নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই
১
দেশের এক নম্বর কণ্ঠশিল্পী জেড শাহরিয়ারের একক সঙ্গীতানুষ্ঠান। এত বড় শিল্পীর অনুষ্ঠানে আরও বেশী লোক হওয়ার কথা। ভক্তদের অনেকেরই দুই বা পাঁচ হাজার টাকায় টিকেট কেনার সাধ্য ছিল না । ব্ল্যাকে দাম আরও বেড়ে গিয়েছিল। ফিরে যাওয়া দর্শকরা বিল্ডিং এর বাইরের কলাপসিবল গেটে দাঁড়িয়ে আশা করে আছে যদি কোনভাবে একটা উপায় হয়।
বিরতি শেষে গ্রিনরুম থেকে মঞ্চে এসে গাওয়া শুরু করে ঝন্টু শাহরিয়ার।
...
অন্ধকারে জেগে আছে
অরণ্য পাগল
বুকের মধ্যে কর্ণফুলি
বইছে টলমল
...
পাহাড়ী রাগে ঝুমুর তালে সেমিক্লাসিক্যাল ফিউশনটা লোকে দারুন ভাবে গ্রহণ করে। প্রদীপ শর্মার তবলা আর রকী চৌধুরীর আইরিশ ফ্লুট সঙ্গে থাকলে কথা নেই। গানটা শেষ হলে শ্রোতারা করতালিতে ফেটে পড়ে । এরা অধিকাংশই দামী শ্রোতা।
ঢাকার সমস্তগাড়ি এখন বিল্ডিংটার সামনে। লেক্সাস, মার্সিডিস কোনটি আরও দামী ব্র্যান্ড । দেশের এক নম্বর গাইয়ের লাইভ শোর সৌভাগ্য সবার হয় না। পয়সাওয়ালাদের কাছে কাছে টিকেটটা অত দামী না।
২
আমিই সেই ঝন্টু, যে এতক্ষণ ধরে কথা বলছি।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে একদিন আমি মানুষের পিছনে ঘুরেতাম গান শোনানোর জন্য। পয়সা পেতাম না।
ঢাকায় আগে টিনশেডে থাকতাম, পুরনো ঢাকায় ছিলাম অনেকদিন। নাম হওয়ার পর গুলশানে উঠেছি। নিজের বাড়ি।
অনেক শিল্পীর চেয়ে সুখে থাকার কথা। আছিও। আগে গ্রামের ঝিল দেখে চেয়ে থাকতাম। আর এখন একাকী বসে বসে গুলশান লেকে স্ট্রিটলাইটের প্রতিফলন দেখি।
গানটা শেষে করতালিতে কান স্তব্ধ হয়ে যেতে থাকে।
কিন্তু আমি এও টের পাই এই করতালিতে মুগ্ধতার চেয়ে হুজুগ বেশি। বড় শিল্পী যা গাইবে তাতে হাত তালি না দিলে সমঝদার হওয়া যায় না। আবছা আলোয় দেখতে পাই সামনের সারির স্যুট পর লোকটি ঝিমানো ভেঙে উঠে হাত নাড়তে থাকে। কড়া মেকআপে বয়স্ক মহিলারাটি তালে তালে তালি দেয়। অনেকে ফ্যাল ফ্যাল করে গান শোনে।
একটা তরুণ সামনে এসে উচ্ছাস প্রকাশ করে (কী করে এত তরুন পাঁচ হাজার টাকা করে টিকেট কেনে জানে! হয়তো ব্যবসা অথবা বাবার পয়সা!) ।
দামী পারফিউমের গন্ধে ছেয়ে আছে চার পাশ। তাদের জন্য উন্নত আয়োজন। মঞ্চ ঝক ঝক করছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে একপাশে তানপুরা, অন্যদিকে গ্রামের ছবি।
শহুরে লোকেরা গ্রাম চায়। পল্লী সংগীত চায় । যদিও এরা একে ফোক বলে। অতএব পরিবেশকের অনুরোধ আমাকে গ্রামের গান গাইতে হবে।
--
জন্ম যে গাঁয়ে
কুলু কুলু নদীর মতন
মা গো সেখানে আমার দেহ
রেখে দিও মাটির নিচে করিয়া যতন
এদেশে জন্মে মাগো
ধন্য হয়েছে বুকের পাথর
মরণের পরও যেন
বুকে লেগে থাকে মাটির স্বাক্ষর
..
