জলপাইয়ের আঁটি
স্কুলের টিফিনের সময় আজ পকেটে মাত্র দশটা পয়সা আছে। কেউ হয়ত ভাবতে পারে আমি ভুল করে দশ টাকাকে দশ পয়সা বলছি। কিন্তু ভুল আমার হয়নি, পকেটে আসলেই দশ পয়সা আছে। অ্যালুমিনিয়ামের দশ পয়সা, গোল নয়, ধারটা ঢেউ খেলানো। একদিকে শাপলার ছবি আর অন্যদিকে কিসের ছবি তা মনে করতে পারছিনা।
স্কুলের বাইরে একটা বুড়ি বসে নানান রকম চাটনি আচার বেচে। দশ পয়সায় ভাল কিছু খেতে পাওয়ার চাইতে দোকানদারের কাছে হাসি-ঠাট্টার পাত্র হতে হবে, তাই দোকানের দিকে না গিয়ে স্কুলের মাঠেই এলোমেলো ঘুরছি ক্ষুধা পেটে নিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে কখন যে চাটনিওয়ালী বুড়ির কাছে চলে এসেছি খেয়ালই করিনি। বুড়ির ঝুড়ি ভর্তি নানান রকমের কাঁচের বয়মের ভিতর নানান রকম আচার, দেখলেই জিভে জল আসে। লজ্জায় কিনতে পারছিনা।
দশ পয়সার আচার চাই আর বুড়ি আমাকে সবার সামনে বলুক, যাঃ ভাগ, দশ পয়সায় আচার হবেনা, তাহলে আর অপমানের শেষ থাকবেনা। বিশেষ করে নাতাশার সামনে এধরণের অপমান হওয়া মোটেই চলবেনা।
নাতাশা হচ্ছে বলাকার বোন, তাদের বাপ মা দুজনেই আর্মি অফিসার। অফিসার শুনতেই কেমন মজা লাগে। মা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আর বাবা কর্নেল।
এসব মেজর কর্নেল লেফটেন্যান্ট কী জিনিস তা জানিনা তবে আমার মনে হত তাদের মা বোধহয় বাবার চেয়ে বড় অফিসার, কারণ মায়ের পদবী শ্রেফ কর্নেল নয় কর্নেলের আগে একটা লেফটেন্যান্ট লাগানো আছে। আর বাবা হচ্ছে শুধুই কর্নেল, আগে পিছে আর কিছুই নাই। আর্মিতে নাকি অফিসারেরা কেবল সিপাহী বা হাবিলদারদেরকেই ধমক ধামক বা হুকুম করেনা, বড় অফিসাররা ছোট অফিসারদেরকেও ধমক দেয়, হুকুম করে। নাতাশা বলাকার মা তাদের বাবাকে বেশ সাটানি ধমক আর হুকুম দিচ্ছে ভাবতেই বেশ আমোদ অনুভব করতাম, মাঝে মধ্যে ভাবতাম নাতাশাকে বলি, হ্যাঁরে নাতাশা, তোর মা তোর বাবাকে খুব ধমক দেয় বুঝি? কিন্তু সাহস করে বলতে পারিনি, যা রাশভারী টাইপের মেয়ে! কী সুন্দর স্মার্ট হয়ে সেজেগুজে স্কুলে আসে। খানিকটা মিলিটারী হাবভাব আছে।
তার সাথে কথা বলতে না পারলেও তার সামনে অ্যাট লিস্ট অপমান হতে চাইনা।
আচারওয়ালী বুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এইসব আবোলতাবোল যখন ভাবছি ঠিক তখনই দেখলাম ক্লাস টুয়ের একটা মেয়েকে বুড়ি তার জলপাইয়ের আচারের গামলাটা দেখিয়ে বলছে, টাকায় বারোটা করে দেব, নেবে খুকী? খেতে খুব মজা’।
টাকায় বারোটা হলে একটার দাম ঠিক কত হয় তার সঠিক হিসাব তৎক্ষণাৎ করতে পারলাম না তবে সেটা যে দশ পয়সার চেয়ে কম হয় তা বুঝতে অসুবিধা হল না, কাজেই বুড়ির হাতে আমার দশ পয়সাটা দিয়ে বললাম, আমাকে একটা জলপাইয়ের আচার দেবেন?
