আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপগল্পঃ গাঁদা

আপাতত ঘুরপাক খাচ্ছি!
এক দেশে এক রাজা বাস করতেন। গবুচন্দ্র তার নাম। তার তিন সুন্দরী কন্যা ছিল। পরীর ন্যায় রুপবতী কন্যারা সারাদিন হৈচৈ করে বিশাল বাড়িটা মাথায় তুলতো। বড় জনের নাম ফুলি, মেজো জন অলি আর একদম ছোট জন কলি।

রাজা মহাশয় তার বিশালাকার বাগানের দিকে চেয়ে এই নাম গুলো রেখেছেন। আপাতত এই সুন্দরী কন্যা ত্রয়ের কথা অবশিষ্ট থাকুক। গবুচন্দ্র ছোট কাল থেকেই গান বাজনা বেশ পছন্দ করতেন। এলাকার সব গান বাজনার আসরে উপস্থিত থাকতেন। বেশ সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষও বটে।

ছোট কাল থেকেই প্রচন্ড শখ বাগান করার। ছোটকালে মনে মনে পণ করেছিলেন রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করার সাথে সাথে পিতৃদেব হবুচন্দ্রের সুরম্য রাজপ্রাসাদের সামনেই একটি ফুল বাগান করবেন। সকাল বিকেল গানের আসর বসাবেন। গান শুনবেন আর বাগানের সৌন্দর্য অবলোকন করবেন। সেই মোতাবেক বিয়ের আগে ভাগেই বাগান করলেন।

নবীন মালীকে দিলেন বাগানের সব দায়-দায়িত্ব। কিভাবে বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা যায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত সদুপদেশ দিতে থাকলেন। পরিচিত প্রজাতি ছাড়াও লোক লস্কর দিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল আনালেন। দিনে দিনে বাগানের শ্রী বৃদ্ধি পেতে থাকলো। কে আগে গবুচন্দ্রের মন কাঁড়তে পারে, এ নিয়ে বাগানের ফুলগুলির মধ্যে যেন প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেল।

কেউ রূপ দিয়ে কেউবা গন্ধ দিয়ে রাজার মন মাতানো শুরু করলো। যে রূপ গন্ধ দিয়ে পারলো না সে বাতাসে হেলে দুলে রাজার মন মাতানোর চেষ্ঠা করতে থাকলো। বাগানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গবুচন্দ্র বিশাল এক গানের আসর বসালেন। বিভিন্ন রাজ্যের রাজাগণ স্বপরিবারে এই আসরে আমন্ত্রিত হলেন। সেই সাথে নিজ রাজ্য ছাড়াও বাইরের রাজ্যের নামকরা সব গায়ক গায়িকাগণ আমন্ত্রিত হলেন।

গানের আসর শুরু হয়ে গেল। গান বুঝে, গানের মান বুঝে রাজা গায়ক গায়িকাদের একটি করে ফুল উপহার দিতে থাকলেন। গানের আসরে কান কথা হতে হতে রাজার কান পর্যন্ত একটি কথা পৌঁছালো। পার্শ্ববর্তী ছিলমন রাজ্যের রাজা অনীল মুখোপাধ্যায়ের এক ষোড়শী সুন্দরী কন্যা আসরে উপস্থিত আছেন। আরতি মুখোপাধ্যায় যার নাম।

তার কন্ঠের মাধুরীতে কিনা মুক্তো ঝড়ে পড়ে। রাজা ব্যাকুলচিত্তে তার কন্ঠে গান শোনার খায়েশ প্রকাশ করলেন। অনীল মুখোপাধ্যায়কে বলাতে তিনি হৃষ্টচিত্তে মেয়েকে গান গাওয়ার জন্য প্ররোচিত করলেন। আরতি মুখোপাধ্যায় যেন লজ্জাবতীর ন্যায় একটু গুটিয়ে পড়েছে। তারপরও মঞ্চে এসে গাওয়া শুরু করলেন------------ এই মন যেন ক্ষন বুঝেনা, বুঝেনা কোন বাহানা তারে বারে বারে চাহি, মনে মনে ডাকি কেন সে বুঝেও বুঝে না কাছে যদি এলে পরে হাত ধরে নাও তুমি তুলে ইশারাতে দিশেহারা করো মোরে সুরে সুরে মন মাতাবো যে এই মন যেন ক্ষন বুঝেনা, বুঝেনা কোন বাহানা তারে বারে বারে চাহি, মনে মনে ডাকি কেন সে বুঝেও বুঝে না শরতের শেষে ফুল বাগান হেসে করে দেখ ছলনা আমাদের মিলনমেলায় যেন দূর হবে তার যাতনা এই মন যেন ক্ষন বুঝেনা, বুঝেনা কোন বাহানা তারে বারে বারে চাহি, মনে মনে ডাকি কেন সে বুঝেও বুঝে না এই গান শুনে গবুচন্দ্র যারপরনাই খুশী হলেন।