শেষের কথাগুলো এই শ্রোতারা হয়তো অর্ধেকটা বুঝেছে।
না বুঝলেও ওয়ান মোর বলে চিৎকার করছে। ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তুলে নিচ্ছে। পরদিন কেউ বাচ্চাদের স্কুলের সামনে, কেউ কর্মস্থলে অন্যদের ঈর্ষাহ্নিত করে বলবে - আহ কী যে শুনলাম। এমন গান ঝন্টু শাহরিয়ারই শুধু গায়!
৩
আমাদের পরিবারে গান বাজনা নিষেধ থাকলেও রক্তে গান ছিল। বড় ভাই জোর করে গান শেখে।
তাকে অনুসরণ করে গানের দলে ঘুরে গান শিখেছি। যদিও কখনো আমার মাকে গান গাইতে শুনিনি । কিন্তু মায়ের গলাও ভাল ছিল।
প্রকৃতির নিয়মে একসময় ভাইবোনরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকি। বড় ভাই রেঙ্গুন চলে যায়।
আরেক ভাই দিনাজপুরে। আর আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল গাইতো ছোট বোনটা। বাবা মারা যাবার পর সঙ্গে করে শহরে নিয়ে এসেছিলাম তাকে।
আমি তখন ছিলাম বেকার। একটা স্টুডিওতে গিটার বাজিয়ে কিছু পয়সা পেতাম, সেটা দিয়ে দিন চলতো।
একটা পুরনো হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলাম যতিন থেকে। বোনটা তাতে ভীষণ খুশী ছিল।
বোনটা সকালে উঠে সুর সাধতো। ঘিঞ্জি তাঁতীবাজারের বাড়িগুলো গায়ে গায়ে লাগানো । বাড়ির জানলা গলিয়ে ঘীপট্টি মোড় পর্যন্ত তার রেওয়াজের মিহি গলা পৌছে যেত।
এখনো দৃশ্যটা চোখে ভাসে। বার তের বছর বয়সের বোনটা খুব মনোযোগ দিয়ে "গুরু বিনা ক্যায়সে" গাইছে। গলায় ওড়না, পা ভাঁজ করে বসে। মেঝেতে কমদামী একটা চাদর বিছানো। আর আমি তখন তার সঙ্গে বাজাচ্ছি ।
গ্রামে গানের দলের আকবর চাচা আমার গানের সারগামটা ধরিয়েছিলেন। তিনি বলতেন - ফুল যেমন ভোমরাকে টেনে আনে, ভাল গানও তেমনি শ্রোতাকে আকর্ষণ করে। জানলায় তাকিয়ে দেখতাম রাস্তার লোকেরা স্থির হয়ে আমাদের শুনছে।
বোনটিকে মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলাম। পড়াশোনায় তার খুব আগ্রহ ছিল।
স্কুলের শিক্ষকরা তার গানের প্রতিভার কথা জেনে আমাকে বলেছিল গানের টিচার রাখতে। যখন সে নবম শ্রেণীর ছাত্রী স্কুল থেকে তাকে জাতীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় পাঠানো হলো ।
তারপর এক আনন্দের ক্ষণ। কড়া নাড়া শুনে দরজা খুলতেই দেখি গলায় সোনার মেডেল তার। কিছু শোনার আগেই আমাকে ধরে তার সেকি খুশির কান্না।
আমি তার সঙ্গে কখনোই মুরব্বীগিরী করতাম না। আর সেদিন সে পা ছুঁয়ে আমাকে সালাম করতে চাইলো। বোকা মেয়ে! আমি বুকে টেনে নিয়ে বলেছিলাম, আজ মা বেঁচে থাকলে কী যে খুশি হতো! তুই থেমে যাসনে। পয়সা হলে তোকে কলকাতার খগেনের স্কেলপালটানো হার্মোনিয়াম কিনে দেবো।
