আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কফিহাউজে আড্ডার অনুলিখন

নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই

কফিহাউজের গানটা বাজারে আসার পরই সাংবাদিক মইদুল ঢাকা থেকে ফোন করে আমাকে বলেছিল," দোস্ত, সেই আড্ডাটা কী আবার দেয়া যায়? সবাই কে জানিয়ে দেই নেক্সট ইয়ারে চলে আসতে। আমার কাছে নিখিলেষের ফোন নম্বর আছে। সুজাতাকেও খোঁজ করলে পাওয়া যাবে। " মইদুলের ভাব বরাবরই একটু বেশিই। কাগজে যারা থাকে, তারা সবাইকে তাদের পাঠক মনে করে।

আগেও যখন আমরা আড্ডা দিতাম সে বকবক করে তার নিজের কথাই বলতো। সে কী লিখেছে, কোথায় কি করেছে। সেটা অন্যরা শুনতে চাইছে কিনা সেটা দেখতো না। অমল কান্তিকে একদিন মইদুল সরাসরি বলেছিল, "তুইতো ভালই লিখিস,দুএকটা কবিতা দিসতো, বসকে বলে ছাপিয়ে দেব"। অমলের অহংকারটা আমার ভাল লাগতো, সে বলেছিল, "দ্যাখ, আমি কারো তদবিরে লেখা ছাপাতে চাইনা।

তুই তো দেখেছিস, আমি কবিতা লিখি মানুষের স্বভাব নিয়ে, অভাব নিয়ে, নীতি নিয়ে, দর্শণ নিয়ে। যদি সেটা প্রকাশকদের ভাল না লাগে, পড়েই থাক। " অবশেষে পড়েই থাকলো। অমল ছোট একটা প্রেসে কাজ করতো। সে অনেক কবির বই ছাপালেও নিজের কবিতা আর ছাপানো হয়নি।

আমাদের আড্ডা চারটেতে শুরু হলেও অমল দেরী করে আসতো । কখনো পাঁচটা, কখনো ঠিক সাতটার আগে আগে। যখন সবাই উঠি উঠি করছে। এসেই কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে নতুন কবিতা বের করতো। একটা কবিতার কয়েক লাইন এখনো মনে আছে - নাম, "সঙ্গীত ও বিদ্রোহ' .... বড় হতে গিয়ে মুদ্রা গুনে ক্লান্ত হয়ো না উচ্ছাসে ভুলে যেও না অভুক্ত কৃষ্ণকে গীটারের ধুন তুলে, যতই গাও যতই সুচারু অভিনয় করো রঙ্গ মঞ্চে মৃত্যু এসে একদিন তুলে নিয়ে যাবে তোমায়।

......... গোয়ানিস ডি সুজা হালকা মেজাজের মানুষ । সে গ্র্যান্ড অর্কেষ্ট্রাতে গিটার বাজাতো। জটিল কবিতা, রাজনীতি বা দর্শনের আলোচনায় তার আগ্রহ ছিল কম । শুধু ভাল শ্রোতা হয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনতে থাকতো। সেদিন গিটারের কবিতা শুনে মুখ খুলে বলে ফেলেছিল, "মৃত্যুর কবিতা ভাল লাগেনা, দোস্ত।

জীবনটা গান বাজনায় সুরে সুরে উপভোগ করতে শেখ"। আমরা অনেকেই ভাল আছি। বিধাতার পরিহাস, সেই মৃত্যুবিমুখী ডি সুজাই চলে গিয়েছে। তাকে আড্ডায় চাইলেই আর পাওয়া যাবেনা। অবশ্য অমল কতদিন বাঁচবে কে জানে।

ফুসফুসের দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। বড় বেশি বিড়ি সিগারেট ফুঁকতো সে। ধুমপান সেই বয়সে একটা ফ্যাশনই ছিলো। কফি হাউজে ধুমপানের উপর কড়া কড়ি ছিল না। চার্মিনার সিগারেটের ধোঁয়ায় চারপাশ আচ্ছন্ন হতো।

সুজাতা বিড়ি সিগেরেট দু'চোখে দেখতে পেত না । সে ক্ষেপে গিয়ে বলতো, "তোরা যদি এগুলো না থামাস তাহলে আমি আর আসবো না"। সে মাঝে মাঝে আসতোও না। নিম্ন মধ্যপরিবারের পরিবারের মেয়ে। পড়াশোনায় মোটামুটি কিন্তু চেহারাটি ছিল ভারী মিষ্টি।

সে মেয়েদের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতো। নিজেও বেশ সাহস করে আসতো। সে যুগে মেয়েদের বের হওয়া সহজ ছিল না। ঝড় বৃষ্টি হলে সুজাতা আসতো না। তবে সুজাতা না আসার আরেকটা কারণ পেয়েছিলাম।

