সম্পাদনা করি আমিরাত-বাংলা মাসিক মুকুল। ভালবাসি মা, মাটি ও মানুষকে..
পূণ্যভূমি সিলেটের ঐতিহ্যবাহি উপজেলা আমাদের বিয়ানীবাজার। শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ক্রীড়াক্ষেত্রে এ জনপদ এক গরীয়ান ঐতিহ্যের অধিকারী। এখানে বিত্তের সাথে আছে চিত্তের সমন্বয়। উৎসবপ্রিয় বিয়ানীবাজারবাসীর আছে রুচিশীল আয়োজন।
আর বাঙালির চিরায়ত রূপ ফুটে ওঠে এসব আয়োজনে। যার ধারাবাহিকতায় এ জনপদে শতাধিক বছর ধরে ‘বাসুদেব রথযাত্রা’ মেলা বসে। নিয়মিত এ মেলাটি হিন্দুদের তীর্থস্থান বাসুদেব মন্দির সম্মুখে হলেও সব ধর্মের মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়। এখানে ধর্মের চেয়ে আনন্দই মুখ্য। বিয়ানীবাজারবাসী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বড়লেখা, কুলাউড়া, জুড়ী, গোলাপগঞ্জ, জকিগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলার উৎসবপ্রেমী মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয় মেলাটি।
প্রাণে-প্রাণে প্রাণবন্ত হয় বিয়ানীবাজার শহরতলির সুপাতলাস্থ বাসুদেব বাড়িটি। নিচে মেলাটির সাতকাহন পত্রস্থ করা হলো।
বাসুদেব রথযাত্রা
বিয়ানীবাজারের বাসুদেব মন্দিরের সামনে শান বাঁধানো ঘাট আর উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছকে ঘিরে নিয়মিত অনুষ্ঠিত ‘বাসুদেব রথযাত্রা’। অন্যান্য স্থানের ন্যায় এখানেও প্রথমে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর প্রাণচাঞ্চল্যতার মধ্য দিয়ে রথটানা হয়। এর ঠিক ৮দিন পর ফিরা রথ বা উল্টোরথ টেনে রথের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও জমে থাকে প্রাণের উল্লাস।
হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানরাও এ রথটানায় আগ্রহ নিয়ে অংশ নেয়। সব বয়সের মানুষের উপচে’ পড়া ভীড় এ মেলার প্রাণকে সমৃদ্ধ করেছে আপন আলোয়। শিকড়ের টানে মাতাল এ জনপদের বাসিন্দারা বিত্তের সাথে চিত্তের খোঁজ রাখে। তেমনি একটি চিত্তের বহি:প্রকাশ এ মেলা।
মেলার প্রাচীন ইতিহাস
একসময় বিয়ানীবাজারের সর্বত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আনাগোনা ছিল।
আজো কিছুসংখ্যক হিন্দু থাকলেও আগেকার মতো তাদের উপস্থিতি চোখে পড়েনা। বিয়ানীবাজারের বাসুদেব বিগ্রহ সুপ্রসিদ্ধ এবং বিশেষ ঐতিহ্য সম্পন্ন হিন্দু রাজত্বের সময় পঞ্চখণ্ড তথা বিয়ানীবাজার সদরের সুপাতলা গ্রামে জয়ন্তীয়া রাজ্যে ‘দূর্গদল’ই নামক জনৈক কর্মচারী বাস করতেন। তার পুকুর খনন করতে গিয়ে ‘বাসুদেব মূর্তি’ পাওয়া যায়। কষ্টিপাথরে নির্মিত চতুর্ভূজে শঙ্খ চক্রগদা পদ্মধারী বাসুদেব মূর্তিটি তৎকালিন বিজয়কৃষ্ণ পাঠকের উপর বাসুদেবের পূজার দায়িত্ব বর্তায়। কিংবদন্তি আছে, জনৈক ভক্ত বাসুদেব’র মন্দিরে দু’টি আম দেন।
পূজার আগেই বিজয় কৃষ্ণের দু’ছেলে তা খেয়ে পেললে পেটের পীড়ায় ছেলেদুটি ঘটনাস্থলে মারা যায়। ছেলে হারানোর বেদনায় বিজয়কৃষ্ণ দেবতার উপর অভিমান করে পূজা বন্ধ করে দেন। অনেক দিন পর তিনি স্বপ্নে দেখেন-‘তোমার অচিরেই আরো সন্তান হবে এবং তুমিই শুধু আমাদের পূজা করবে। ’ বংশের সিঁড়ি বেয়ে বিজয়কৃষ্ণের বংশধররা আজো মন্দিরের সেবায় নিজেদের নিবেদিত করেছেন। তখন থেকে বাংলা বছরের আষাঢ় মাসে রথযাত্রা শুরু হয়ে প্রায় মাসদিন যাবৎ চলে মেলাটি।
