অমায়িক একটা ছেলে। প্রশ্নটি হয়তো স্রেফ বোকামি বলেই আখ্যা দেবেন বর্তমান প্রজন্ম। কিন্তু রূঢ় তথ্য হচ্ছে, সিলেটিরা মূলত বাংলাভাষী নন। সিলেটি জনগোষ্ঠি
নিজস্ব ভাষার অধিকারী। সিলেটি ভাষা বাংলা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং প্রাচীন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা।
এ তথ্যটি অনেক সিলেটিরই অজানা। তাই সিলেটি ভাষা উপেক্ষিত। সিলেটি নিজস্ব লিপি নাগরী আজ প্রায় বিলুপ্ত।
পৃথিবীতে প্রায় ৮ হাজার ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার সংখ্যা ৩ হাজার।
এই ৩ হাজার ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে এবং যা মানুষের মুখে উচ্চারিত রয়েছে। বিশ্বের স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার একটি এই সিলেটি ভাষা। গবেষককেদের মতে, বাংলাদেশের মাতৃভাষা বাংলা হলেও সিলেটিদের মাতৃভাষা সিলেটি বা প্রচিীন নাগরী। ফ্রান্সের বিখ্যাত ভাষা যাদুঘরে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার উদৃতি রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের ভাষার বিবরণে উল্লেখ রয়েছে- বাংলাদেশে দ‘ুটি ভাষা প্রচলিত।
এর একটি বাংলা এবং অন্যটি সিলেটি। সিলেটি ভাষা নিয়ে দেশ- বিদেশে চলছে গবেষণা। কিন্তু প্রাচীন এই ভাষাটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি এখনো। পুরো বাংলায় অনেকটা উপেক্ষিত রয়েছে সিলেটি ভাষা। সিলেটি ভাষার উপর এ পর্যন্ত বেশ ক’জন পিইএচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন।
এর মধ্যে বৃটিশ নাগরিকও আছেন। বর্তমানে আরো অনেকে বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিচ্ছেন। বৃটেনে সিলেটি ভাষা শিক্ষার কয়েকটি ইন্সটিটিউট থাকলেও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানিকভাবে সিলেটি ভাষা শিক্ষার কোনো ক্ষেত্র নেই। যার ফলে সিলেটি ভাষা মানুষের মুখে থাকলেও এর বর্ণমালা (নাগরী লিপি) অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হারিয়ে যাচ্ছে এর ইতিহাসও।
সিলেটি ভাষার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এ ভাষার প্রচলন শুধু সিলেটেই সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়ের বহু সংখ্যক লোকের মাতৃভাষা সিলটী। এটি একটি প্রাচীন ভাষা তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভাষা গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল ও অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলীর মতে জটিল সংস্কৃত প্রধান বাংলা বর্ণমালার বিকল্প লিপি হিসেবে ‘সিলটী নাগরী’ লিপির উদ্ভাবন হয়েছিল খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে। গবেষকদের ধারণা, ইসলাম প্রচারক সুফী দরবেশ এবং স্থানীয় অধিবাসীদের মনের ভাব বিনিময়ের সুবিধার জন্যে নাগরী লিপির উদ্ভাবন হয়েছিল। এই নাগরী বা সিলেটী ভাষা শুধু ভারত বা বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, ক্রমে বিশে¡র বিভিন্ন দেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চল এবং ভারত ছাড়াও বিশে¡র অন্যান্য দেশে এ ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাত লরে ও বেশী। শুধু গ্রেট বৃটেনেই সিলেটী ভাষা ব্যবহার কারীর সংখ্যা পাঁচ ল। বৃহত্তর সিলেটের বর্তমান জনসংখ্যা এক কোটি। লন্ডনের সিলেটী রিসার্চ এন্ড ট্রেন্সলেশন সেন্টারের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চল সহ সমগ্র বিশে¡ বর্তমানে এক কোটি ষাট ল মানুষের মাতৃভাষা হচ্ছে সিলেটী। অন্যান্য আধুনিক ভাষার মত সিলেটী ভাষারও একটি নিজস্ব বর্ণলিপি রয়েছে।
ইংরেজী ভাষায় যেমন ২৬টি অর বা বর্ণ রয়েছে, বাংলায় ৫০টি অর, ঠিক অনুরূপভাবে সিলেটী ভাষায় ৩২টি অর বা বর্ণ রয়েছে। ইংরেজী ভাষায় ভাওয়েল বা স্বরবর্ণ হলো ৫টি । বাংলায় স্বরবর্ণ ১১টি (অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ এ ঐ ও ঔ) সিলটী ভাষায় স্বরবর্ণ ৫টি (অ ই ঈ উ ঊ)। , রূপকথা । কিন্তু সিলেটের বর্তমান প্রজন্ম তাদের নিজস্ব ভাষা লিখতে পড়তে জানেন না।
মুখে থাকলেও লেখার প্রচলন উঠে গেছে বললেই চলে। বর্তমানে মূল সিলেটী হরফে যারা লিখতে ও পড়তে পারেন তাদের সংখ্যা খুবই কম। বিষয়টি নিয়ে সিলেটি ভাষা চর্চায় নিয়োজিত জগলু চৌধরী বলেন, সিলেটি ভাষা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। তা সংরক্ষণ করা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। সিলেটি ভাষা টিকিয়ে রাখতে প্রবীণদের পাশাপাশি গবেষনায় নতুন প্রজন্মের এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
তবে বর্তমান সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যাক্তি পর্যায়ে সিলেটি ভাষা স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখতে গবেষণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। সিলেটী রিসার্স এন্ড ট্রেন্সলেশন সেন্টার ইউকে রীতিমতো সিলেটি ভাষা হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে আসছে। বৃটিশ নাগরিক, সিলেটি ভাষায় পিএইচডি নেয়া জেমস লয়েড উইলিয়াম, তার স্ত্রী ড. সু লয়েড উইলিয়াম, সিলেটি ভাষা গবেষক মতিয়ার চৌধুরী, রেনু লুৎফা, আমিনুর রহমান এই সেন্টারের মাধ্যমে সিলেটি ভাষা তুলে দিচ্ছেন মানুষের মুখে মুখে। তাদের তথ্য মতে এই সেন্টারের মাধ্যমে কম্পিউটারে সিলেটী নাগরী ফ্রন্ট আবিস্কার করা হয়েছে। প্রকাশ হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ।
এছাড়া, বৃটেনে সিলেট একাডেমী ইউকে এন্ড ইউরোপ, কলকাতায় শ্রীহট্র সম্মিলিনী, বার্র্মিংহ্যামে সিলেটী ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র বিচ্ছিন্নভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সিলেটি ভাষার উপর ইতিমধ্যে যারা পিএইচডি নিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আব্দুল মোছাব্বির ভূঁইয়া । তিনি ভারতের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিয়েছেন মোহাম্মদ সাদিক, তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিয়েছেন এস এম গোলাম কাদের ।
বৃটিশ নাগরিক জেমস লয়েড উইলিয়াম লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। সিলেটী ভাষা নিয়ে তাঁর গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশের পথে রয়েছে। এছাড়া সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছেন সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী ও রূপা চক্রবর্তি। গবেষকদের মতে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সিলেটি ভাষাকে স্বীকৃতি না দিলে এবং এর প্রচলন না ঘটালে একসময় প্রাচীন এ ভাষাটি হারিয়ে যাবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার তালিকা থেকেও সিটকে পড়বে ভাষাটি।
......Collected ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।