আবেগে আপ্লুত হয়ে হাতের কাছের লাল টুকটুকে গোলাপটিই উপহার স্বরূপ আরতি মুখোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দিলেন। আরতি মুখোপাধ্যায়ের মুখ যেন গোলাপের ন্যায় আরক্ত হয়ে গেল। চারিদিকে উচ্ছ্বাস ও হাস্যকরতলের রোল পড়ে গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে ততক্ষণে। রাজামশায় নতুন আবেশ রোমন্থন করতে করতে আসরের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।

কয়েক দিন যেন গবুচন্দ্র ঘোরের মধ্যে বসবাস করলেন । কেমন জানি অস্থিরতা কাজ করছে শয়নে স্বপনে। রাজ্যের কাম কাজে উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছেন না। সাত দিন পর এক মঙ্গলবারে, অনীল মুখোপাধ্যায়ের নিকট কনিষ্ঠ কন্যা আরতী মুখোপাধ্যয়কে রানী হিসেবে গ্রহণ করার ইচ্ছে পোষণ করে পয়গাম পাঠালেন। অনীল মুখোপাধ্যায় দেরী না করে পরের মঙ্গলবার মহাসমারোহে আরতীকে পাত্রস্থ করলেন।

রাজার বাসর ঘর সাজানো হলো তার বাগানের হরেক রকম ফুলে। গোলাপ, রজনীগন্ধা, হাস্নাহেনা, বকুল, গাঁদা সহ আর যত প্রকার ফুল আছে কোনটাই বাদ যায়নি। গবুচন্দ্র আরতী রানীর গলে একটি বেলী ফুলের মালা পড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে বাসরঘরের মধ্যে যেন স্বর্গীয় আবহ খেলে গেল। আর খোপায় গুজে দিলেন একটি রক্তলাল জবা।

আরতী রানীর মুখমন্ডল ফুটন্ত জবার ন্যায় অপরূপ লাজে রক্তিমবর্ণ ধারণ করলো। পরের দিন সকালবেলা ফুল বাগানে পাখিদের কিচির-মিচির ধ্বনিতে রাজা ও রানী একান্ত বাধ্য হয়ে বিছানা থেকে গাত্রোত্থান করলেন। আমরা আবার বাগানের দিকে একটুখানি নজর দেই। রাজার ফুল বাগানে ফুল সম্প্রদায়ের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দিল। বিশেষ করে গাঁদা ফুল গুলো মন খারাপ করে আছে সেই বর্ষপূর্তির গানের আসরের দিন থেকে।

কারণ সব ক্ষেত্রে অন্যান্য ফুলগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তাদের ঘ্রান চলনসই হওয়া সত্ত্বেও গানের অনুষ্ঠানে সবচেয়ে খারাপ গায়কের হাতে তাদেরকে দেয়া হয়েছে। গোলাপকে দেয়া হয়েছে স্বয়ং ভাবী রানীর হাতে। কোথাকার কোন বেলী আর জবা না কি নাম সেও গুরুত্ব পাচ্ছে রাজা রানীর কাছে। আর আমরা গাধার মত গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছি।

ফুলের তোরাতেও গোলাপ বানুকে মধ্যমনী করা হচ্ছে। বয়ঃজৈষ্ঠ্য গাছটি বেশ মুষড়ে পড়েছে। কয়েক দিন মন খারাপ করে থাকার পর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা শুরু করলো। হে ঈশ্বর আমাদেরকেও লাল গোলাপের মত লাল টুকটুকে সুন্দর করে দাও। সুদীর্ঘ কুড়ি বছর প্রার্থনার পর ঈশ্বর তাদের প্রতি সদয় হলেন এবং প্রার্থনা কবুল করলেন।

