প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়, আমি মানুষ হিসেবে একটু একটু জ্ঞানী হয়ে উঠি, দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়, আমি সমস্ত মানুষ থেকে আলাদা হয়ে এক অচেনা রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যাই বয়সের শুরু তিন কি চার আমি মায়ের কোল,বাবার কোল, ভাইয়ের কোল থেকে পড়শিদের কোলে ঘুড়ে বেড়াই। আমি মেয়ে বলে সবাই কাছে টানে, আদর করে আরো কত কি। কত কদর আমার, আমি মেয়ে !!
যখন দশ এগারো বছর, শরীরে হালকা পরিবর্তন, গায়ের জামা খুলতে আমার অস্বস্তি ! যদি কেউ দেখে ফেলে। পাড়ার ছেলে, বুড়োগুলো যখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকত বুঝতাম না তখন। এখন বুঝি ওরা মনে মনে আমার শরীরের স্বাদ নিত।
স্কুল, কলেজ জীবন পার করতে গিয়ে প্রেমে পড়েছি কতবার, কিন্তু পুরুষের সেই শরীর দেখা, কটুক্তির হাত থেকে রেহাই পাইনি। প্রতিবাদ করতে পারিনি। ভয়, যদি কোন অঘটন ঘটে।
এখন বড় হয়েছি, দেখি কত পুরুষকে, নিজেরা গনিকাবৃত্তিতে ইন্ধন যুগিয়ে পতিতার সাথে রাত কাটায় আর বাসর রাতে বউকে বলে আমি পবিত্র। জীবনে তুমিই প্রথম।
তুমিই আমার ভালবাসা। আমি দেখি, সেই পুরুষ যারা রাস্তায় মেয়ে দেখলেই শকুনের মত তাকিয়ে থাকে, জিহ্বা নাড়তে থাকে নেড়ি কুকুরের মতো । আমি বিস্মিত হই, যখন দেখি আমার সুদর্শন স্বামী কিংবা প্রেমিক আমার অনুপস্থিতে রুমে অন্য নারীকে নিয়ে বেডরুমে সময় পার করে।
যৌবনে আসে, কত পুরুষ আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, কখনো আমি ফিরিয়ে দেই। কখনো গ্রহণ করি।
কিন্তু সেখানেও দেখি সর্বনাশের হাতছানি , পুরুষ আমাকে প্রেমের প্রলোভন দেখিয়ে কেবল শরীরটাকেই পেতে চায়। কেড়ে নিতে চায় আমার সত্বীত্ব। নেয়া শেষ হলেই কেটে পরে। আমি চাইনা অচেনা কোন পুরুষকে শরীরটা ভোগ করতে দিতে। কিন্তু পুরুষ নিজেকে সৎভাবে উপস্থাপন করে আমার কাছে।
ভালবাসার বুলি আওড়ায়, আমার জন্য উজাড় করে দেয় সব। আবেগের তাড়নায় আমি কখনো পতিত হই তার কাছে। একসময় মধু নেওয়া শেষ হলে সে উড়াল দেয় অন্য কোন ফুলের সন্ধানে। অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয় আমার সুন্দর জীবন ।
আমি নারী, তাই আমি একা বাস করতে পারি না, টিকে থাকতে কারও হাত ধরি, কারো ছায়া অবলম্বন করি, সেটা কখনো ভালবাসার, কখনো বাহ্যিক অভিনয়।
আমি নারী বলেই দীর্ঘদিন সঙ্গীহীন দিন কাটাই,রাত কাটাই,আমি চাইলেই পারি না পুরুষকে নিয়ে আনন্দ করতে। একসঙ্গে তিনপুরুষকে রাখতে। আসলে প্রকৃতিই আমার বড় শত্রু। অবশেষে আমি নিজেই চেষ্টা করি নিজের শরীরকে তৃপ্তি দিতে।
বিছানায় পুরুষ আমার শরীরের প্রতিটি অঙ্গে যে তৃষ্ণায় চুম্বন করে, সে তৃষ্ণায় আমি তাকে চুম্বন করি না।
তবে তাকে উজাড় করে দিতে কার্পণ্য করি না। হোক সেটা আমার ব্যবসা,বন্ধন কিংবা বিনিময়। সুখের প্রশ্ন ওঠলে বলবো, পুরুষ নিজের সুখটাকেই বড় করে দেখে। বিছানায় পুরুষ কখনও আমাকে তীব্র আনন্দ দিতে পারে না। তবুও পুরুষ বাহাদুরি করে, চেষ্টার ত্রুটি করে না আমাকে হারাতে.. কখনও পারে আবার কখনও হারে।