৪
মাত্র একবছরের মধ্যে আমার ছোটবোন পরিচিত হয়েছিল শহরে।
পত্রিকায় তার নাম ছেপেছিল। তাকে জোর করে নিয়ে যেত নানান অনুষ্ঠানে। আমি মানা করতাম না। কিন্তু সে তখনো বয়স অল্প । মাঝে মাঝে ফিরে এসে বলতো, ভাইজান, এরা এত গান গাইতে বলে যে আমার যে গলায় ব্যথা হয়।
তাল মিস্রি আর যষ্টিমধু সেবন করে তার ব্যথাটা সেরেছিল।
বোনটা শ্রোতাদের ভালবেসে ফেলেছিল খুব বেশী। আর একমুখী ভালবাসা হলে যা হয়। টের পেলে নির্দয়পক্ষ চাইলে আঁখ মাড়াইয়ের কলের মতো চিপে ছোবড়া বানিয়ে ফেলতে পারে। তার তেমনি হয়েছিল, একের পর এক অনুরোধ আসতো।
চেহারায় ক্লান্তি ফুটে উঠলে, এমন কি অসুস্থ হয়ে ঢলে পড়লেও তারা অনুরোধ থামাতো না। যেন শিল্পীরা মানুষ নয়, যন্ত্র।
এখন আমিও সেই যন্ত্রের মত গান করি। তবে পার্থক্য হলো ভালবাসাটা গৃহবধুর মতো একমুখী নয়। খারাপ করে বললে বাজারে মেয়ের মতো যা দিই কড়ায় গন্ডায় তার হিসাব বুঝে নেই।
জেনে নিয়েছি কোন সুর আর তাল দিলে সবাই কেঁদে দেবে। নিজে না কাঁদলেও অন্যের চোখে পানি আসবে। আর চোখের পানি বিক্রি করে নগদ নিয়ে বাড়ি ফিরি।
মাঝে মাঝে দেয়ালে ঝোলানো পুরনো গিটারটা বাজাই। বোনের সঙ্গে যুগলবন্দি গাওয়ার স্মৃতিটা মনে পড়ে।
শেষদিকে তার গাইতে কত কষ্ট হতো! আমি বোনটাকে মানা করতাম সেসব অনুষ্ঠানে যেতে। সে শুনতো না।
খ্যাতি ও সম্মানে উপরের দিকে ওঠার সময় দাঁত ওঠার মতো ব্যথা থাকেই। ভাবতাম প্রকৃতি প্রদত্ত গলা দিয়ে দেশ বরেণ্য শিল্পী হতে যাচ্ছে আমার বোন - আমার বাধা দেয়া উচিৎ নয়।
কিন্তু বিধাতার ইচ্ছে ছিল ভিন্ন ।
একদিন স্টুডিওতে বসেছিলাম। মনটা খুব ফুরফুরে ছিল। এমন সময় খবর পেলাম, সদারঙ্গ একাডেমীর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে স্টেজেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে বোনটা। ডাক্তার বলেছিল ভোকাল কর্ডের অতিরিক্ত চাপে সে স্নায়ুর অসুখে ভুগছিল। আর সেটাই তার মস্তিস্কের রক্তক্ষরণের কারণ।
যে দিন থেকে আদরের বোনটাকে শ্রোতারা কেড়ে নিয়ে মৌন সমাধী ফিরিয়ে দিল, সে দিন থেকে আমার জমে থাকা পাথরটা আর মানুষ হয়নি।
সঙ্গীতটাকে এখন শত্রু মনে হয়। শ্রোতাদের মনে হয় খরগধারী জল্লাদ। প্রতিশোধ নিতে আমার কার্পন্য হয় না, আসলে আমি গাই না - কন্ঠস্বরের চাকায় দানব ট্রাকের মতো প্রতিদিন পিষে মারি সপ্তসুরের প্রতিটিকে।
৫
আজকের অনুষ্ঠানে ভাল টিকেট মানি এসেছে।
আয়োজকেরা ভাল করেই জানে পয়সা কম হলে আমি আর কখনোই তাদের সঙ্গে গাইবো না। তারা ঠিক ঠাক হিসাবটা বুঝিয়ে দেয়। আমি গাড়ি চেপে আমার এপার্টমেন্টে ফিরে আসি। শুয়ে থাকি। ক্লান্ত মাথা।