তাদেরকে শর্ত দিলেন "যেটুকু সুগন্ধ আছে তা কেড়ে নিবেন"। বিনিময়ে তিনবার সুযোগ দিবেন যেকোন ফুল হওয়ার। তারা সানন্দে রাজী হয়ে গেল। এক পূর্ণিমার রাত্রে গোলাপের রুপ পেয়ে গাদা সম্প্রদায় যারপরনাই খুশী হয়ে গেল। তারা আনন্দে বুক ফুলিয়ে বাতাসে পাপড়ী মেলে ধরলো আর পাশ্ববর্তী খাঁটি গোলাপ সম্প্রদায়ের দিকে বিদ্বেষমূলক ভঙ্গী প্রকাশ করতে থাকলো।

রাজা পরের দিন সকালবেলা গাদা ফুল গাছগুলোর জায়গায় গোলাপ গাছ দেখে বিস্ময়াভিভূত হলেন। সুদীর্ঘ কুড়ি বছরে গবুচন্দ্র আর আরতী রানীর প্রাসাদ উজ্জ্বল করে তিন মেয়ের আগমন ঘটেছে বসুন্ধরায়। ফুলি যেন হয়েছে ফুলের মত সুন্দর। অলিও দেখতে কম যায় না। ঠিক যেন অলির ন্যায়।

সারাদিন বাগানময় ঘুরে বেড়ানো আর ফুলের সাথে গাছের সাথে কথপোকথনই তার কাজ। কিন্তু অলির একটা বদ অভ্যাস হলো- কোন ফুল পছন্দ না হলে দুম করে ছিড়ে ফেলা। আর একদম ছোট মেয়ে কলি যেন ছোট্ট পরী। তার দৈনন্দিন কাজের বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে ফুলকলি থেকে কিভাবে ফুল ফোটে এ নিয়ে গবেষণা করা। সে মনে মনে নিজেকে ফুল বাগানের রানী হিসেবে কল্পনা করে।

এমন সুন্দর তিনটি মেয়ে পেয়ে ছেলে সন্তানের জন্য রাজা বা রানী কারোরই কোন আফসোস নেই। বড় মেয়ে ফুলির বিয়ের ঢের বয়স হয়েছে। পাত্রপক্ষের আনাগোনা চলছে। শুভ দিন বের করে সয়ফুলমুলকের রাজপুত্র হরিষ চন্দ্রের সাথে ফুলির বিয়ে হয়ে গেল। রাজার শর্ত মোতাবেক হরিষ চন্দ্র ঘরজামাই থাকবে।

রাজ বাগানের ফুল দিয়ে ঢেলে সাজানো হলো বাসর। নববধূ অধীর আগ্রহে পাত্রের আগমনের অপেক্ষায় বসে আছে। অবশেষে পাত্র সন্তর্পনে দরজা খুললো। হাতে একটি গোলাপের তোরা (গাঁদা থেকে গোলাপ)। তোরায় কুঁড়িটি লাল গোলাপ।

ফুলের তোরাটি যেইনা ফুলির হাতে তুলে দিলো অমনি একটা সূচালো কাটার আঘাতে ফুলি ও মারে বাবারে গেলামরে করে চিৎকার করে ফুলের তোরাটি ছুড়ে দিল। গিয়ে পড়লো বাগানের মাঝখানে। আছাঢ় খেয়ে ফুলগুলোর কোমড় যেন ভেঙ্গে গেল। তারা অসহায়ের মত কাঁদতে থাকলো। তাদের গোলাপ হওয়ার শখ মিটে গেল।

এরপর তারা ঈশ্বরের কাছে ফরিয়াদ জানালো বেলী ফুলের রূপ দেয়ার জন্য। সেই রাত্রেই গাঁদা থেকে গোলাপ হওয়া গাছগুলো বেলী গাছে পরিণত হলো। পরের দিন নবীন মালী দেখলেন গোলাপের দ্বিতীয় বাগানটিতে সুন্দর শুভ্র বেলী ফুল বাতাসে দোল খাচ্ছে। তবে রাজামশাই কিছুটা বিরক্ত হলেন। মনে মনে ভাবলেন কোন শনির দশা লেগেছে বাগানের এই অংশে।

