শেষ বলে কিছু নেই
টেবিলের উপর জমে গেছে চিঠির পাহাড়; সব মায়ের লেখা। মা’ই বোধ হয় একমাত্র লোক যিনি বাংলাদেশ ডাকা-বিভাগকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন; মোবাইলে তিনি যে সব কথা মন খুলে বলতে পারেন না, সে সব কথা চিঠিতে লেখেন; চিঠির সারবত্তা মোটামুটি ঘুরেফিরে ঐ একই: বিয়ে কেন করছি না আমি, বিয়ে না করলে উত্তরাধিকার উৎপাদন করা সম্ভব না, আর উত্তরাধিকার উৎপাদন না করাটা ক্রিমিনাল অফেন্স; আমি একজন পার্পিট্রেটর; আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হলেও আমাকে যে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে- এ ব্যাপারে মা মোটামুটি নিশ্চিত। ক্রমাগত ঘা দিয়ে দিয়ে মা আমাকে মোটামুটি বিবেকের কাঠগড়ায় খানিকটা দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন; আমি অনুভব করতে শুরু করেছি আর এই অনুভবের রসায়নে অনুঘটক হিসেবে ক্রিয়া করছে আমার খোড়া ঠ্যাং: একটা রক্ত-মাংসের ক্র্যাচ পেলে মন্দ হয় না।
লীলামনি আজকাল আমার দিকে কেমন ভেজা ভেজা চোখে তাকায়; করুণাশ্রিত প্রেম, বুঝতে পারি। একদিন লজ্জাঘেন্নার মাথা খেয়ে বলে ফেলি, বড় ক্লান্ত লাগে আজকাল, লীলামনি আসুন না শেষবারের মত একবার ঠকতে চেষ্টা করি।
বলাতো যায় না, শেষমেষ দুজনেরই জিৎ হয়ে যেতে পারে।
লীলামনি হাসে না; গম্ভীর হয়ে বলে, চলেন তবে ঠকি...
আমার জীবনে বিপ্লব এসে যায়; নিমেষে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে খবর। মেস ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়ি অভিজাত ফ্ল্যাটে; ফিরোজা কালারে সয়লাব হয়ে নতুন ফ্ল্যাটের রুমগুলো। আমার মনের ক্যানভাসে অংকিত হতে থাকে মল্টিকালার প্রচ্ছদ, যেন ছাপা হতে যাচ্ছে নতুন কবিতার বই; যে বইয়ের প্রতিটা অক্ষরে খিল খিল করে হাসবে জীবন- এক আশ্চর্য অনাঘ্রাত কোমলতা। আত্মীয়-স্বজন সব এসে ভর করে ঢাকাতে; মা খলবলিয়ে পান খায় আর হাসে;আহ্লাদে আমার চল্লিশোর্ধ ত্বকে চমকায় বাদশাহী রোশনাই; দুপক্ষের পানচিনি এটাসেটা হয়ে যায়।
বিয়ের আগের দিন মাথার অবশিষ্ট চুলে কলপ লাগিয়ে যুবক সাজি। রাতে ঘুম হয় না; মাঝরাতে লীলামনিকে মোবাইল করি।
আমি বলি, ঘুম হচ্ছে না লীলামনি।
ও বলে, কেন?
আমি বলি, জানি না।
ও বলে, আমারও ঘুম হচ্ছেনা।
আমি বলি, কেন?
ও বলে, একটা কাঁটা। ব’লে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ইথারে দীর্ঘশ্বাসটা ভেসে এসে আমার বুকে বর্শার মত বিঁধে যায়। আমি প্রশ্ন না করে পারি না, কিসের কাঁটা লীলামনি?
ও আমার উদ্বেগ ধরে ফেলে বলে, একটা নতুন জীবনে ঢুকতে যাচ্ছি। খুব ভয় করছে। এই কথা! আমার বুকে বিঁধে থাকা বর্শাটা গ’লে আহ্লাদের জল হয়ে ঝরে পড়ে।
সকালে যান্ত্রিক কোকিল ডেকে ওঠে। দরজাটা আমিই খুলি; সামনে দেখি উসকোখুকশো চুল লাল-চোখ এক যুবক; চেনা চেনা লাগে, কোথায় যেন দেখেছি।
যুবক বলে, আমি লীলাপুর খালাত ভাই। ভাইয়া লীলাপু আর নেই!
নেই?
স্লিপিং পিল খেয়েছিল, কেউ কিছু টের পায় নাই। আমি বুঝতে পারি, স্লিপিং পিল নয়, যে কাঁটার কথা বলেছিল লীলামনি রাতে... সেই কাঁটা ( যা আমার কাছে দুর্বোধ্য, অগম্যও বটে) তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে চিরতরে।
আমি বেড রুমে ফিরে আসি; আমার ভেতরে এক আশ্চর্য স্তব্ধতা বিরাজ করে; ঘরের চারদিকে তাকায়, মৃত পতঙ্গ খুঁজতে থাকি। পরক্ষণেই স্তব্ধতার ভেতর প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের শব্দ শুনি; ভেতরে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে; পাগলের মত খুঁজতে থাকি মৃত পতঙ্গ।
বালিশের নিচে খুঁজি, নেই;
বেডশিট তুলে ফেলি, নেই;
পুরো বিছানা তুলে ফেলি, নেই;
খাটের নিচটা দেখি, নেই;
জুতোর ভেতরে খুঁজি, আছে। পেয়েছি, পেয়েছি! একটা মৃত ফড়িং, দুআঙ্গুলে জুতোর ভেতর থেকে পতঙ্গটাকে তুলে এনে মেঝেতে ফেলে অগ্ন্যুৎপাতের পুরোটা লাভা ওর উপর উগড়ে দিতে থাকি...
###
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।