বুড়ি তার খনখনে গলায় বলল, একটা বেচে লাভ নেই গো খোকা, তবে তুমি যখন বলছ তাহলে একটা কিনতে হলে দশ পয়সাই লাগবে কিন্তু। দেব একটা?
এক টুকরো কাগজে জলপাইয়ের আচারটা রেখে তার উপরে একটু লবণ মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দিল আর এর মধ্যেই ক্লাসের ঘণ্টা বেজে গেল। ক্লাসে আচার খেলে মাষ্টার মারবে তাই লুকিয়ে চুরিয়ে আচার খেতে খেতে ক্লাসে ঢুকলাম।
মাষ্টার এখনও আসেনি, তাই ভাবছি জলদি খেয়ে আচারটা শেষ করি, এমন সময় পপি পিছন থেকে ডেকে বলছে, এ টুটুল, কী খাস? জলপাইয়ের আচার? তোর খাওয়া হলে আমাকে জলপাইয়ের আঁটিটা দিবি?
আমি অবাক হয়ে বলি, জলপাইয়ের আঁটি দিয়ে তুই কী করবি?
চুষবো।
আচ্ছা দিব।
আমি বারান্দার দিকে তাকাচ্ছি আর দেখছি মাষ্টার আসছে কি না এর মধ্যেই চায়না বলছে, এই টুটুল, তোর খাওয়া হলে জলপাইয়ের বিচিটা আমাকে দিস তো, একটু চুষে দেখব, কেমন লাগে।
আচ্ছা দিব।
এরপর মুক্তা।
তারপর নার্গিস। তারপর আর কে কে ছিল সবার নাম নমে নেই, তবে সবারই একই আব্দার। আমি হচ্ছি সোজা সরল ছেলে, কারো কথায় না বলতে পারি না, সবাইকেই হ্যাঁ বলে দিলাম।
মাষ্টার মশায় এখনো ক্লাসে আসেননি। আমার আধখাওয়া জলপাইয়ের বিচি সারা ক্লাসময় এ হাত থেকে সে হাত বদল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর সকলের রসনা তৃপ্ত করছে।
আহারে আমার জলপাই, তোর জীবন আজ সার্থক, তোর জীবন আজ ধন্য! জলপাইয়ের গর্বিত মালিক হিসেবে আমি আজ নিজেকে ধন্য মনে করছি আর ভাবছি আজকের এই জলপাইয়ের আসরে আমিই যেহেতু হোস্ট সেহেতু আমার কিছু দায় দায়িত্ব আছে যা আমি এড়াতে পারিনা। তাই খানিকটা দায়িত্ববান হোস্টের মত সবার তদারকি করে বেড়াচ্ছি, যারা আমার জলপাই বুকিং দিয়েছিল তারা ঠিকমত সেটার বিচি চুষতে পারলো কি না তার খোঁজ খবর নিচ্ছি। এর মধ্যেই ক্লাসের পিছনের বেঞ্চের দুই মেয়েতে ঝগড়া শুরু হয়ে গেছে, একজন আরেকজনকে বলছে, এই হাসিনা, তুই তো একটু আগেই একবার জলপাইটার বিচি চুষলি, এখন আমার পালা, তাহলে তুই কেন আবার নিচ্ছিস? দে ওটা আমাকে দে।
আমি ওদের ঝগড়া থামাতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই মাষ্টারমশায় ক্লাসে এসে ঢুকলেন আর সাথে সাথে এই বিশাল ভুরিভোজনের আসর বন্ধ হয়ে গেল। সবাই শান্ত সুবোধ হয়ে বই খুলে পাঠে মন দিল।
আমার জলপাইয়ের বিচিটা যে কে মেরে দিল তা বুঝতে পারলাম না।
মারলে মারুক, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তুচ্ছ জলপাইয়ের বিচি নিয়ে আমার কোন ক্ষোভ নাই, তবে মনের মধ্যে অন্য একটা ক্ষোভ আর কষ্ট, সেটা আমি ছাড়া ক্লাসের আর কেউ জানেনা।
নাতাশা আমার জলপাইয়ের বিচি বুকিং দেয়নি। তার ভারী অহঙ্কার।
আর্মি অফিসারের মেয়ে। তারা থাকবে সবার থেকে আলাদা। তারা ব্লাডি সিভিলিয়ানদের সাথে মিশবেই বা কেন আর তাদের এঁটো জলপাই চুষবেই বা কেন?
জহুরুল
২১ আগস্ট ২০১৩
৬ ভাদ্র ১৪২০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।