কারণ ছোট মেয়ে কলি হুট করে বাগানের এই ধরনের পরিবর্তনে ভীত হয়ে পড়েছে। তার শত কলি থেকে শত ফুল ফোটানোর দিনে ছেদ পড়লো। পাঁচ বছর পর এক বসন্তে হরিষ চন্দ্রের ছোট ভাই গৌরি চন্দ্র বড় ভাই, ভাবী আর তাদের তিন বছর বয়সের ছেলে গীতিশ চন্দ্র'কে দেখতে আসলো। গীতিশ চন্দ্র কে সবাই আদর করে গেদা বলে ডাকে। গেদা দৈনন্দিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই পাঁচটি করে হংস ডিম্ব খেত।

পাঁচটি ডিম্ব না পেলে চিল চিৎকার করে পুরো রাজপ্রাসাদের বাতাস ভারী করে তুলতো । এজন্য সকাল বেলা সবার আগে গেদার জন্য ডিম্ব অমলেট প্রস্তুত হত। গেদা'র স্বাস্থ্যও হয়েছে সুন্দর ও নাদুস নুদুস। সেই সঙ্গে গেদা'র একটা অভ্যাস - রাজপ্রাদের আঙ্গিনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বর্জ্য পদার্থ নিস্কাশন। গৌরি চন্দ্র কয়েক দিন থাকার পর রাজপ্রাসাদের মেজো মেয়ে অলির প্রেমে পড়ে গেল।

কিন্তু ষোড়শী অলি এত বেশী চঞ্চল যে ধারেকাছে দু’মুহুর্তের জন্য পাওয়া ভারী মুশকিল। কিভাবে তাকে মনের কথা বলা যায় এই চিন্তায় মশগুল হয়ে পড়লো। একটা উপায় অবশ্য খুঁজে পেল। অনেক যত্ন করে রাতভর সেই বেলী ফুল দিয়ে একটা মালা গাঁথলো। বেলী ফুল গুলো যেন খুশীতে গদগদ।

তাদেরকে দিয়ে চমৎকার মালা গাঁথা হয়েছে। আবার সেই মালা কাকে জানি পরিয়ে দেয়া হবে। গৌরি চন্দ্র সকাল বেলা অলির গলে বেলীর মালা পরানোর অপেক্ষায় বারান্দায় বসে থাকলো। প্রায় আধাঘন্টা বসে থাকার পর চপল পায়ের অলির দেখা পেল সে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ঈশারায় ডাক দিলো তাকে।

কাছে আসার সাথে সাথে দুম করে মালাটি পরিয়ে দিল। অলি বেলী ফুল মোটেও পছন্দ করতো না। তাই মালাটি দুহাতে সমানে টেনে হিচড়ে ছিড়ে ফেললো। আর রাজপ্রাসাদের উঠানময় ছড়িয়ে দিল। সেই বেলী ফুল গেদা'র বর্জ্য পদার্থের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।

এহেন অবস্থায় বেলী ফুলগুলো গগনবিদারী কাঁন্না শুরু করে দিল। ঈশ্বরের কাছে ফরিয়াদ করলো "হে ঈশ্বর আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাই। আমাদের অনেক শিক্ষা হয়ে গেছে। আমাদের তুমি মাপ করে দাও। " ঈশ্বর তাদের শেষ ইচ্ছে পূরণ করলেন।

কিন্তু গন্ধটা আরও একটু কটু হয়ে গেল। রাজা মশাই গাঁদা সম্প্রদায়ের এহেন রূপের বিবর্তন দেখে ভীষণ ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গেলেন। তাদেরকে স্ববংশে বাগানের বাইরে দূরে এক পরিত্যক্ত জায়গায় ফেলে দিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। কলির ভয়ের দিনগুলো কেটে গেল। আবারও সে সারাদিনমান ছোট্ট ফুলপরীর ন্যায় সারা বাগানময় ঘুরে বেড়াতে থাকলো।

আর বিভিন্ন ফুল কলি থেকে ফুল ফোটানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলো। রাজা আর রাজ পরিবারের সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.