বাসুদেব মন্দিরের আদিকথা: মুঘল স্থাপত্য কলায় নির্মিত বাসুদেব মন্দিরটি সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার পৌরশহরতলীর সুপাতলায় অবস্থিত। প্রায় ১৫ শ’ বছর আগের নির্মিত মন্দিরটিতে শ্যাওলা পড়ার আস্তরণ তার জৌলুস হারিয়ে দিচ্ছে। কামরূপ রাজ্যের মহারাজাধিরাজ ভূতিবর্মা খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে এ মন্দিরের জন্য জমি দান করেন। ৭ম শতাব্দীর দিকে এ অঞ্চলে কালিদাস পাল আসেন। পরে তিনি ‘রাজা’ রূপে এখানে আর্য সভ্যতার বিস্তার করেন।
তৎকালিন সময়ে কাশী এবং গঙ্গা থেকে আরো ২২ জন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এসে এখানে বসত করেন। বাসুদেব মন্দির ততোদিনে প্রতিবেশি হিন্দুদের উপাসনালয়।
মন্দিরের ভেতরের স্থাপত্য:
দৃষ্টিনন্দিত মন্দিরটির ভেতরে রয়েছে শ্রী মন্দির, দোল মন্দির, ঝুলন মন্দির, পুষ্প মন্দির, রথযাত্রা মন্দির, শিব মন্দির, শ্রীভাষ পাঠাগার, দু’টি মণ্ডপ এবং দু’টি ফটক। রথযাত্রার দিন পূজারীরা নানা আবেগে আপ্লুত হয়ে সঙ্গীত (ধর্মীয়) পরিবেশন করে মণ্ডপে এবং বাহিরে দর্শনার্থীদের কলা ও চিড়া দেওয়া হয়।
বর্ষায় যখন থই-থই পানি জানান দেয় আষাঢ় এর আগমন তখন নিদনপুর, সুপাতলা ছাড়াও বিয়ানীবাজারের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আনন্দের উচ্ছ্বাস।
এলাকার স্কুল পড়–য়া শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে উপভোগ করতে চায় নানারূপী দৃষ্টি আকর্ষিত আয়োজন। কেউ কিনতে চায় বাঁশের বাঁশি আবার কেউবা কিনতে চায় শখের পুতুল। রমনীরা রেশমী চুড়ি পরতে স্বপ্নের জাল বুনেন। হাজার মানুষের স্বত:স্ফুর্ত উপস্থিতি প্রমাণ করে এই অসা¤প্রদায়িক উদাহরণ। মেলার উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে চাষী, মাঝি, জেলে, তাঁতী, কামার-কুমার এর মাঝে।
সর্বোপরি ক্রেতাদের উপচে পড়া ভীড় মিলনমেলার ছন্দমিল দেয়। এ মেলায় গৃহস্থালী, সৌখিন দ্রব্য, কুটির শিল্প, কারু শিল্প, মৃৎ শিল্প, গার্মেন্টস শিল্প, আসবাবপত্র, বাাঁশ, কাঠ, খই, রান্নাঘরের টুকিটাকিসহ জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি থাকে। ক্রেতার আগমনের প্রত্যাশায় বহুরূপি আয়োজনের পশরা সাজিয়ে থাকে বিক্রেতারা । এরা বেশিরভাগই আসেন ননসিলেট থেকে।
শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য মেলাটি প্রাণের খোরাক জোগায় অপরদিকে পরিবারকর্তাদের ঘর সাজানোর স্বপ্ন দেখায়।
রথযাত্রার আমেজ ও উচ্ছ্বাস আবাল-বৃদ্ধ বণিতা সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। উৎসব আর উল্লাসে বয়স্কদের নষ্টালজিয়ায় ঘিরে বসে মেলাটি। কেউবা হারিয়ে যেতে চান তেপান্তর আর কেউবা নাগরদোলায় দুলতে থাকেন স্বপ্নের আকাশে...।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।