আড্ডায় আমাদের নাট্যবিশেষজ্ঞ রমা রায় সবাইকে আশ্চর্য করে বলেছিল,"জানিস, ও আজ কেন আসেনি। ও তার পাড়ার একটা ছেলের সঙ্গে লাইন করে"। আমরা কেউই রমা রায়কে বিশ্বাস করিনি। যদিও সে সখ করে অভিনয় করতো কিন্তু নাটকের লোকজনের কোনটা যে অভিনয় আর কোনটা সত্য বোঝা মুশকিল। তার অফিসের বার্ষিক পুনর্মিলনীতে সে মানসিক বিকারগ্রস্থ মানুষের চরিত্রে অভিনয় করছিল ।

রমা এমন স্বাভাবিক অভিনয় করেছিল যে পরে অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "তুই এসব শিখলি কী করে"। তখন সে বলেছিল, "হা হা, কেন আমরা বাস্তবে কম পাগল নাকি? শিলা বৃষ্টিতে, জমানে কাদা পানিতে শহর লাট্টুর মতো ঝিম মেরে আছে। আর এখানে আমরা হৈ চৈ করে যাচ্ছি পরাবাস্তব কবিতার উপাদান আর হেনরী ডমিয়ারের স্কেচ নিয়ে। " রমা রায় মজা করে কথা বললেও ভিতরে সে ছিল খুব সিরিয়াস। শেষের দিকে সে আড্ডায় আসা বন্ধ করে দিলে খুব মিস করতাম তাকে।

ডি সুজা খোঁজ নিয়েছিল। সে নাটকের দলের একজনের সঙ্গে প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার পর আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করে। মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় মুম্বাইএর এক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় হয়, দীর্ঘচিকিৎসা হয় । তারপরও সে সেরে ওঠেনি। আমি রমা রায়ের মতো অভিনয় পারতাম না।

মন ভাল হলে মুখে ছাপ পড়তো। মন খারাপ হলেও লুকাতে পারতাম না। ততক্ষণে মইদুল আর অমল যামিনী রায় অথবা বিষ্ণুদের কবিতার নিয়ে তুমুল বিতর্ক করছিল। গরম চা আর লুচি দিয়ে গিয়েছিল বেয়ারা। বাইরে পৌষের ঠান্ডা বাতাস।

এমন দারুণ দিনে সুজাতার ঘটনাটা জেনে কেন যেন ভাল লাগছিল না। রমা রায় মনে হয় আঁচ করতে পেরেছিল। সে বলেছিল, "তোর কি শরীর খারাপ?" আমি বলেছিলাম, "না, না, একটু ঠান্ডা" । মেয়েদের সঙ্গে একসঙ্গে মিশলেই যে প্রেমে পড়তে হবে এমনটা আমার ভাল লাগতো না। তবে কি আমিই কি আমার নিয়ম ভেঙে সুজাতাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম? তা না হলে, মাস ছয়েক পর যখন সুজাতার বিয়ে হলো, বিরাট আয়োজন করে, আমি কেন যাইনি? সুজাতা স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে গিয়েছিল।

বছর খানেক আগে শেষ দেখা। সে বেশ বদলে গেছে। নাক কান গলা ঝুলে গেছে সোনার গয়নার ওজনে। যদিও শরীরের ওজন দেখলে সেই ভালবাসার অনুভুতিটা আর থাকে না। নিখিলেশেরও হয়তে সুজাতাকে নিয়ে একটা ইচ্ছে ছিল।

সে আমার ইচ্ছেটা জানতোনা। নানা ছুতোয় সুজাতার কথা তুলতো। একদিন বলেছিল, "দ্যাখ সুজাতার একটা পেন্সিল স্কেচ করেছি, ভাল হয়নি?" তখনো সে আর্ট কলেজে নতুন। সুজাতার চেহারা মিলে যায় নি, তবে চোখগুলো এঁকেছিল বড় করে। অনেক মায়া দিয়ে।

ভাল না বাসলে এমন মায়া কে করে? নিখিলেষ স্যান্যাল স্কলারশিপ নিয়ে ফ্রান্সে চলে যায়। শুনেছি সে বিয়ে সাদী করে প্যারিসেই সেটেল করেছে। তার নাম ডাক হয়েছে অনেক। সেও আমার মতো "কফিহাউজ" নামে একটা ছবি এঁকেছে। তার কফিহাউজটা একটা বাগানের মতো।

সেখানে বসে আমরা। আমাদের চেহারাগুলো খুব স্পষ্ট নয় কিন্তু ছবিটার কেন্দ্রে অবিকল সুজাতার মতো দেখতে একটা মেয়ে । চোখগুলো তার অনেক বেশী মায়াবী। তবে কি নিখিলেষ ও আমার মতো আলাদা করে সুজাতাকে মনে রেখেছে? ------------- (ব্লগার নকীবুল বারীর পোস্টে অনুপ্রাণিত হয়ে করা কমেন্ট। http://www.somewhereinblog.net/blog/nokiib )


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.