অথচ পুরুষ চিরকালই নারীকে তার ওপর নির্ভর করাতে চেয়েছে যৌনতার জন্য। আধিপত্যের জন্য পুরুষের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র এই সেক্স । এটি কোনও মিলন নয় বরং বিনিময়। পুরুষ বলে, আমি তোমাকে ভাত কাপড় দিচ্ছি, তুমি আমাকে শরীর দেবে। তুমি আমার সম্পত্তি, তোমার শরীরটা আমি কিনে নিয়েছি ।
আমি ওপরে তুমি নিচে। তোমার এই শরীরে আর কোনও সাধ আহ্লাদ থাকতে পারে না। আমি সেই পুরুষ। এই পুরুষাঙ্গ ছাড়া তুমি অসুখী, তুমি অসহায়। এই পুরুষাঙ্গ তোমাকে পরিচয় দেয়, সংসার দেয়, সন্তান দেয়।
কোথায় যাবে তুমি নারী,এই পুরুষাঙ্গের কাছে তোমাক ফিরে আসতেই হয়।
এই লৈঙ্গিক ক্ষমতার জন্যই নারীর ওপর আধিপত্য করে যাচ্ছে পুরুষ। সবল নারীও হেরে যায় এখানে,পুরুষাঙ্গের কাছে। কেবল লৈঙ্গিক অস্ত্র দিয়েই পুরুষ নারীকে দমন করতে চায়। পুরুষের ধর্ষকামী মন নারীকে ধুমড়ে মুচড়ে তৃপ্তি পায় নানা ঢঙে, নানা পদ্ধতিতে।
আমি স্বপ্ন দেখি, যেদিন কারও সঙ্গে গভীর প্রেম হবে, বিয়ে হবে, তার সঙ্গে তীব্র যৌন-জীবন কাটানো যাবে। আমার সেই স্বপ্ন ও সম্ভাবনার ইতি ঘটায় সমাজের পুরুষ। যখন আমি কোন তারকা হই, খ্যাতি পাই। পুরুষভাবে কত রঙ্গিন আমার জীবন। কেউ বোঝে না আমার চারদিকে কত নিঃসঙ্গতা, আমি কত নি:স্ব।
সকলে জানে আমি তারকা। আমার ব্যস্ততার শেষ নেই,সীমা নেই। পুরুষ ভাবে আমার জীবন ডুবে থাকে পদ্ম ফোটা প্রেমের পুকুরে। অনুমান করে, আমার প্রেমের প্রার্থী অনেক, কেবল বাছাই হওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু কেউ যদি জানতো আমার উঠান বারান্দা সব ফাঁকা।
কেউ ওখানে বসে নেই প্রার্থী হয়ে। আমিই বরং কাঙালের মতো ভিক্ষের হাত পাতি। নিজের জন্য প্রায়ই খুব মায়া হয় আমার। কাউকে বললে নিছক গপ্প বলে উড়িয়ে দেয়। আমি কোথায়ও নিরাপদ নেই।
হাউজ টিউটর থেকে শুরু করে স্কুলের শিক্ষক, নিকটাত্বীয়, বন্ধু, অফিসের বস কিংবা সহকর্মী সবাই আমাকে কামনার চোখে দেখে । সুযোগ খোঁজে আমাকে কাছে পাবার।
আসলে আমার মত প্রতিটি মেয়েকেই হাঁটতে হয় এই অমসৃন পথে। নারী বলেই কোন বুড়োর কিংবা অসম পুরুষের সঙ্গে ঘর করতে বাধ্য হই। আমিতো নারি , তাই বুড়োর সঙ্গে জীবন কাটাই, চেষ্টা করি হাসিমুখে থাকতো, কিন্তু এসব কখনো অভিনয় মনে হয়।
বুড়োর কাছে নিজেকে সপে দেই সুখে থাকার জন্য, পরিবারের জন্য কিংবা ওপরে ওঠার জন্য। নারী বলেই খুব বেশি খ্যাতনামা হবার কোন সামর্থ্য যেমন আমার নেই তেমনি নেই ছোট্ট দুটো চোখের লেন্সে বড় বড় ফ্রেমের স্বপ্নগুলো দেখার বিলাসিতাও। তবু আমি স্বপ্ন দেখি। আমি জানি বহুশতক পরে হলেও আমার স্বপ্নগুলো সত্যি হবে,বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানে উজ্জীবিত হবে সেদিনের ঐ মানুষগুলো।
আসলে নারীর শরীর নিয়ে পুরুষ কত কিছু লিখেছেন, একেছেন, গড়েছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে।
আমি সমাজে পুরুষের দাসী, সেক্স সিম্বল। আমি যখন প্রেমিকা তখনও আমি প্রেমিকের দাসী, আমি যখন স্ত্রী, তখনও আমি স্বামীর দাসী। পুরুষ যেভাবে চায়, আমাকে সেভাবে নিজেকে গড়তে হয়। সাজসজ্জা, আচার ব্যাবহার, দোষগুণ সবকিছুর ধারণাই পুরুষের তৈরি । প্রেম ভালবাসা পুরুষের জন্য তরবারি, আমাকে দুর্বল করার জন্য।
আসলে প্রভু এবং দাসীতে কখনো প্রেম হয় না। আমি পণ্য ,তাই পণ্যের সঙ্গে পুরুষের প্রেম হতে পারে না।
