়গায়। ইন্টারভিউ দিলাম। ভালই হয়েছে। এখানে চাকরী হলে খুব ভাল হয়। সুযোগসুবিধা ভাল।

কর্মচারীদের ঠকায় না শুনেছি। আশা করছি আগেরটার চাইতে ভাল হবে। চন্দ্র খুব চুপচাপ থাকে সারাক্ষণ। ওর এই দীর্ঘ নিরবতা ভাঙ্গার অনেক চেষ্টা করি আমি আর অজিত । চেষ্টা করি ওকে ভুলিয়ে দিতে যন্ত্রনাময় অতীত।

খুব একটা লাভ হয়না। ওকে অবশ্য এজন্য দোষ দেয়া যায় না। অচেনা একটা বাড়িতে এতগুলো অচেনা মানুষের মাঝে সহজ হওয়া যায় না আসলে। সেই রাতের পর থেকে ঐ বিষয়ে আর কোন কথা হয়নি আমাদের মাঝে। চন্দ্র কথাই বলেছে এই কদিনে খুব কম।

একমাত্র ঝর্ণা বৌদিকে কাজে সাহায্য করার সময় কিছু কথা সে বলে। দুশ্চিন্তার কালো মেঘে ঢেকে আছে আমার চন্দ্র। তার অনিন্দ্য সুন্দর মুখে এমন বিষাদ দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না। খুব ইচ্ছে করে ওর সব কষ্ট সব বিষাদ এক নিমেষে উড়িয়ে দিই। কালো মেঘেরা দূরে সরে যাক, হেসে উঠুক চন্দ্র আর সেই জোৎস্নায় ভেসে যাই আমিও।

আজ খুব ভালো লাগছে। তার তিনটি কারণ আছে। এক আমার চাকরীটা হয়ে গেছে। দুই কারখানা গোবিন্দপুরের খুব কাছে বাসে যেতে আধঘন্টা মত লাগে। আর তিন আজ আমার চন্দ্র এই এত্ত গুলো দিনের মাঝে আজই প্রথম হেসেছে।

খুশির হাসি। আমার চাকরীর খবর ওকেই প্রথম জানিয়েছিলাম। উফফ!! এত সুন্দর করে হাসো তুমি! বুকের মাঝে ব্যথার মত সুখ বাজছিল রিনিঝিনি শব্দে। 'কি ভাবছিস এত?' অজিত মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে। 'নাহ! তেমন কিছু না' নড়েচড়ে বসি।

চন্দ্রকে দেখতে ইচ্ছে করছে এমন ভরা পূর্ণিমায়। অজিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে 'চন্দ্র কি বুঝতে পারে তোকে? অবশ্য না বোঝার কিছু নেই। তুই যেমন হা-আ-আ করে তাকিয়ে থাকিস মেয়েটার দিকে সারাক্ষণ। চোখ দিয়ে পারলে গিলেই খেয়ে ফেলতি কপ করে। ' মার ছুটে আসছে দেখে দৌঁড় লাগালো শয়তানটা হাসতে হাসতে।

নিজের অজান্তেই হেসে ফেলি। আসলে অজিত ভুল বলেনি। চন্দ্র আমার সামনে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে। এত দেখেও মনে হয় দেখার সাধ বুঝি মিটবে না। 'অরন্য' আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল।

চন্দ্র ডাকছে। 'অরন্য আছেন এখানে?' প্রচন্ড ভালো লাগায় আক্রান্ত হলাম আবার। খুব চাইছিলাম ও আসুক। ও এসেছে। দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়িঘরের মুখে।

আবছা ওর অবয়ব দেখছি। মনে মনে ওকে বলি- ''হে প্রিয়তম, তুমি কি দূর থেকেই আমাকে দেখবে? আজ বাহিরে কি অপূর্ব জোছনা! সেই আলোয় তুমি এবং আমি কখনো কি নিজেদের দেখবো না?!'' 'অরন্য আছেন?' চন্দ্রের ডাকে ঘোর কেটে যায়। 'এই যে আমি এখানে চন্দ্র। চলে আসুন'। ও এসে আমার পাশে দাঁড়ায়।

'আমায় ডেকেছেন?' চন্দ্রের প্রশ্ন শুনে অবাক হই। ও জানল কেমন করে যে আমি ওকে ডেকেছি! 'বসুন না। ' আমার পাশে বসতে বসতে ও বলল ' কি ব্যাপার বলুন তো? অজিতদা বললেন খুব জরুরী। কি হয়েছে?' আচ্ছা! তাহলে এই ঘটনা! অজিতের শয়তানি। ওকে কিছু বললাম না।

হেসে বলি ' হয়েছে তো। আমার সর্বনাশ। এমন পাগল করা চাঁদ! আর দেখেছেন কি অপূর্ব জোছনা। খুব সুন্দর একটা রাত। ' মুগ্ধ গলায় চন্দ্র বলে 'সত্যি পাগল করা! কতদিন যে এমন আকাশ দেখিনি!' মুগ্ধ নয়নে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে চন্দ্র।

আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে মনে বলি 'ভালবাসি! ভালবাসি! ভালবাসি চন্দ্র আমার চন্দ্রপ্রভা!!' সচকিতে ও ফিরে তাকায় কেন জানি। শুনে ফেলল নাকি? অস্বস্তি এড়াতে ওকে বললাম 'কবিতা শুনবেন?' ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। '' বলার জন্য দাঁড়িয়ে আছি মাঠ দাঁড়িয়ে পাশে। মাঠের পাশে এত আকাশ, সন্ধ্যাবেলা খুঁজি খুঁজতে খুঁজতে রাত্রি আসে, চাঁদ নেমে যায় গাছে ধনুক বাঁকা তীরন্দাজের হাত নিশানা ভুলে পাগল হাওয়া তোমার রাতে স্বর্গচ্যুত পাতা।

। কিংবা ভাবো মধ্যরাতের বেপরোয়া বাঁশি কে যে কখন শুনতে পাবে বলবে ভালবাসি। আর কিছু নয়...'' (চলবে) চন্দ্রকথা-প্রেম Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।