সকালে রেকর্ডিং আছে। কয়েকটা ক্লান্তি নিবারক অষুধ পানি দিয়ে গিলে ফেলি ঘুম এসে যাবে এই আশায়।
ঠিক এমন সময় একটা বাঁশির সুর ভেসে আসে। আনাড়ি বাঁশিতে মেঠো সুরে কেউ বাজাতে চাইছে
কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া
আমার ভাইয়েরে কইও নায়র নিতো আইয়া
বাঁশিটা শোনার পর আমি বিছানাতে উঠে বসে পড়ি। বিছানাটা যেন জঙ্গলের বুনো ঝোপ আর বাঁশিটা সাঁপের মতো দংশন করছে আমাকে।
আদরের ছোট বোনটার একসময় গানটা গাইতো। খুব দরদ দিয়ে। সেই বয়সে তার ভাটিগাঙের পারে স্বামীর ঘরে নির্বাসিত বধুর আবেগ বোঝার কথা না। কিন্তু আজকে বেঁচে থাকলে বোনটার বিয়ে হয়ে যেত। তার সংসার হতো।
নায়র নেবার জন্য ভাইয়ের কথা মনে করে সে ব্যাকুল হতো।
আমি মঞ্চের নক্ষত্র - শত শত মানুষকে সঙ্গীত দিয়ে ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলাটা আমার পেশা। অথচ কোথাকার এক অদেখা বংশীবাদক আমাকে আক্রান্ত করছে।
নেহায়তই ভুল ভাল সুর। আমাদের গানের মতো উচ্চাঙ্গ মুর্ছনা নেই, গিটারের সঙ্গত নেই, নেই তালের বাহাদুরী ।
যারা চোখ বন্ধ করে রবীন্দ্রনাথ পুজা করে, বিটোফেনের সিম্ফনি বাজায়, ইয়ানীর বাদ্য শোনে তারা দুর দুর করে তাকে তাড়িয়ে দেবে।
কিন্তু সেই অশুদ্ধ সুর এত শক্তি কোথায় পায়? আমি জানালায় এসে দাঁড়িয়ে তাকে খুঁজতে থাকি।
লোকটা হয়তো ভ্যানচালক বা কুলি মেথর, অবসন্ন হয়ে মাঝ রাতে বিশ্রাম নিচ্ছে। ময়লা ফুটপাথে শুয়ে আছে। একটু পর পুলিশ আসবে তুলে দিতে ।
কিন্তু সেও আমার মতো কেউ - তারও বুকে আমার মতো কষ্ট আছে। সে তার দেশের গাঁ, ফেলে আসা আত্মীয়দের জন্য আকুল হয়ে দশ টাকা দামে কেনা মেলার বাঁশিটা বাজাচ্ছে। ফুঁ দেয়ার সঙ্গে তার দু:খঅভিমানগুলো গলে গলে উড়ে আসছে।
কে জানে ভাটিগাঙের ওপারে তার বোন থাকে কিনা, থাকলে সে সে শহরের জীবন যুদ্ধ থেকে ছুটি নিয়ে সেখানে যেতে পারে কিনা! সুরটা তখনো তার তীব্রতা দিয়ে আমাকে ডাকছিল।
আমি ছাদে উঠে আসি।
হঠাৎ দুরে দেখতে পাই এক চিত্র। সোডিয়াম লাইটের নিচে শিল্পী ঝন্টু শাহরিয়ার উদাম গায়ে ময়লা ফুটপাথে শুয়ে আছে। সে শুয়ে পাশের লোকটাকে বলছে, ওগো বাঁশুরিয়া, আমাকে একবার শিখিয়ে দাও কি করে এমন গান গাইতে হয়।
--------------
(ড্রাফট ১.১ / বানান ও বিন্যাসের ত্রুটি মার্জনীয়/
অনুসরণে:
1. বাঁশুরিয়া বাজাও বাশি (সুমন কবীর),
2. কখনো আমার মাকে (শামসুর রাহমান),
3. কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া (শচীন দেব বর্ম্মন) এবং
4.সে আমার ছোট বোন (মান্না দে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।