আমার যৌন ইচ্ছের কথা প্রকাশ করলে আমাকে ছিঃ ছিঃ করে সমাজের সকলে। আমি নারী বলে আমার যৌন কামনা থাকতে নেই, থাকলে আমি নির্লজ্জ, নষ্টা, বেশ্যা। পুরুষ চায় আমি আমার শরীর সাজাবো তাদের জন্য, নিজের জন্য নয়।
শরীর আমার, কিন্তু এতে অধিকার বসাতে চায় পুরুষ। জীবনের স্বপ্ন ও লক্ষ্য পুরণের জন্য আমি এক হাত থেকে আরেক হাতে সমর্পিত হই। আমার মালিক বদলায়। পিতা থেকে প্রেমিক,প্রেমিক থেকে স্বামীতে,স্বামী থেকে পুত্রতে।
আমি রাতে রাস্তায় একা হাটলে পুরুষগুলো আমাকে কলগার্ল মনে করে, ভোগ করতে চায় ,আমার মনে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নগুলো ফুটতে দেয়না।
আমি অবাক হই, কৌতুহলী হই। কেউ আমাকে স্বপ্ন পুরণের লোভ দেখায়। কৌশল আঁটে হোটেল কিংবা বাসায় নিয়ে যাওয়ার। পরিণাম যেনেও কখনও আবেগের প্রবল ঝড়ে সাড়া দেই পুরুষের আহবানে। কিন্তু পুরুষ কি চায়? চায় শুধু আমার দেহ।
তবুও আমি এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বুনতে শুরু করি।
আমি কারো সাথে পতিত হলেই পুরুষ ভাবে আমি নষ্টা। কিন্তু সেই আমিই বিশেষ মুহুর্তে পুরুষের কাছে অনেক আদরের সম্পদ। আমি একা নই। আমার মত এভাবেই পুরুষের জালে ধরা দিচ্ছে অন্য নারীগুলো।
আমি রুপ বদলালে পুরুষ বলে ওঠে, মেয়েটি কলগার্ল,তাকে ভালবাসা যায় না।
আমার প্রেমে ব্যর্থ প্রেমিক ক্ষোভে আমাকে নিয়ে লিখে কবিতা, প্রশ্ন ছুড়ে এভাবে, 'তুমি লাবণ্য তরুণী অতি কামুকী পতিতা, অর্থের বিনিময়ে বিলিয়ে দাও কুমারী দেহ-যৌবন! রাতে ভাড়ায় যাও তুমি, জোয়ানরা চষে বেড়ায় রাতের শেষ পর্যন্ত; কি করে সহ্য কর এতসব ?
সব প্রাণীর মধ্যে পুরুষ প্রজাতি সুন্দর আর মানুষের ক্ষেত্রে নাকি নারী । তাই আমি নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে সেজেগুজে থাকি । আমি চাই পুরুষ আমার সৌন্দর্যের প্রসংশা করুক । কিন্তু পুরুষ যখন আমার সৌন্দর্যের দিকে না তাকিয়ে আমার স্পর্শকাতর অঙ্গের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
তখন আমি লজ্জাবতী পাতার মত নিজেকে গুটিয়ে নেই। আমি আহত হই। আমি অবাক হই, একজন বুড়ো সত্তর বছর বয়সেও ষোল বছরের তরুণী নিয়ে নিয়ে কত ফুর্তি করে বেড়ায়। অথচ আমার যৌবনে একটু ভাটা পড়লে শুধু যুবকরা নয় বৃদ্ধরাও মুখ ফিরিয়ে নেয় ।
তাই পুরুষের কাছে আমার আজ প্রশ্ন , পতনেই কি পতিতা।
যদি তাই হয়, তুমি পুরুষও তো কত নারীর বুকে পতিত হও , তোমাকে তো কেউ পতিত বলে না। তবে কি লৈঙ্গিক অস্ত্রই তোমার সব ক্ষমতার উৎস নাকি এই ঘুণেধরা সমাজ। আমি যখন কোন পুরুষের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলি নিতান্ত সৌজন্যতা কিংবা বাস্তবতার খাতিরে, অন্য পুরুষগুলো আমাকে কলগার্ল মনে করে। নষ্টা আখ্যা দেয়। আমার দুর্নাম রটায়।
তবুও আমাকে পুরুষকে বিশ্বাস করে চলতে হয় । এ বিশ্বাসে কখনও আমার জীবন , কখনও সম্মান, কখনও বেচে থাকার অবলম্বন হারাই। তবুও পুরুষকে নিয়েই আমার পথ চলা..।
সবশেষে এটাই বলবো, হে পুরুষ, আমি আসলে কলগার্ল নই, এই সমাজ, তুমি পুরুষ আর বেচে থাকার লুকায়িত স্বপ্নই আমাকে কলগার্ল হতে বাধ্য করে....
উৎসর্গ: সামিয়া আলম, তাসনীম হুমায়রা, নুপুর, কাশফি এবং মোমিনাকে । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।